ডেস্ক রির্পোট:- মিয়ানমারের রাখাইনে দ্রুত নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে জান্তা সরকার। আর মাত্র তিনটি জায়গা তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। গত সোমবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে মিয়ানমার ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ইরাবতি নিউজ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজ্যের রাজধানী শহর সিত্তে, বন্দর নগরী কিয়াউকফিউ এবং বঙ্গোপসাগরীয় দ্বীপাঞ্চল মানাউং জান্তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বাকি ১৪টি শহর দখল করে নিয়েছে আরাকান আর্মি। কোনো একসময় হয়ত আরাকান বা রাখাইন রাজ্য মিয়ানমার থেকে আলাদা একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। সেই রাষ্ট্রে রোহিঙ্গাদের কী অবস্থা হবে তা কিন্তু পরিষ্কার নয়।
২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের আরাকান তথা রাখাইন থেকে জোরপূর্বক তাড়িয়ে দিলে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এর নতুন করে সামরিক সরকার গঠিত হলেও তারা রোহিঙ্গাদের কাছে নেয়নি। সেই জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর জোট এখন সফলতার দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু আরাকান আর্মি বা বিদ্রোহী জোটে রোহিঙ্গাদের নিয়ে স্বস্তি আছে বলে মনে হয়না। এতে করে রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা। তবে আগামী ১৩ মার্চ জাতিসংঘ মহাসচিবের সফর ঘিরে তারা আশাবাদী বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, কিছুদিন বিরতির পর আরাকান আর্মি এখন কিয়াউকফিউয়ের জান্তার নৌ-ঘাঁটিতে হামলা শুরু করেছে। একইসঙ্গে তারা আশপাশের সামরিক ফাঁড়ি এবং পুলিশ ব্যাটালিয়নে আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে। আরাকান আর্মির হামলা শুরু হওয়ার পর থেকেই মিয়ানমারে অশান্তি শুরু হয়। রাজধানীসহ অন্যান্য শহরে ব্যাপক বিক্ষোভ-প্রতিবাদে জড়ো হয় হাজার হাজার মানুষ। সেসব বিক্ষোভ কঠোরভাবে দমন করে সেনাবাহিনী। জান্তা বাহিনীর গুলিতে মৃত্যু হয় শত শত মানুষের। তবে এখানেই তা থেমে যায়নি। বহু জাতিগোষ্ঠীতে বিভক্ত মিয়ানমারে আগে থেকেই জাতিগত উত্তেজনা চলছিল।
রাখাইনের সংখ্যাগরিষ্ঠ রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি অন্যান্য প্রদেশেও জাতিগত সংখ্যালঘুরা শাসনের অধীনে কয়েক বার্মিজ শাসনে বৈষম্যের শিকার হয়েছে। কোনো কোনো প্রদেশে সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহও দেখা গিয়েছিল। তেমন একটি প্রেক্ষাপটে জান্তার ক্ষমতা দখল এবং নির্বিচারে গুলি এসব বিদ্রোহীদের মানুষ দলে দলে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে। জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেয় তারা। মিয়ানমারে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। দেড় বছরের গৃহযুদ্ধে ইতোমধ্যে অনেকগুলো শহরে জান্তা বাহিনীর পতন ঘটেছে। দেশের ৬০ শতাংশের বেশি এলাকা দখল করে নিয়েছে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো।
বিশেষ করে বাংলাদেশ লাগোয়া রাখাইনসহ সীমান্তবর্তী প্রদেশগুলো এখন অনেকটা জান্তার সেনামুক্ত। জান্তা ক্ষমতা গ্রহণের আড়াই বছরের মাথায় অর্থাৎ ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে দেশটির তিন বিদ্রোহী গোষ্ঠী-তাঙ ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ), আরাকান আর্মি (এএ) এবং মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) জোটবদ্ধ হয়। নতুন এই জোট ‘থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়্যান্স’ নামে সামরিক জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। ওই অভিযানের পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন ১০২৭’।
পরবর্তী সময়ে জান্তাবিরোধী এই যুদ্ধে শামিল হয় চিন ন্যাশনাল আর্মি (সিএনএ), চায়নাল্যান্ড ডিফেন্স ফোর্স (সিডিএফ), কাচিন লিবারেশন ডিফেন্স ফোর্স (কেএলডিএফ) এবং সুচির সমর্থক স্বঘোষিত সরকার ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট-এর সশস্ত্র বাহিনী পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ)। এই বিদ্রোহে মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী শক্তির স্বঘোষিত সরকার ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট, জান্তাবিরোধী রাজনৈতিক দল শান স্টেট প্রোগ্রেস পার্টি এবং তাদের সশস্ত্র শাখা বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর প্রতি সমর্থন জানায়।
বিদ্রোহীদের মদদপুষ্ট রাজনৈতিক গোষ্ঠী দ্য ইউনাইটেড ওয়া স্টেট পার্টি (ইউডব্লিউএসপি) ইতোমধ্যেই কয়েকটি প্রদেশে সমান্তরাল সরকার পরিচালনা শুরু করে দিয়েছে। থাইল্যান্ডে নির্বাসিত মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নাগরিকদের পরিচালিত সংবাদমাধ্যম ইরাবতী বিদ্রোহীদের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে কার্যত কোণঠাসা হয়ে পড়েছে জান্তা সরকার। রাজধানী নাইপিদো, প্রধান শহর ইয়াঙ্গন এবং আরো কিছু বড় জনপদ-শিল্পাঞ্চলেই এখন জান্তা বাহিনীর গতিবিধি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। কিন্তু বিদ্রোহী জোট সে এলাকাগুলো সহজে দখল করতে পারবে কিনা, তা নিয়ে সন্দিহান সামরিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মিয়ানমারের রাজধানীসহ বড় জনপদগুলোতে মূলত সংখ্যাগুরু বার্মার জনগোষ্ঠীর বাস। তাদের বড় অংশই জান্তা সরকারের সমর্থক। প্রভাবশালী বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এখনো জান্তার পাশে রয়েছেন। অন্যদিকে, মূলত প্রান্তিক এলাকার জনজাতি গোষ্ঠীগুলো রয়েছে বিদ্রোহীদের জোটে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বড় শহরগুলোর বাইরে কার্যত পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে জান্তা সরকার কতক্ষণ ক্ষমতায় টিকে থাকে সেটাই এখন দেখার বিষয়। অন্যদিকে রাখাইনসহ সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলো যদি সম্পূর্ণভাবে বিদ্রোহীরা দখল করে নেয় তাহলে ভেঙে যেতে পারে মিয়ানমার। স্বাধীন রাখাইন নামে বাংলাদেশের পাশে নতুন একটি দেশ তৈরি হতে পারে।