ডেস্ক রির্পোট:- দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে বেসরকারি বিলাসবহুল নৌযান ‘এমভি রাজারহাট-সি’ আগামীকাল (বুধবার) ঢাকা থেকে বরিশাল হয়ে কোলকাতার উদ্দেশ্যে বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু করছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ‘মেসার্স কার্নিভাল ক্রজ লাইন্স’ ৪০% ছাড় দিয়ে তাদের বিলাসবহুল নৌযানটিতে যাত্রীদের ভ্রমণের সুযোগ দিচ্ছে বলে জানা গেছে ।
বৃটিশ-ভারত যুগে কোলকাতার সাথে বরিশালের সরকারি-বেসরকারি স্টিমার সার্ভিস চালু থাকলেও দেশ বিভাগের পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পাক-ভারত যুদ্ধের আগেরদিন পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ-চাঁদপুর-বরিশাল হয়ে খুলনা পর্যন্ত রকেট স্টিমারের সাথে কোলকাতার শিয়ালদহ পর্যন্ত সংযোগ ট্রেন চালু ছিল। ১৯৭১-এ দেশ স্বাধীনের পরে ’৭২ সালে সম্পাদিত নৌ প্রটোকলে চুক্তির আওতায় ভারত-বাংলাদেশ ও ভারত-বাংলাদেশ-ভারত পণ্যবাহী নৌ যোগাযোগ চালু হলেও যাত্রীবাহী নৌ যোগাযোগ আর চালু হয়নি।
কিন্তু নৌপথে ভ্রমনে দুই দেশের মানুষের বিপুল আগ্রহ থাকলেও যথাযথ উদ্যোগের অভাবে স্বাধীনতার ৫২ বছরেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। অথচ এলক্ষ্যে নৌ প্রটোকলও স্বাক্ষর হয়েছে ইতোপূর্বে।
প্রায় ৭০ বছর পরে দুই দেশের সরকার প্রধানের সিদ্ধান্ত আর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রটোকল অনুযায়ী ২০১৯-এর মার্চে রাষ্ট্রীয় বিআইডিব্লউটিসি তার ‘এমভি মধুমতি’ যাত্রীবাহী নৌযানের সাহায্যে ঢাকা-কোলকাতা রুটে একটি পরিক্ষামূলক পরিচালন সম্পন্ন করলেও পরে আর কোন অগ্রগতি হয়নি। সে নৌযানটি ইতোমধ্যে প্রমোদ ভ্রমনের জন্য বেসরকারি খাতে ভাড়া দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রীয় নৌ-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানটি পরবর্তিতে এ আন্তঃদেশীয় রুটে বাণিজ্যিক যাত্রার কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। অথচ গত কয়েক বছরে কোলকাতা থেকে একাধিক যাত্রীবাহী নৌযানে বেশ কিছু পর্যটক বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে করোনা পূর্বকালীন সময়ে বছরে ২০ লক্ষাধিক যাত্রী যাতায়াত করতো। যার বেশীরভাগই চিকিৎসা ও পর্যটনের জন্যই যাতায়াত করলেও দু দেশের একাধিক স্থলবন্দর দিয়েই ৮০ ভাগেরও বেশী যাত্রী চলাচল করে থাকেন। এছাড়াও ঢাকা থেকে সপ্তাহে ৫ দিন ও খুলনা থেকে দুদিন ট্রেন সার্ভিস চালু রয়েছে। পাশাপাশি প্রতিদিন গড়ে অন্তত ১০টি ফ্লাইটে ঢাকা থেকে কোলকাতা, দিল্লী ও চেন্নাই রুটে বিপুল সংখ্যক যাত্রী ভ্রমণ করছে। করোনা পরিস্থিতির কাক্সিক্ষত উন্নতির পরে দু দেশের মধ্যে যাত্রী চলাচল অনেকটা বাড়লেও সাম্প্রতিক ভিসা জটিলতায় তা কিছুটা শ্লথ হয়ে পড়েছে।
