সেনাবাহিনী যখন টার্গেট

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় শনিবার, ১৫ মার্চ, ২০২৫
  • ৩৫ দেখা হয়েছে

আবু রূশদ:- ১৯৯৬ সালের ২০ মে সেনাবাহিনীতে একটি অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা হয়। তদানীন্তন সেনাপ্রধান লে. জেনারেল আবু সালেহ মো. নাসিম, বীর বিক্রম ও তার অনুসারী মেজর জেনারেল সৈয়দ মোহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক, মেজর জেনারেল হেলাল মোরশেদ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মিরন হামিদুর রহমানসহ একটি গ্রুপ প্রেসিডেন্ট আব্দুর রহমান বিশ্বাসকে হটিয়ে দিয়ে ক্ষমতা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়।

একই সঙ্গে সে সময়কার ডিজি-ডিজিএফআই মেজর জেনারেল এমএ মতিন বীরপ্রতীক ও সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের পিএসও মেজর জেনারেল সুবিদ আলী ভূঁইয়াকে সেনাপ্রধান তাদের পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে লগ এরিয়ায় অ্যাটাচ করার নির্দেশ প্রদান করেন। ডিজিএফআই ও সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ সরাসরি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন। সে সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় ছিল বলে প্রেসিডেন্ট ছিলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ও কমান্ডার ইন চিফ।

আইনত তাই ওই দুই কর্মকর্তার অপসারণ ছিল বেআইনি। সার্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মে. জে. মতিন, প্রেসিডেন্টের মিলিটারি সেক্রেটারি মে. জে. রুহুল আলম চৌধুরীসহ সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার প্রতি অনুগত একদল সেনা কর্মকর্তা লে. জে. নাসিমের ক্যুদেতা রুখে দেন।

সেটা ব্যর্থ হয়। সিজিএস লে. জে. মাহবুবুর রহমান সেনাপ্রধান নিযুক্ত হন। ওই বিদ্রোহ দমনে সাহসী ভূমিকা পালন করেছিলেন সাভারের জিওসি মে. জে. ইমামুজ্জামান বীরবিক্রম ও ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার আব্দুর রহিম। দুজন শুধু মুক্তিযোদ্ধাই নন, জে. নাসিমের সঙ্গে একই ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ক্যাডেট ছিলেন।

তখন সামনে নির্বাচন নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল মহাব্যস্ত। এর মাঝে সেনাবাহিনীতে অভ্যন্তরীণ ক্যু, পাল্টা ক্যু’র মতো ঘটনা নিয়ে সরকার মারাত্মক সমস্যায় পড়ে যায়। তবে মূলত মে. জেনারেল এমএ মতিনের কঠোর ভূমিকার কারণে অভ্যুত্থান সামাল দেওয়া সম্ভব হয় ও সেনাবাহিনী ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়।

মজার বিষয় হলো, বাংলাদেশ সরকার যখন নির্বাচনি প্রক্রিয়া ঠিক রাখতে মরণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল ও সেনাবাহিনীতে রক্তপাত ঠেকাতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, তখন পশ্চিমবঙ্গের আনন্দবাজার থেকে শুরু করে ভারতের মিডিয়ায় অপপ্রচার মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। সব জায়গায় প্রচার করা হয় যে, বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের নির্মূলে পাকিস্তানপন্থি অফিসাররা অঘটন ঘটাচ্ছে! যারা জে. নাসিমের অবৈধ তৎপরতা রুখে দিয়েছিলেন, তাদের বেশির ভাগ কর্মকর্তা মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার পরও তাদের পাকিস্তানপন্থি হিসাবে চিহ্নিত করে বিষয়টিকে ঘোলাটে করার চেষ্টা করে ভারতের মিডিয়া।

ভাবখানা এমন ছিল যে, লে. জে. নাসিমের ক্যু ও পালটা ক্যু চলতে দেওয়া উচিত ছিল! এবং সেই ক্যু ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের! এছাড়া সে সময় ভারত তার পূর্ব কমান্ডে সেনাবাহিনীসহ প্রায় দশ লাখ সেনা জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশ সীমান্তে সতর্কাবস্থায় রাখার নির্দেশ দেয়।

