ডেস্ক রির্পোট:- দৃষ্টিনন্দন পূর্বাচল ৩০০ ফিট সড়ক রাতারাতি যেমন দর্শনার্থীদের নজর কেড়েছে ঠিক একই সময়ে সেটি মৃত্যুজোন বা ডেঞ্জার জোনে পরিণত হয়েছে। ছিনতাই, ডাকাতি, সড়ক দুর্ঘটনা সেখানে নিত্যদিনের ঘটনা। মাতাল তরুণ-তরুণীরা বেপরোয়া গতির গাড়ি চালিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। নিজেরা যেমন নিহত হচ্ছে ঠিক তেমনি তাদের কারণে আরও অনেক বাবা-মায়ের কোল খালি হচ্ছে। এসব ছাড়াও মাদকসেবন, অপরাধীরা হত্যা করে লাশ ফেলে রাখার প্রবণতা পূর্বাচলের এই সড়কে বাড়ছে।
যান্ত্রিক কোলাহল থেকে মুক্তি ও মানসিক স্বস্তি পেতে রাজধানীবাসীর পছন্দের এই স্পট শুধু তাদের জন্যই আতঙ্কের হচ্ছে না। এই সড়কের আশেপাশের বাসিন্দারাও এখন রীতিমতো আতঙ্কিত। কারণ তাদের চোখের সামনে প্রায়ই নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। পূর্বাচলে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটায় খোদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও এ নিয়ে মাথাব্যথা রয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত দৃশ্যত কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। শুধুমাত্র নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ ও ঢাকা মহানগর পুলিশের কয়েকটি চেকপোস্টই ওই সড়কে চোখে পড়ে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৩০০ ফিটের ওই সড়কটি চালু হওয়ার পর থেকেই দর্শনার্থীদের নজর কাড়ে। পাশাপাশি অপরাধীরাও সড়কটিকে তাদের সকল অবৈধ ও বেআইনি কর্মকাণ্ডের নিরাপদ স্পট হিসেবে নিয়েছেন। প্রায়ই সড়কটিতে মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন স্থানীয়রা। অন্য কোথাও হত্যা করে এখানে মরদেহ রেখে চলে যাচ্ছে। আবার অনেক সময় এই সড়কের নিরাপদ জায়গায়ও হত্যাকাণ্ড ঘটছে। রাতের বেলা এই সড়কটিতে দ্রুত গতিতে স্পোর্টস কার রেসিং করে অভিজাত ঘরের ছেলেমেয়েরা। এ ছাড়া অত্যাধুনিক মডেলের মোটরসাইকেল বা স্পোর্টস মোটরসাইকেল দিয়েও অনেকে দল বেঁধে গতির লড়াই করে। এদের গতিসীমা ১০০ কিলোমিটারের বেশি থাকে। চেকপোস্টে দায়িত্ব পালন করেছেন এমন পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যারাই বিভিন্ন অপরাধ ও বেপরোয়া গতির সঙ্গে জড়িত তাদের অধিকাংশই রাতের বেলা মাদকাসক্ত থাকে। বিভিন্ন বার থেকে মদ খেয়ে তারা এই সড়কে এসে গতির লড়াই করে। এ ছাড়া এলএসডি, কুষ, পার্টিড্রাগসহ নানা ধরনের ড্রাগ সেবন করে তারা রাতের বেলা রেসিং করে। এতে তারা নিজেরা যেমন বিপদগ্রস্ত হয় ঠিক তেমনি তাদের কারণে অন্যরা বিপদে পড়ে। এ ছাড়া রাতের বেলা অপরূপ দৃষ্টিনন্দিত হওয়াতে এই সড়কে টিকটকার, কন্টেন ক্রিয়েটরসহ আরও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ যত্রতত্র গাড়ি থামিয়ে ছবি তোলা, ভিডিও করে। এতে এই সড়ক দিয়ে চলাচলকারী অন্য যাত্রী ও যানবাহনও বিপদের সম্মুখীন হয়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, এই সড়কে বেআইনি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বেশির ভাগই প্রভাবশালী ব্যক্তির সন্তান। বিভিন্ন কারণে চেকপোস্টে তাদের আটকানো হলে সঙ্গে সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে ফোন আসে। তাই এসব সন্তানদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায় না। উল্টো চাকরি নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। তারা মূলত শহরের বিভিন্ন এলাকা ও আশেপাশের জেলা থেকে রাতের বেলা নীলা মার্কেটে আড্ডা ও খাওয়া-দাওয়া করতে আসে।
