ডেস্ক রির্পোট:- বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অনেক অপ্রয়োজনীয় উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। যেগুলোর বেশিরভাগই যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই প্রভাবশালীদের চাহিদার ভিত্তিতে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া, অলাভজনক ও অগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। দীর্ঘদিন ধরে যাচাই-বাছাই শেষে অবশেষে অনুমোদিত এসব প্রকল্প বাতিল শুরু হচ্ছে। এরই মধ্যে একনেক সভায় অনুমোদিত একটি প্রকল্প বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) কার্যতালিকা সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২৩ ডিসেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের ৫ম একনেক সভা অনুষ্ঠিত হবে। সভায় সভাপতিত্ব করবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা একনেক চেয়ারপারসন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ওই সভায় আগে অনুমোদিত একটি প্রকল্প বাতিলের প্রস্তাব করেছে পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ।
জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের ৫ম একনেক সভায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মোট ১৫টি প্রকল্প প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে। এর মধ্যে আটটি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য এবং পরিকল্পনা উপদেষ্টা কর্তৃক অনুমোদিত ছয়টি প্রকল্প প্রস্তাব একনেক সভাকে অবহিত করার জন্য উপস্থাপন করা হবে। বাকি একটি অনুমোদিত প্রকল্প বাতিলের জন্য প্রস্তাব করা হবে।
একনেক সূত্র জানায়, মৌলভীবাজারের লাঠিটিলা বনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক শীর্ষক প্রকল্পটি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত প্রকল্পটি গত বছরের নভেম্বরে একনেকে অনুমোদন দেওয়া হয়। যদিও লাঠিটিলা বনটি সংরক্ষিত হওয়ায় সেখানে সাফারি পার্ক স্থাপনের বিরোধিতা করে ছিলেন পরিবেশবাদীরা। কিন্তু তাদের আপত্তি উপেক্ষা করে সাফারি পার্ক স্থাপনের জন্য নেওয়া প্রকল্প একনেকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।
পরিবেশবাদীদের দাবি ছিল, বনের মধ্যে এ ধরনের সাফারি পার্ক নির্মিত হলে তা হবে প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য আত্মঘাতী ও সর্বনাশা প্রকল্প। বন ধ্বংসের এমন উদ্যোগে উদ্বেগ প্রকাশ করে লাঠিটিলা সংরক্ষিত বনে সাফারি পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা বাতিলেরও দাবি জানিয়েছিলেন তারা। কিন্তু তাদের আপত্তি উপেক্ষা করে প্রকল্পটি অনুমোদন দেয় সরকার। লাঠিটিলা বনের ৫ হাজার ৬৩১ একর জায়গায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে খরচ ধরা হয় ৩৬৪ কোটি ১১ লাখ টাকা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, গত বছর পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ভেঙে পাহাড় ও গাছ কেটে তৎকালীন পরিবেশমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের নিজের নির্বাচনী এলাকায় বন ধ্বংসের এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ কারণে পরিবেশবাদীদের আপত্তি উপেক্ষা করে প্রকল্পটি অনুমোদন দেয় সরকার। তবে সরকার পরিবর্তনের পর পাল্টে যায় দৃশ্যপট। প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত নেয় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। এজন্য গঠন করা হয় চার সদস্যের একটি কমিটি।