আমরা যদি ইতিহাস পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখতে পাই, ১৯৮২-তে একটি জনপ্রিয় নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে তদানীন্তন সেনাপ্রধান লে. জে. এরশাদ অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তখনো ভারতের মিডিয়া উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিল, বাংলাদেশে তাদের ‘বিশেষ বন্ধু’ শেখ হাসিনা পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছিলেন ‘আই অ্যাম নট আনহ্যাপি’। যেহেতু জাতীয়তাবাদী একটি সরকারকে হটানো হয়েছিল, তাই তাদের আনন্দ প্রকাশ ছিল দেখার মতো। বাংলাদেশে যে গণতন্ত্র নস্যাৎ হয়ে গেল, সেটা বড় বিষয় ছিল না। স্বৈরাচার, সামরিক শাসন যদি তাদের পারপাস সার্ভ করে, তবে তা জায়েজ হয়ে যায় ভারতের মিডিয়ায় ও ক্ষমতাসীন মহলে।

এরও আগে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা জেনারেল জিয়াউর রহমানকে হত্যার পরও ভারতের মিডিয়ায় একইরকম উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা গেছে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে সেনা অভ্যুত্থানের পর জে. জিয়া বেঁচে আছেন, না নিহত হয়েছেন, তা নিয়ে যখন বাংলদেশে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন ভারতের আকাশবাণী সর্বপ্রথম তার নিহত হওয়ার খবরটি প্রচার করে। একইসঙ্গে আরও কতগুলো বিষয়ও এখানে আমরা ধর্তব্যে নিতে পারি। সেগুলো হলো-

ক. প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের একদিন আগে ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করে।

খ. জিয়া হত্যার দুদিন পর ২ জুন ’৮১ তারিখে আকাশবাণী পরিবেশিত সকালের খবরে বলা হয়, বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে।

গ. আকাশবাণীর অন্য আরেক খবরে ভারতীয় সরকারের বরাত দিয়ে জানানো হয়, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে সহায়তার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।

ঘ. প্রেসিডেন্ট জিয়ার হত্যাকাণ্ডের সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভারতীয় কর্তৃপক্ষ নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে জানতে চান, শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করা হয়েছে কিনা।

আমরা যদি স্বাধীনতার পর থেকে লক্ষ করি, তাহলে দেখব, বাংলাদেশে গণতন্ত্র বা সুশাসন থাকুক, সেটা কখনোই ভারতের জন্য বিবেচ্য বিষয় ছিল না। স্বাধীনতা যুদ্ধে সহায়তার জন্য বাংলাদেশের মানুষ ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকলেও গণতন্ত্রহীনতাকে প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য অবশ্যই পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে ভারতকে অভিযুক্ত করা যায়।

১৯৭২-৭৫ সময়কালের ঘটনাবলি, তদানীন্তন সেনা কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতা আমলে নিলে নির্দ্বিধায় বলা যায়, ভারত কখনোই চায়নি বাংলাদেশে একটি কার্যকর, সুপ্রশিক্ষিত ও সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী থাকুক। শেখ মুজিবুর রহমান রক্ষীবাহিনীকে সব ধরনের সুবিধা দিয়ে সজ্জিত করলেও ভারতের সেখানে কোনো আপত্তি ছিল না।

কিন্তু তখন মাত্র কয়েকটি ব্রিগেড থাকার পরও সেনাবাহিনীকে প্রায় পঙ্গু করে রাখা হয়েছিল। এর ওপর ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় অংশ, দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তাদের সাইডলাইন করার উদগ্র চেষ্টা। এমনকি স্বাধীনতার ঘোষক, জেড ফোর্সের কমান্ডার জিয়াউর রহমান, বীরউত্তমকে সেনাবাহিনী থেকে সরিয়ে দিয়ে মিয়ানমারে সামরিক উপদেষ্টা হিসাবে প্রেরণের কাজটি প্রায় সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল। অনেক মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাকে ঢালাওভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর আবারও সেনাবাহিনীতে রক্তপাত নিশ্চিত করতে ও দেশে গৃহযুদ্ধ উসকে দেওয়ার লক্ষ্যে ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফকে দিয়ে প্রথমবারের মতো সেনাবাহিনীর ক্ষমতাগ্রহণ ও সামরিক শাসনকে সমর্থন করে ভারত। ১৫ আগস্ট কিন্তু সামরিক শাসন জারি হয়নি। এরপর ওই সালের ৭ নভেম্বর থেকে নিয়ে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনবার ভারত বাংলাদেশ আক্রমণের পরিকল্পনা আঁটে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের হস্তক্ষেপে সেই হঠকারী পদক্ষেপ থেকে সরে আসতে বাধ্য হয় ভারতের নীতিনির্ধারকরা। [নিবন্ধকারের লেখা জাতীয় নিরাপত্তা, রণনীতি ও সশস্ত্র বাহিনী’ শীর্ষক বই দ্রষ্টব্য]