তবে এসব কিছুর পরেও ‘মেসার্স কার্নিভাল ক্রজ লাইন্স’ তাদের ২১০ ফুট দৈর্ঘ্যরে ‘এমভি রাজারহাট-সি’ নৌযানটির মাধ্যমে ২৯ নভেম্বর ভারত-বাংলাদেশ আন্তঃদেশীয় নৌপথে যাত্রী পরিবহন শুরু করছে। সে লক্ষ্যে বিআইডব্লিউটিএ’র কাছে ইতোপূর্বে পেশকৃত প্রস্তাব নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ছাড়াও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাভ করেছে। ইতোমধ্যে সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে পুরো নৌযানটিকে ঢাকা থেকে ৭শ কিলোমিটার দুরের কোলকাতায় যাত্রার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে বলে কার্নিভাল ক্রজ লাইন্স’র পরিচালক ইমরান খান রাসেল ইনকিলাবকে জানিয়েছেন।
কোম্পানীটির পরিচালক জানান, প্রাথমিক অবস্থায় তাদের নৌযানটি মাসে দুটি ট্রিপে যাত্রী নিয়ে কোলকাতায় যাবে এবং ঢাকায় ফিরবে। প্রথম দিকের যাত্রী চাহিদা বিবেচনায় পরবর্তীতে চলাচল আরো বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করার কথাও জানান তিনি। এমনকি বরিশালে যাত্রীদের জন্য একটি কাউন্টারে টিকেট বিক্রি করা হবে। আসা-যাওয়ার পথে নৌযানটি বরিশালে যাত্রীদের ওঠানামার ব্যবস্থা করবে।
আগামীকাল (বুধবার) সকাল ১০টায় ঢাকার হাসনাবাদ কার্নিভাল ফেরিঘাট থেকে ‘এমভি রাজারহাট-সি’ যাত্রা শুরু করে বরিশাল-মোংলা-পুরাতন চালনা-সুন্দরবনের আংটিহারায় ভারত-বাংলাদেশ নৌ চেকপোস্টে কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করে ১ ডিসেম্বর সকালের মধ্যেই কোলকাতার বাবুঘাট পুলিশ জেটিতে পৌছবে। সেখান থেকে ৪ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় ফিরতি যাত্রায় নৌযানটি বাংলাদশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে বলে জানা গেছে।
রিটার্ন টিকেটধারীদের জন্য নৌযানেই থাকার সুবিধা দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি প্রতি যাত্রী মাত্র ৫শ টাকায় ৩ বেলা বুফে খাবারের সুবিধা পাবেন। এর বাইরেও ভিন্ন খাবারও থাকবে। একই সাথে যারা পরিবার নিয়ে এ নৌযানে ভ্রমণ করবেন তাদের সাথে থাকা অনুর্ধ্ব ১০ বছরের দুই বাচ্চার বিনা মাসুলে ভ্রমনের সুযোগ থাকবে।
নৌযানটিতে ঢাকা থেকে কোলকাতার একক পথে ৪০% রেয়াত দিয়ে ভ্রমন কর সমেত সিঙ্গেল স্লিপারের ভাড়া ৬ হাজার টাকা, ডবল স্লিপার ১০ হাজার ২শ’ টাকা, একক শয্যার কক্ষ ১২ হাজার টাকা, দ্বৈত শয্যার কক্ষ ২০ হাজার ৪শ’ টাকা, ফ্যামিলি কেবিন ২৫ হাজার ২শ’ টাকা, ভিআইপি কেবিন ৩০ হাজার টাকা ও প্রিমিয়াম ভিআইপি কেবিন ৫০ হাজার ৪শ’ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান কমোডর আরিফ আহমদ মোস্তফা-বিএন জানান, ‘আমরা আন্তঃদেশীয় এ সার্ভিসটি সুষ্ঠু ও নিরাপদে চলাচলে সব ধরনের ব্যবস্থা করেছি। সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সব কিছু করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। এমনকি ঢাকা থেকে আংটিহারায় বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত ণৈশকালীন চলাচলের লক্ষে নৌ সংকেত ব্যবস্থাও নিশ্চিত করার কথা জানান তিনি।
বাংলাদেশ থেকে ভারতগামী যাত্রীদের একটি বড় অংশই চিকিৎসার জন্য কোলকাতা সহ ভারতের বিভিন্ন শহরে যায় বিধায় তাদের জন্য নৌপথ অত্যন্ত সহনীয় ও আরামদায়ক ভ্রমণ হতে পারে বলে উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে। পাশাপাশি পর্যটনের উদ্দেশে যাতায়াতকরীরাও নৌপথে ভ্রমণকালে সুন্দরবন সহ নদীমাতৃক বাংলাদেশের অপরূপ দৃশ্য দেখতে পাবেন। ভারত থেকে আসা পর্যটকগনও সুন্দরবন ও মোংলা বন্দর সহ বাংলাদেশের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখেতে পাবেন।
নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের অনুমোদিত নকশায় তৈরী ‘এমভি রাজারহাট-সি’ নৌযানটিতে যাত্রীদের আরামদায়ক ভ্রমণের সব ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে বলে এর পরিচালক জানিয়েছেন। কার্নিভাল শিপিং লাইন্স-এর মতে ঢাকা থেকে তাদের নৌযানটি ৩৬ ঘন্টার মধ্যেই কোলকাতায় পৌঁছানো সম্ভব হবে। তবে সে ক্ষেত্রে ভারতীয় নৌপথে রাত্রীকালীন নৌ-সংকেত সুবিধা ছাড়াও দু দেশের সীমান্তে কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন পরিক্ষায় কত সময় ব্যয় হবে তা বিবেচ্য বিষয়। তারা নৌযানটিকে এমনভাবে পরিচালনা করতে চান যাতে, যাত্রীরা দিনের বেলা মোংলা বন্দর সহ সুন্দরবনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। ঢাকা থেকে বরিশাল-মোংলা-কোলকাতা নৌপথটি মোংলা থেকে উত্তরে এগিয়ে চালনা হয়ে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে আংটিহারায় পৌছে বাংলাদেশ অংশে কাস্টম ও ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করবে।
১৮৭৪ সালে এ উপমহাদেশে বাষ্পীয় প্যাডেল হুইল জাহাজে যাত্রী পরিবহন শুরু করেছিল বৃটিশ ‘আইজিএন’ এবং ‘আরএসএন কোম্পানী’। কিন্তু ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরে ’৪৮ সালে ভারত-বাংলাদেশ নৌযোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এর আগে বৃটিশ-ভারতের ঐ কোম্পনী দুটির কয়লা চালিত বাষ্পীয় প্যাডেল হুইল জাহাজের সাহায্যে কোলকাতা থেকে বরিশাল হয়ে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত যাত্রী ও পণ্য পরিবহন হত। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিবারের নৌযানও বরিশাল-কোলকাতা রুটে চলাচল করত। কিন্তু সুন্দরবনের গহীনে তাদের একটি নৌযান ডুবির প্রেক্ষিত তা বন্ধ হয়ে যায়। বৃটিশ ব্যক্তি মালিকানাধীন ‘ফ্লোটিলা নেভিগেশন’র নৌযানও এ নৌপথেই যাত্রী পরিবহন করত দেশ বিভাগের পূর্ব পর্যন্ত।
উল্লেখ্য, গত ১১ জানুয়ারী উত্তর প্রদেশের বারানসী’তে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৫১ দিনে ভারত-বাংলাদেশ ৩ হাজার ২শ’ কিলোমিটার নৌপথ ভ্রমনে ‘এমভি গঙ্গা বিলাস’ নামের একটি প্রমোদ তরীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন। গত ৪ ফেব্রুয়ারি নৌযানটি ভারত-বাংলাদেশের নৌ সীমান্তের আংটিহারা হয়ে মোংলাতে পৌঁছে। ৮ ফেব্রুয়ারি বরিশালে পৌঁছে রাত্রীযাপনের পরে পর্যটকবাহী নৌযনটি পদ্মা-যমুনা পাড়ি দিয়ে আসামের ডিব্রুগড়ে ৫১ দিনের নৌ ভ্রমণ শেষ করে। প্রায় ২শ ফুট লম্বা তিনতলা প্র্রমোদ তরীটি সুইজারল্যান্ড ও জার্মানীর ২৮ জন পর্যটক নিয়ে ভারত-বাংলাদেশের ২৭টি নদী ও ৫০টি পর্যটন কেন্দ্র পরিদর্শন করেছিল। বিশে^র দীর্ঘতম এ নৌ ভ্রমণে খাবার সমেত প্রতি পর্যটকের কাছ থেকে ৫১ দিনে ১২ লাখ ৫৯ হাজার ভারতীয় রূপি বা তৎকালীন ১৬ লাখ টাকারও বেশী ভাড়া আদায় করা হয়। ইনকিলাব