ডেস্ক রির্পোট:- বর্ষীয়ান নেতা। ২০০৮ থেকে ২০২২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ফরিদপুর-২ আসনের টানা সংসদ সদস্য। তিনি সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী; ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। যশ-খ্যাতি কিছুরই কমতি ছিল না। কিন্তু মায়ের বিপরীত চরিত্র দুই ছেলে– আয়মন আকবর চৌধুরী বাবলু ও শাহদাব আকবর চৌধুরী লাবু। সাজেদার রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে তারা গড়েছেন অঢেল সম্পদ। দেশে গাড়ি-বাড়ি-ব্যবসা সবই রয়েছে। বিপুল অর্থ লগ্নি করে সম্পদ গড়েছেন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায়। এলাকায় প্রভাব ধরে রাখতে ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাদের নিয়ে করেন ‘মামা বাহিনী’। এ বাহিনীর মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক কারবারসহ নিয়ন্ত্রণ করেছেন অপরাধ জগৎ। সাজেদার নির্বাচনী এলাকা ফরিদপুরের নগরকান্দা ও সালথা উপজেলায় দুই ভাই-ই ছিলেন সর্বেসর্বা, যেন অঘোষিত এমপি।
২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। পরে আরও তিনবার দলটি ক্ষমতায় আসে। তবে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতন হয় শেখ হাসিনার সরকারের। দ্বাদশ সংসদের মেয়াদ ছিল মাত্র আট মাস। স্থানীয় সূত্রের দাবি, ২০০৮ সালে সাজেদা চৌধুরী এমপি হওয়ার পর তাঁর বড় ছেলে বাবলু চৌধুরী এলাকায় গডফাদার বনে যান। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। এক পর্যায়ে ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী আন্দোলন গড়ে তুললে এলাকা ছাড়েন বাবলু। তাঁর জায়গা দখলে নেন ছোট ভাই লাবু চৌধুরী। তাঁর বিরুদ্ধেও অনিয়ম-দুর্নীতির এন্তার অভিযোগ। মাকে পুঁজি করে গাড়ি-বাড়িসহ অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন লাবুও।
দুর্ধর্ষ ‘মামা বাহিনী’
বাবলু চৌধুরীকে বলা হয় ফরিদপুরের ত্রাস। ২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনি সালথা ও নগরকান্দা নিয়ন্ত্রণ করেছেন। স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মী দিয়ে গড়ে তোলেন সন্ত্রাসী ‘মামা বাহিনী’। এ বাহিনীর নেতৃত্ব দেন সালথা উপজেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বাদল হোসেন।
তাঁর কাছে বাবলুর একাধিক আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে বলে জানা গেছে। বাবলু চৌধুরীর মাদক কারবারও নিয়ন্ত্রণ করতেন বাদল। এলাকায় তাঁকে শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে সবাই চেনেন। বাদলের বিরুদ্ধে একাধিক হত্যাসহ ডজনখানেক মামলা রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, বাবলু চৌধুরীর প্রশ্রয়ে বাদলও শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন। ৫ আগস্টের পর থেকে তিনি পলাতক।
মামা বাহিনীর মাধ্যমে বাবলু চৌধুরী দলীয় ও বিএনপির নেতাকর্মী এবং সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন চালাতেন। বিরুদ্ধে গেলেই হাতুড়িপেটা করে হাত-পা ভেঙে দিত বাহিনীর সদস্যরা। বাড়িঘর পর্যন্ত গুঁড়িয়ে দিত। বাবলুর নির্দেশে শত শত মানুষকে নির্যাতন ও হাজারো বসতঘর ধ্বংস করা হয়েছে। তাঁর বাহিনীর হাত থেকে রেহাই পাননি স্থানীয় সাংবাদিকরাও। সালথা প্রেস ক্লাবের তৎকালীন সভাপতি সেলিম মোল্যা ও সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নাহিদকে নির্যাতন এবং মামলা দিয়ে টানা তিন বছর এলাকাছাড়া করেন। সাংবাদিক আবু নাসের হুসাইন ও এম কিউ বুলবুলকেও মারধর করে মামা বাহিনী। পুলিশ-প্রশাসনও ভয়ে বাবলুর কথাতেই ওঠবস করত।
অভিযোগ রয়েছে, টানা ১০ বছর মায়ের ক্ষমতাবলে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ, সরকারি দপ্তরের কমিশন বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, টিআর-কাবিখা ও ত্রাণের প্রকল্প হরিলুট করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়েছেন বাবলু। ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্যের মাধ্যমে পকেটে ভরেছেন বিপুল অর্থ। এমনকি অসুস্থ মা সাজেদা চৌধুরীর বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সরকারি সুবিধার অর্থ তুলে নিজে নিয়েছেন। ঢাকার বনানীতে আটতলা বাড়িসহ দেশ-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন বাবলু।
দলীয় নেতাকর্মীর আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালে বাবলু এলাকা ছাড়লে দায়িত্ব পান লাবু চৌধুরী। ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত তিনিও ছিলেন স্বঘোষিত এমপি। ২০২২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সাজেদা চৌধুরীর মৃত্যুতে শূন্য আসনের উপনির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন লাবু। বড় ভাইয়ের মতো তিনিও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন মামা বাহিনীতে। গত ৭ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনেও বিজয়ী হন লাবু। তবে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন বলে জানা গেছে। এর পর তাঁর নামে হত্যাসহ দুটি মামলা হয়েছে।
ভাইয়ের মতো লাবুও টানা ছয় বছর সালথা-নগরকান্দার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে কোটিপতি বনে গেছেন। লাবুর ঢাকার ধানমন্ডিতে দুটি ফ্ল্যাট, উত্তরায় আট কাঠাসহ জমি, বিদেশে বাড়ি-গাড়িসহ বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে বলে জানা গেছে।
দুই ভাইয়ের বিষয়ে সালথা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মিয়া বলেন, ‘১৪ বছর সালথা-নগরকান্দায় অপরাধের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন বাবলু ও লাবু চৌধুরী। তারা আমার বড় ভাই উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি দেলোয়ার হোসেন মিয়া ও আমাকে সবচেয়ে বেশি নির্যাতন করেছেন। জনসমাবেশে সাজেদা চৌধুরীর উপস্থিতিতে ভাইকে পিটিয়ে জখম করে তাদের সন্ত্রাসী বাহিনী। কমপক্ষে ১০টি মিথ্যা মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠায়। অসুস্থ মাকে পুঁজি করে দুই ভাই শত শত কোটি টাকা কামিয়েছেন।’
নগরকান্দা উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শওকত আলী শরিফ বলেন, ‘বছরের পর বছর সাজেদা চৌধুরীর সন্তানরা আমাদের হাজারো নেতাকর্মীকে মিথ্যা মামলায় এলাকাছাড়া করেছেন। সরকারের কাছে দুই ভাইয়ের অবৈধ সম্পদ জব্দ ও তাদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।’
সালথা উপজেলা বিএনপির সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান তালুকদার বলেন, ‘মামা বাহিনী দিয়ে এমন কোনো অত্যাচার-নির্যাতন নেই, যা তারা দুই ভাই করেননি। আমার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ২৯টি মামলা দিয়েছে। তারা জনগণের জন্য রাজনীতি করেননি; মায়ের ক্ষমতা খাটিয়ে লুটপাটই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।’সমকাল