যাহোক আমাদের গত ৫৪ বছরের ইতিহাসে আমরা দেখেছি, বাংলাদেশে শুধু একটি দলকে যেনতেনভাবে ক্ষমতায় রাখতে বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশটি বারবার অগণতান্ত্রিক শক্তিকে উসকে দিয়েছে। ২০০৭ সালে মূলত তাদের ইন্ধনে ও সক্রিয় সহযোগিতায়ই জেনারেল মঈন ইউ আহমদ বাংলাদেশের ঘাড়ে চেপে বসেন। প্রণব মুখার্জি এটা তো তার বইয়ে লিখেই গেছেন। তার পর থেকে ভারত তার সর্বশক্তি নিয়োগ করে তাদের ‘একমাত্র বন্ধু’ দলটিকে যাচ্ছেতাইভাবে ক্ষমতায় রেখেছে। বাংলদেশের মানুষ তো ভুলে যায়নি যে, ২০১৩ সালে কীভাবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুজাতা সিং বাংলাদেশে এসে হুমকির সুরে কথা বলেছিলেন। কীভাবে তাদের অনুপ্রবেশকারী এজেন্টদের সহায়তায় একটা হাস্যকর একপক্ষীয় নির্বাচন নিশ্চিত করেছিলেন। আজ বাংলাদেশ যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে, তার মূলে রয়েছে সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়া, একপক্ষীয়ভাবে একটি মাত্র দলকে ক্ষমতায় রেখে চরম নিবর্তনবাদী শাসনকে দীর্ঘায়িত করার বিষময় ফল।

ভারত এই দায় এড়াতে পারে না। এতে যে ভারতের নিজ জাতীয় নিরাপত্তাও ক্ষুণ্ন হয়নি, তাও নয়। বরং এখন ভারত হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে তার নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়তে পারে। সেজন্যই হয়তো ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের আজ বলতে হচ্ছে বাংলাদেশে একটি ইনক্লুসিভ নির্বাচনের কথা। এ বিষয়টি যদি প্রথম থেকেই ভারত অনুধাবন করত, অনুসরণ করত, তাহলে আজ আর এটি বলার দরকার হতো না। তারা বারবার বাংলাদেশিদের মনের কথা, চাহিদার কথা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন, সেটা বলাই বাহুল্য।

অতিসম্প্রতি আমরা লক্ষ করছি, ভারতের একশ্রেণির মিডিয়া বাংলাদেশের সেনাবাহিনী নিয়ে অতিমাত্রায় সরব ভূমিকা পালন করছে। ডাহা মিথ্যা বা মনের মাধুরী মিশিয়ে যা তা বলে যাচ্ছে। ভারতের মতো একটি বড় দেশের কাছে এসব কাম্য না হলেও আমাদের অবাক বিস্ময়ে তা দেখতে হচ্ছে। এসব প্রচারণায় আবার উঠে আসছে পাকিস্তানের নাম। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে সেই যে শুরু হয়েছে কথায় কথায় সব অঘটনে পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতার কথা প্রচার করা, তা আর শেষ হলো না। একজন চরম ধিকৃত মানবাধিকারবিরোধী, গণহত্যাকারী ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের লজ্জাজনকভাবে আশ্রয় দেওয়ার কোনো অপরাধবোধ বা সংকোচ নয়, বরং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলেই যেন তাদের লাভ, এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সবার কাছে।

সম্প্রতি ভারতের মিডিয়ায় খুবই কো-অর্ডিনেটেড ওয়েতে প্রচার চালান হয়েছে যে, সেনা সদর দপ্তরের একজন পিএসও লে. জেনারেল ফয়েজ, যিনি কিউএমজি পদে বহাল আছেন, তিনি পাকিস্তানের সহযোগিতায় অভ্যুত্থান পরিকল্পনা করছেন। এতে নাকি অনেকের সায় আছে। এমন প্রচারণাও সমান্তরালভাবে ইউটিউবের মাধ্যমে করা হয়েছে যে, ক্যু ঘটে গেছে! আইএসপিআর খুবই শক্ত ভাষায় একটি বিবৃতি দিতে বাধ্য হয়েছে ভারতীয় এসব প্রচারণার জবাব দিতে গিয়ে। কিন্তু বিষয়টি কি এতই হালকা?