সড়ক ও দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৩০০ ফিট সড়কে স্পিড মিটার বসাতে হবে এবং গতিসীমা বেঁধে দিতে হবে। নজরদারি করে যারাই গতিসীমা লঙ্ঘন করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
সূত্রগুলো বলছে, শুধু ২০২৪ সালেই পূর্বাচল ৩০০ ফুট সড়কে নিহত হয়েছে ১২ জন। আর পাঁচ বছরে এই সড়কে মৃত্যুর সংখ্যা শতাধিক। অন্যদিকে গত তিনদিনে নিহত হয়েছে পাঁচজন। এ ছাড়া গত আট বছরে পূর্বাচলে মিলেছে ২১ জনের লাশ। তাদের বেশির ভাগই হত্যার শিকার। সর্বশেষ ১৯শে ডিসেম্বর রাতে প্রাইভেটকারের ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী বুয়েটের ছাত্র মুহতাসিম মাসুদ নিহত হয়েছেন। এর আগে, এই সড়কে গত ১৭ই ডিসেম্বর সুজনা ও তার বন্ধু কাব্য মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হন। ১৮ই ডিসেম্বর ভূঁইয়া বাড়ি সেতুর সামনে মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে শিপন ও রউফ নামে দুজন নিহত হন। গত ৮ই ডিসেম্বর ৩০০ ফুট সড়কে মুরগি বহনকারী একটি গাড়ির ধাক্কায় সাকিবুল হাসান সাকিব নামে এক মাদ্রাসাছাত্র নিহত হয়। ২০শে নভেম্বর কুড়িল-কাঞ্চন সেতুর সুলপিনা ভূঁইয়া বাড়ি ব্রিজে আব্দুর রহিম (২৬) নামে এক মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হয়। ২৬শে জানুয়ারি মোটরসাইকেল ও ট্রাকের সংঘর্ষে বংশাল এলাকার বাসিন্দা মো. সজীব হোসেন ও মো. রাহাত নামে ২ জন মারা যান।
নীলা মার্কেটে এলাকার স্থানীয় মেহেদী হাসান জিয়া বলেন, সড়কটি দৃষ্টিনন্দন হওয়ায় সড়কের দুইপাশে অসংখ্য খাবার হোটেল হয়েছে। তাই অনেক দূর-দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা আসেন। সেইসঙ্গে অনেক টিকটকার গ্রুপ আসে। তারা দল বেঁধে আসে বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল চালিয়ে। অনেক সময় রাস্তার মাঝখানে বাইক থামিয়ে ভিডিও এবং ছবি তোলেন তখন পেছন থেকে অন্য গাড়ি এসে ধাক্কা দেয়। আমরা এই সড়কে ফ্যামিলি নিয়ে আসতে ভয় পাই, নিরাপদে দাঁড়াতেই পারি না সবসময় আতঙ্কে থাকি যদি গাড়ি এসে আমাদের ধাক্কা দেয়। তিনি বলেন, পুলিশ যদি নিয়মিত তদারকি করে, স্পিড গান ব্যবহার করে মামলা দেয়, কোনো ক্ষেত্রে শাস্তি প্রয়োগ করে তাহলে অনেকাংশে দুর্ঘটনা এড়ানো যাবে।
বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা রবিন বলেন, এ সড়কে রাতের মায়াবী দৃশ্য বিমোহিত করে নগরবাসীকে। তাই পূর্বাচলের ৩০০ ফিট সড়কের সৌন্দর্য দেখতে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গা থেকে ছুটে আসেন অনেকে। তরুণ বাইকাররা কোনো নির্দেশনা মানতে চায় না তারা বেপরোয়া গতিতে বাইক চালান। এই কারণে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। মস্তুল এলাকার রাকিব বলেন, রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই রাস্তায় যানবাহনের চাপ কমে যাওয়ায় একসঙ্গে ১৫ থেকে ২০ জন বাইকার দল বেঁধে আসে। তারা উচ্চ গতিতে মোটরসাইকেল চালান এবং স্ট্যান্টবাজি করে এই কারণে প্রতিনিয়তই দুর্ঘটনা ঘটছে। এ আই ইউ বি এর শিক্ষার্থী মো. আকরাম বলেন, রাতে বড়লোকের দুলালেরা কার নিয়ে আসে। তারা প্রতিযোগিতা করে গভীর রাতে। কার এবং বাইক রেস করে। তাছাড়া অনেকে মদ্যপান করে গাড়ি চালান তাই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। বিশেষ করে ছুটির দিনে অনেক মানুষ আসে তারা রাস্তায় এলোমেলোভাবে বাইক পার্কিং করে রাখেন। এই কারণে প্রতিদিনই দুর্ঘটনা ঘটছে।
নারায়ণগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার বলেন, আমাদের চেকপোস্ট বসানো থাকে। ভবিষ্যতে আমরা নীলা মার্কেট খোলা রাখার একটা সময়সীমা বেঁধে দিবো। এটা সারারাত খোলা থাকে। যখন খুশি মানুষ উচ্ছৃঙ্খল ভাবে আসা- যাওয়া করে। তিনি বলেন, ৩০০ ফিটে মানুষ যায় নীলা মার্কেটের জন্য। এজন্য আমরা রাত ১২টা পর্যন্ত সময় বেঁধে দিবো। কারণ এগুলো সারারাত খোলা থাকার কারণে কেউ মদ খেয়ে যায়, কেউ নাচতে নাচতে যায়, কেউ বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে যায়। এখানে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধ ঘটে। বেপরোয়া গতির বিষয়ে তিনি বলেন, যখন মানুষ নেশাগ্রস্ত থাকে তখন বেপরোয়া গতি দেয়। যারা উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করে তারাই বেপরোয়া হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) খন্দকার নজমুল হাসান বলেন, ৩০০ ফিটে আমাদের ক্রাইম ডিভিশন চেকপোস্ট বসায়। কয়েকদিন আগে বুয়েটের শিক্ষার্থীর ঘটনাটা চেকপোস্টেই হয়েছে। মাতাল হয়ে মেরেছে। রাতের বেলা বিষয়গুলো ক্রাইম ডিভিশন দেখে। দিনে ট্রাফিক পুলিশও থাকে। টিকটক, ছবি তোলাসহ বিভিন্ন কারণে দুর্ঘটনা ঘটার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে। তারপরেও এসব হচ্ছে। আর যারা ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে তারা সবাই শিক্ষিত ছেলেমেয়ে। সবাই সচেতন পরিবারের সন্তান। তবে আইন প্রয়োগ করে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে। সচেতনতা দরকার। রাতের বেলা প্রবেশপথ ছাড়া ট্রাফিক পুলিশ রাখা সম্ভব হয় না। আর ওয়ানওয়ে রোড হওয়াতে ট্রাফিক পুলিশের প্রয়োজনও পড়ে না। তিনি বলেন, চেকপোস্টে অনেক সময় বিভিন্ন অপরাধের জন্য অনেককে ধরা হয়। তখন আরও সমস্যা হয়। বিভিন্ন স্থান থেকে তদবির আসে। চাপ প্রয়োগ করে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিডেন্ট রিচার্স ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ বলেন, ৩০০ ফিটে লম্বা একটা সেকশন। এখানে ওভার স্পিডিং বেশি হয়। সন্ধ্যার পর গাড়ি কমে যায়। তাই যানবাহনে গতি বেড়ে যায়। দ্রুত গতির কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। তাই সেখানে স্পিড কমানোর জন্য স্পিড ক্যামেরা বসিয়ে অ্যাকশন নিতে হবে। যারাই গতিসীমার চেয়ে ওভার স্পিড করবে তাদেরকে মামলার আওতায় আনতে হবে। এ ছাড়া সিসি ক্যামেরা দিয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে। পুলিশের তৎপরতা আরও বাড়াতে হবে। মানবজমিন