সংরক্ষিত লাঠিটিলা অভয়ারণ্যে সাফারি পার্ক নির্মাণে বনাঞ্চলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে—এমন কথা উল্লেখ করে প্রকল্পটি বাতিলের সুপারিশ করে যাচাই কমিটি। কমিটির প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে লাঠিটিলায় সংরক্ষিত বনে সাফারি পার্ক স্থাপন প্রকল্পের অনুমোদন বাতিলের সুপারিশ করে পরিবেশ ও বন ও মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে অনুমোদিত প্রকল্পটি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় পরিকল্পনা কমিশন। তার পরিপ্রেক্ষিতে একনেক সভায় দেশের তৃতীয় সাফারি পার্ক স্থাপন প্রকল্পটি বাতিলের প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হলেও তখন বেশ কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। শর্ত প্রতিপালন করে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সংশোধন করে পুনর্গঠন করে পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে পরবর্তীতে পুনর্গঠিত ডিপিপি পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় উদ্যোগী মন্ত্রণালয় প্রকল্পটি বাতিলের সুপারিশ করে। সে অনুযায়ী প্রকল্প বাতিলের পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং বাতিলের জন্য একনেক সভায় প্রস্তাব করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শুধু এই প্রকল্প না বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া, অলাভজনক ও অগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাতিল করতে যাচ্ছে সরকার। যেগুলো বাতিলের পাশাপাশি অর্থায়ন স্থগিত অথবা ব্যয় কাটছাঁট করা হবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইতোমধ্যে প্রায় ৪০টি প্রকল্প বাতিল অথবা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যেগুলো ধারাবাহিকভাবে বাতিলের পাশাপাশি স্থগিত রাখার প্রস্তাব করা হবে।
এর আগে গত ১৯ আগস্ট পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া এবং কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের তালিকা করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। ওই নির্দেশনার পর বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের এ ধরনের প্রকল্পের তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়। বাতিল অথবা স্থগিতের তালিকায় থাকা প্রকল্পগুলোর কোনোটির কাজ মাঝামাঝি পর্যায়ে, কোনোটির কাজ মাত্র শুরু হয়েছে, কোনোটির কাজ এখনো শুরু হয়নি।
কর্মকর্তারা বলছেন, বাতিল অথবা স্থগিতের তালিকায় প্রকল্পের সংখ্যা আরও বাড়বে। তারা জানান, বিগত সরকারের সময়ে নেওয়া প্রকল্প তিনটি দিক বিবেচনা করে বাতিল করা হচ্ছে। প্রকল্পটি কতটা মানুষের প্রয়োজনে নেওয়া হয়েছে, প্রকল্প থেকে রিটার্ন কেমন আসবে এবং প্রকল্পটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কি না সে বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেওয়া প্রকল্পগুলো বাতিল হবে।
বাতিলের অপেক্ষায় থাকা প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে, সুনামগঞ্জ জেলার সঙ্গে নেত্রকোনার সড়ক যোগাযোগ স্থাপনে হাওরে উড়াল সড়ক নির্মাণের প্রকল্প। সাবেক রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের আগ্রহে নেওয়া প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৩ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের এক সভায় প্রকল্পটি বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়। কারণ হিসেবে বলা হয়, হাওরে উড়াল সড়ক নির্মিত হলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব পড়বে।
ফরিদপুর টেপাখোলা পার্ক স্থাপন প্রকল্পটিও বাতিল হচ্ছে। সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন মন্ত্রী থাকার সময় নিজ নির্বাচনী এলাকায় পার্কটি নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ২০১৮ সালে নেওয়া প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয় ১৮০ কোটি টাকা। যদিও প্রকল্পটির কাজ এখনো শুরু হয়নি। এর অর্থায়নও স্থগিত হচ্ছে। সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের নির্বাচনী এলাকার জন্য মেহেরপুরে মেরিটাইম ইনস্টিটিউট নির্মাণের প্রকল্পটি বাতিল হচ্ছে।