দীর্ঘ স্বৈরশাসনের পর বাংলাদেশ একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, যেখানে অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা রক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কীভাবে ফ্যাসিবাদসৃষ্ট সামাজিক অবক্ষয় থেকে শুরু করে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংসের যে ভয়াবহ খেলা শুরু হয়েছিল, তার ফলআউট থেকে দেশকে রক্ষা করা যায় তা নিয়ে যখন বাংলাদেশ ব্যস্ত, তখন ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের এসব উদ্যোগ যারপরনাই চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এতে কী লাভ ভারতের? বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে, হানাহানির ঘটনা ঘটলে, তারা সেই ১৯৭৫-৭৬-এর মতো আগ্রাসনের সুযোগ পাবেন? এই তো? কিন্তু সময়টা যে সত্তর দশক নয়, এটা একুশ শতক। পৃথিবী, বাংলাদেশ সেই সময়ের ঘেরাটোপে আটকে নেই। এখনকার ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি কোনো অ্যাডভেঞ্চারের অনুকূল নয়। অন্তত দক্ষিণ এশিয়ার এই ভূখণ্ডে নয়। তাহলে আর কী লাভ? ‘একমাত্র বন্ধুর’ প্রতি ঋণ পরিশোধ? না সেই ‘বন্ধুর’ পতনের প্রতিশোধ?

অস্বীকার করার উপায় নেই, গত ১৫-১৬ বছরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একশ্রেণির অফিসার ভারতের ‘একমাত্র বন্ধু’কে যেনতেনভাবে ক্ষমতায় রাখতে বিভিন্নভাবে সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন, সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে ডেন্ট তৈরি করেছেন। রণনীতি থেকে শুরু করে প্রশিক্ষণের প্রতিটি পর্যায়ে ভারতবান্ধব নীতির সূচনাও হয়েছিল এ সময়টিতে। সেনাবাহিনীর বহু যোগ্য অফিসারকে পদোন্নতি যেমন দেওয়া হয়নি, তেমনি কথায় কথায় চাকরি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে কথিত ভারতবিরোধী হওয়ার জন্য। বাংলাদেশের কেউ ভারতবিরোধী হলেই বা ভারতের কী যায় আসে। এতবড় একটি দেশ কেন ক্ষুদ্র একটি দেশের ততোধিক ক্ষুদ্র একটি সেনাবাহিনী নিয়ে মাথা গরম করে ফেলবে? ভারতে কি আমেরিকা-বিরোধিতা, চীন-বিরোধিতা নেই? তাতে আমেরিকা, চীনের কী যায় আসে?

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বাংলাদেশ সেনবাহিনী না থাকলে কার লাভ। এই সেনাবাহিনী ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলে কার লাভ। যদিও বাস্তবতা বলে, বাংলাদেশে একটি কার্যকর, সুপ্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী থাকলে ভারতেরও লাভ। কারণ আঞ্চলিক নিরাপত্তার ব্যাপারটি হেলাফেলা করার বিষয় নয়। একটি সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী থাকলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাও নিশ্চিত হয়, যা ভারতের নিরাপত্তার জন্যও ইতিবাচক। যদি আমাদের সেনাবাহিনী গত আন্দোলনে পেশাদার ভূমিকা পালন না করত, তাহলে আজ বাংলাদেশের অবস্থা হতো নির্দ্বিধায় মিয়ানমারের মতো।

এর রিপল এফেক্ট গিয়ে পড়ত ভারতের সাত রাজ্য ও পশ্চিমবঙ্গে। সেই ধাক্কা সামলাতে হতো ভারতের সেনাবাহিনীকে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শত সীমাবদ্ধতা ও রাজনৈতিক প্রভাবের মধ্যে থেকেও জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে বলেই এখনো বাংলাদেশে গৃহযুদ্ধ লাগেনি, এখনো সরকারের হাতগুলো কাজ করতে পারছে। এই স্ট্যাটাস ক্যু নষ্ট করে দিলে বাংলাদেশের অবস্থা যেমন খারাপ হবে, অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে পড়বে, তেমনি সেই অস্থিতিশীলতার আগুনের তাপ গিয়ে পোড়াবে ভারতের রাজ্যগুলোকেও।