এ ছাড়া, নেত্রকোনায় শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়, যশোরে শেখ জহুরুল হক পল্লী উন্নয়ন একাডেমি, খুলনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার এবং বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের জন্য ছয়টি ছাদখোলা ট্যুরিস্ট বাস সংগ্রহ প্রকল্প স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এই প্রকল্পগুলোর মধ্যে যেগুলোর মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে সেগুলোর সময় না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, পাশাপাশি বাস্তবায়নে মেয়াদ থাকলেও কিছু প্রকল্পও স্থগিত করা হচ্ছে। বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা। এরই মধ্যে প্রকল্পগুলোর পেছনে খরচ হয়েছে প্রায় ৬৭৪ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রশ্নবিদ্ধ প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হওয়ার আগেই সমাপ্ত করায় প্রায় ২ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।
ঢাকার হেমায়েতপুর থেকে আফতাবনগর হয়ে দাশেরকান্দি পর্যন্ত মেট্রোরেলের সাউদার্ন রুট প্রকল্প (এমআরটি লাইন-৫) আপাতত বাদ রাখছে সরকার। এর বদলে সরকার গাবতলী থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত মেট্রোরেল (লাইন-২) নির্মাণে জোর দিচ্ছে। সংসদ সদস্যদের পছন্দ অনুযায়ী গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণের প্রকল্পটিও বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কাজে না লাগায় দুর্যোগকালে মানুষের আশ্রয়ের জন্য দেশের বিভিন্ন জেলায় ৫৫০টি মুজিব কিল্লা (আশ্রয়কেন্দ্র) নির্মাণকাজটি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এ ছাড়া, ৩০টি সাইলো নির্মাণ, মুজিব কিল্লা, বজ্রনিরোধক দণ্ড বসানো, ১২টি আধুনিক তথ্য কমপ্লেক্স, ডিজিটাল সংযোগ স্থাপন, পল্লী সড়কে গুরুত্বপূর্ণ সেতু, ঢাকা বিভাগে উপজেলা ও ইউনিয়নে সড়ক, আমার গ্রাম-আমার শহর, রংপুর সিটি করপোরেশন উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পগুলো বাতিল হচ্ছে। বাতিল অথবা বরাদ্দ কাটছাঁটের তালিকায় থাকা বাকি প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে তিন জেলায় (ফেনী, চাঁদপুর ও টাঙ্গাইল) কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট নির্মাণ, ১২ জেলায় হাইটেক পার্ক, ডিজিটাল সংযোগ স্থাপন, মোবাইল গেম অ্যাপ্লিকেশন, শেখ হাসিনা ইনস্টিটিউট অব ফ্রন্টিয়ার এবং প্রান্তিক পর্যায়ে উন্নয়ন প্রচার। এ ছাড়া, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও সাবেক সাবেক সংসদ সদস্য সাজ্জাদুল হাসানের নির্বাচনী এলাকা নেওয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নের দুটি প্রকল্প বাতিল হচ্ছে বলে জানা গেছে।
আগামী সোমবার অনুষ্ঠিতব্য ৫ম একনেক সভায় অনুমোদনের জন্য নতুন ও সংশোধিতসহ উপস্থাপন করা হবে, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ৬০টি ডে-কেয়ার সেটার স্থাপন প্রকল্প, চিলমারী এলাকায় নদীবন্দর নির্মাণ এবং আশুগঞ্জ পলাশ সবুজ প্রকল্প, ‘অর্থনৈতিকভাবে জীবনচক্র হারানো রাবার গাছ কর্তন, পুনঃবাগান সৃজন ও রাবার প্রক্রিয়াকরণ আধুনিকায়ন’ প্রকল্প, ‘রশিদপুর-১১ নং কূপ (অনুসন্ধান রূপ) খনন’, ‘২ডি সাইসমিক সার্ভে ওভার এক্সপ্লোরেশন ব্লক ৭ অ্যান্ড ৯’ প্রকল্প, ‘ভোলা নর্থ গ্যাস ক্ষেত্রের জন্য ৬০ এমএমএসসিএফরি ক্ষমতাসম্পন্ন প্রসেস প্ল্যান্ট সংগ্রহ ও স্থাপন’ প্রকল্প এবং ‘কুমিল্লা অঞ্চলে টেকসই কৃষি প্রযুক্তি সম্প্রসারণ’ প্রকল্প।কালবেলা