রাজনৈতিক, আদর্শিক মতবিরোধ বাংলাদেশে আছে, থাকবে। দীর্ঘদিন গোয়েন্দা সংস্থা ও র‌্যাবে কাজ করা কতিপয় কর্মকর্তার অভাবনীয় মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের ফলে জনগণের মনে নানা ধরনের সংশয়, সন্দেহ থাকতেই পারে। এর ওপর আছে গুম হয়ে যাওয়া, চরম নির্যাতনের শিকার হওয়া মানুষদের ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া বিচলিত মনের হাহাকার। আছে পিটিএসডি। এসব তো অস্বীকার করার উপায় নেই। স্বামীহারা স্ত্রী, পুত্রহারা পিতা, পিতাহারা সন্তান আর কীভাবে সোজাসুজি ভাবতে পারে শ্বাপদের চরম নৃশংসতাকে? সংগত কারণেই অনেক গুজব, হুজুগ দানা বাঁধে বিভিন্ন মহলে। সেনা কমান্ড নিয়েও সে রকম গুজব ছড়ায় আগুনের লেলিহান শিখার মতো। আছে বিডিআর হত্যাকাণ্ডের মর্মন্তুদ স্মৃতি। সব তো স্বাভাবিক আচরণের গ্যারান্টি দেয় না। এমন অবস্থায় এমনটিই হবে, হচ্ছে। তাই বলে বাংলাদেশের মানুষ কখনোই তাদের সেনাবাহিনীকে দূরে ঠেলে দেয়নি। সব সময় আগলে রেখেছে, মনের গহিন কোণে ঠাঁই দিয়েছে পরম মমতায়। সেনাবাহিনীও এই দায় ভুলে যায়নি। তারাও জনগণের পাশে থাকার, ফিরে আসার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে।

সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বলা যায়, একেকজনের একেক চিন্তা, নানা মত যেমন মুক্ত পরিবেশে বিস্তার লাভ করছে, তেমনি হুজুগ, আবেগও ছড়িয়ে পড়ছে। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে সব দিক যদি ধর্তব্যে নেওয়া হয়, তাহলে সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড এখন পর্যন্ত ঠিকভাবে কাজ করছে। তারা শক্তি প্রয়োগ না করেও ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার নিয়ে মাঠে সক্রিয় আছে। এক্সট্রা জুডিশিয়াল কোনো কর্মকাণ্ডে এখন পর্যন্ত তাদের জড়িত হতে দেখা যায়নি। বিগত সরকারের রেখে যাওয়া লিগেসির দৈত্যের নখদন্ত একদিনে, এক মাসে বা এক বছরে যে যাবে না, সেই বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই সেনা কমান্ড যথেষ্ট পরিপক্বতার পরিচয় দিয়েছে গত কয়েকটি মাস।

কিছু কিছু বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু বাংলাদেশে সেনাবাহিনী এতটা অপেশাদার হয়ে যায়নি যে, সুদূর পাকিস্তানের ইন্ধনে তারা হঠকারী কোনো কাজ করে বসবে এ সময়ে। তার মানে এই নয় যে, পাকিস্তানের কোনো গোষ্ঠীর প্রভাব এখানে নেই। থাকতে পারে। সেটা ভারতবিরোধিতা হতে পারে। আবার সেটা নিরাপত্তাহীনতার আতঙ্ক থেকে হতে পারে নেতিবাচক প্রক্রিয়া।

বাংলাদেশ যদি স্থিতিশীল থাকে, তাহলে ভারতও স্থিতিশীল থাকবে, দক্ষিণ এশিয়া স্থিতিশীল থাকবে। আর বাংলাদেশকে স্থিতিশীল রাখতে হলে থাকতে হবে পেশাদার ও জনগণের সমর্থনপুষ্ট সেনাবাহিনী। এ স্থিতিশীলতা রক্ষা বা বজায় রাখার অর্থ এই নয় যে, ভারত একটি মাত্র তথাকথিত ‘বন্ধু’ দলকে ক্ষমতায় রাখবে! বারবার এজন্য তাদের জাতীয় ক্ষমতার সবটুকু দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে বাংলাদেশে।

ঝড় আসবে, সন্দেহ দানা বাঁধবে, হুজুগ ডানা মেলবে; কিন্তু এ নিয়ে ভুল সমীকরণ করা চলবে না। বাংলাদেশের মানুষ কখনোই চাইবে না, তাদের সেনাবাহিনী ছিন্নভিন্ন হয়ে যাক। তারা কখনোই মানবে না, কোনো দেশ তাদের সেনাবাহিনীকে নিয়ে খেলাধুলা করুক। তা ভারত হোক, পাকিস্তান হোক বা চীন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে বারবার একনায়কতন্ত্র, স্বৈরশাসন ও সামরিক শাসন উসকে দেওয়ায় ভারতের একটি মহল সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে, যা কখনোই লুকানো যাবে না। একটি মাত্র দলকে ক্ষমতায় রাখতে গিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা, অর্থনীতি, সমাজ ছারখার করা হয়েছে। গণতন্ত্রকে সুযোগ দেওয়া হয়নি।

ভারত গণতান্ত্রিক দেশ। আমরা চেয়ে থাকি ভারতের দিকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জন্য। আমরা তো এটা অবাক বিস্ময়ে দেখি যে, ভারতের সংসদে বিরোধীদলীয় সদস্যরা কীভাবে সরকারদলীয় সদস্যদের তুলোধুনো করেন। এতে কাউকে গুম হতে হয় না, ক্রসফায়ারে পড়তে হয় না। ভারতের সেনাবাহিনী অন্যতম পেশাদার একটা সেনাবাহিনী, যাতে আজ পর্যন্ত রাজনৈতিক শঠতা প্রশ্রয় পায়নি। আমরা তো এটাও দেখি যে, এত জাতি নিয়ে হাজারো সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও ভারত অর্থনৈতিক খাতে এগিয়ে চলেছে। সাম্প্রদায়িকতা থাকলেও রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গ, সরকারি প্রতিটি বিভাগ কার্যকরভাবে কাজ করছে। আমরা এ নিয়েও কৃতজ্ঞ যে, ভারতের বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও অ্যাক্টিভিস্টদের একটি বড় অংশ গত বছর জুলাই আন্দোলনে বাংলাদেশের মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন।

বাংলাদেশের ও ভারতের নিরাপত্তা আন্তঃনির্ভরশীল। ভারতের সঙ্গে তার চিরশত্রু পাকিস্তানের সীমান্ত মাত্র ১৭শ কিলোমিটারের মতো। অথচ বাংলাদেশের সঙ্গে ৪ হাজার কিলোমিটারের বেশি। তাই নিরাপত্তা ইস্যুও বেশি। কিন্তু ভারত যদি কথায় কথায় বাংলাদেশে, বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে আজগুবি সব বিষয় আবিষ্কার বন্ধ করে গণতন্ত্রের সংগ্রামে শরিক হয়, তাহলে নিরাপত্তা সংকট এমনিতেই কেটে যাবে। আর যদি ‘একমাত্র বন্ধু’ তত্ত্ব নিয়ে, প্রাচীনকালের সব ইগো নিয়ে বসে থাকে, তাহলে সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে না।

এতে বাংলাদেশে উলটো ভারতবিরোধিতা বাড়বে, যার দায় ভারতের এসব মিডিয়া অস্বীকার করতে পারে না। আমরা আশা করব, সেনাবাহিনীর মতো সংবেদনশীল প্রতিষ্ঠান নিয়ে ভারতের মিডিয়া সতর্কতার সঙ্গে কথা বলবে। তারা যদি বাংলাদেশিদের গুম, খুন, ক্রসফায়ার, গণতন্ত্রহীনতার জন্য দায়ী কারা, এসব নিয়ে কথা বলে ও তাদের প্রশ্রয় না দেয়, তাহলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি হতে সময় লাগবে না। ‘একমাত্র বন্ধু’ ছেড়ে তাদের সম্পর্কটা করা দরকার বাংলাদেশের সেই ‘বন্ধুর’ হাতে নির্যাতিত জনগণের সঙ্গে।প্রথম আলৈা
আবু রূশদ : সাবেক সেনা কর্মকর্তা; সাংবাদিক, বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নালের সম্পাদক

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions