মোঃ নজরুল ইসলাম, এনডিসি:- কার্ল মার্কস বলেছিলেন, ‘একটি সভ্য সমাজে সবচেয়ে বড় সামাজিক উপাদান হলো নিরাপত্তা।’ তবে তারও আগে বৃটিশ জেনারেল ও রাজনীতিবিদ অলিভার ক্রমওয়েল নিরাপত্তার গুরুত্বকে মহিমান্বিত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘জানি না মৃত্যুর পরে স্রষ্টার সামনে দাঁড়িয়ে কী বলব! আমি কি বলতে পারব যে, একজন কনস্টেবল রাত জেগে মানুষকে যে শান্তি দেয়, আমি তা দিতে পেরেছি?’
ঠিক একই সুরে কথা বলেছেন সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবারও। তিনি পুলিশের কাজকে মহিমান্বিত দৃষ্টিতে দেখেছেন। পুলিশকে বলেছেন ‘স্রষ্টার প্রতিনিধি’ (representative of God)। জীবনের কঠিন মুহূর্তে মানুষ যখন অসহায় অনুভব করে, তখন যে পুলিশ তার পাশে দাঁড়ায় এবং অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, মানুষ তাকে স্রষ্টার প্রতিনিধিই মনে করে।
সমাজবিজ্ঞানীদের এ উপলব্ধি ধর্মতত্ত্বের সঙ্গেও মিলে যায়। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ নিজেকে ‘সালামুল মু’মিনুল মুহাইমিনুল’ (শান্তিদাতা, নিরাপত্তাদাতা, রক্ষক) হিসেবে প্রকাশ করেছেন। বাইবেল, তোরাহ এবং বেদ-পুরাণেও মহান স্রষ্টার মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়ার কথা উল্লেখ আছে।
হিন্দু ধর্মগ্রন্থে বিষ্ণুকে রক্ষাকর্তা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মেও শান্তি এবং নিরাপত্তার ওপর স্ব-স্ব স্রষ্টার আদর্শ অনুশীলনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সমস্ত ধর্মতত্ত্বেই স্রষ্টা, ও ধর্মগুরুদের মহান বৈশিষ্ট্যসমূহ অনুশীলনের ওপরও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
মানুষের সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্য অন্যান্য প্রাণীর থেকে পৃথক। ধর্মগ্রন্থ অনুসারে, মহান আল্লাহ এ পৃথিবীতে তার প্রতিনিধিকে বিশেষ কিছু গুণ দিয়েছেন। তবে সৃষ্টিগতভাবেই মানুষের কিছু দুর্বলতাও রয়েছে। সেটা কাটিয়ে সঠিকপথে জীবনযাপনের নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহ এবং সেজন্য বিশেষ দায়িত্বও দিয়েছেন। আল্লাহ বলেছেন, ‘মানুষকে হত্যা করা বা পৃথিবীতে নৈরাজ্য সৃষ্টি ছাড়া যে ব্যক্তি কাউকে হত্যা করল, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করল। আর যে কারও প্রাণ বাঁচাল, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে বাঁচাল।’
প্রত্যেক মানুষের নিরাপত্তার জন্য দায়িত্বরত পুলিশ যেন আল্লাহ প্রদত্ত সেই নির্দেশই পালন করে। পবিত্র কোরআনে ১০৭টি আয়াতে মানুষের জন্য শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার কাজকে মহিমান্বিত করা হয়েছে।
ইবন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘দুটো চোখকে কখনও দোজখের আগুন স্পর্শ করবে না। এক, যে চোখ আল্লাহর ভয়ে কাঁদে, আর দুই, যে চোখ আল্লাহর পথে পাহারায় বিনিদ্র রাত যাপন করে।’
রাত জেগে পথঘাটে টহল দিয়ে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পুলিশের এ আবহমান দায়িত্বকে পার্থিব অনেক দায়িত্বের সঙ্গে মেলানো যায় না। পুলিশ আরও অনেক দায়িত্ব পালন করে। তবে ধর্মতত্ত্ব এবং সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে আরও অন্তত একটি দায়িত্ব অতীব মহত্ত্বপূর্ণ।
মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বারবার সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। পুলিশ আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে। অপরাধ উদঘাটনে সত্য স্বাক্ষ্য সংগ্রহ এবং আদালতে উপস্থাপনও ন্যায়বিচারের একটি বড় অংশ।
আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, ‘হে ঈমানদারগণ! ন্যায়ের প্রতি সুপ্রতিষ্ঠিত থাকো এবং আল্লাহর জন্য সত্য সাক্ষ্যদাতা হও, যদিও তা তোমাদের নিজেদের, মাতা-পিতা বা আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে যায়। কেউ ধনী হোক বা গরীব, আল্লাহ উভয়েরই ঘনিষ্ঠতর। অতএব, প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না, যাতে তোমরা ন্যায়বিচার করতে পার। আর যদি তোমরা তথ্য বিকৃত করো বা সত্যকে এড়িয়ে যাও, তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে অবহিত।’
সত্য স্বাক্ষ্য সংগ্রহ এবং অপরাধীদের বিচারের আওতায় এনে পুলিশ সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে। ধর্মতত্ত্বের দিক থেকে পুলিশের এ ভূমিকাও অতি গুরুত্বপূর্ণ।
বস্তুত, নানা প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার জন্য মানুষ শুরু থেকেই সংগ্রাম করে আসছে। সুপ্রাচীনকাল থেকে মানুষকে সুরক্ষা দেওয়া, জননিরাপত্তা, ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালন করছে একশ্রেণীর মানুষ। রাষ্ট্র এবং পুলিশের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হওয়ার আগে পাড়া-মহল্লার অশান্তি, অনাচার ও অনিরাপত্তা দূর করতে কিছু মানুষ নিজ দায়িত্বে শান্তি রক্ষার ভূমিকা পালন করেছে।
বৃহৎ বঙ্গেও মণ্ডল, মাঝি, মাহাতো, পঞ্চায়েত, বাইশি, পরগানাইত, কূলকার, গণ প্রভৃতি উপাধির মানুষ সমাজের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতেন। রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালু হওয়ার পরও নিরাপত্তা প্রদানের এ দায়িত্ব অব্যাহত থাকে। শুক্রাচার্যের লেখা ‘শুক্রনীতি’তে রাজার মোটা আট দায়িত্বের কথা উল্লেখ আছে। তার মধ্যে প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব ছিল জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
বৈদিক যুগেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ঋগবেদে বলা হয়েছে, ‘গোপা জনস্য,’ অর্থাৎ রাজা হলেন প্রজার রক্ষক। মনুসংহিতায়ও প্রজার নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ রাজার সমালোচনা করা হয়েছে। মহাভারতেও জননিরাপত্তার গুরুত্ব পাওয়া যায়। ব্রাহ্মণের গরু চুরির সংবাদ পেয়ে ভীমের ছুটে যাওয়ার ঘটনা এরই প্রমাণ।
জৈন শাসনামলেও রাজা এবং আইন প্রয়োগকারীর পদবী ছিল অভিন্ন — ‘যক্ষ’। এতে বোঝা যায়, জননিরাপত্তা প্রদানকারীদেরকে রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে সম্মানিত করা হতো।
ইসলামী খেলাফতেও জননিরাপত্তাকে বিশেষভাবে মহিমান্বিত দায়িত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মদিনা রাষ্ট্রে নৈতিক চরিত্র এত উন্নত ছিল যে, পুলিশের প্রয়োজনীয়তা ছিল না। হযরত ওমর (রা.) নিজে রাজ্যের বাসিন্দাদের নিরাপত্তা তদারকি করতেন এবং হঠাৎ করে নৈশ টহলে বের হতেন। হযরত আলী (রা.) এবং খলিফা হারুন অর রশীদের সময়েও এই রীতি বজায় ছিল।
মুঘল আমলেও জননিরাপত্তার গুরুত্ব অপরিসীম ছিল। শহুরে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান চরিত্র ছিলেন কোতোয়াল। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান আজও কোতোয়ালী নামে পরিচিত। এছাড়া মফস্বলে অসংখ্য স্থানের নাম কসবা বা কুসবা, যেগুলো ছিল জেলা পর্যায়ের পুলিশ স্থাপনা।
যুগে যুগেই এভাবে অনিরাপদ ও ভয়ার্ত মানুষের মনে নিরাপত্তাবোধ জাগানো হয়েছে। অশ্রুসজল চোখের পাশেই চওড়া হাসি ফুটে উঠেছে। এমন উপভোগ্য দৃশ্যের চেয়ে আর কিছুই সুন্দর হয় না।
আজ আমরা এক যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। বাংলাদেশের অনেক কিছুই সংস্কার হচ্ছে, যার মধ্যে পুলিশের সংস্কারও চলছে। একটি বড় ধরনের বিচ্যুতি ও বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা চলমান। এ মুহূর্তে প্রয়োজন পুলিশের মহান অঙ্গীকার, শিক্ষা এবং দীক্ষা স্মরণ করা।
তবে কিছু পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালনে গাফিলতি করছে। জনশৃঙ্খলা ব্যাহত হচ্ছে, অথচ কিছু পুলিশ সদস্য নির্বিকার থাকছে; এটা শুধু অগ্রহণযোগ্য নয়, এটি অন্যায়। প্রত্যেক পুলিশ সদস্যকে উপলব্ধি করতে হবে, তাদের দায়িত্ব কেবল চাকরি নয়; এর সঙ্গে মানুষের নিরাপত্তা প্রদানের মহান ও পবিত্র অঙ্গীকার জড়িয়ে আছে।
মহানবী (সা.)-এর একটি বাণী পুলিশের জন্য অবিস্মরণীয়: ‘তোমাদের মধ্যে যে অন্যায় দেখবে, সে যেন তা হাত দিয়ে বাধা দেয়। আর যদি হাত দিয়ে বাধা দিতে না পারে, তবে যেন মুখ দিয়ে বাধা দেয়। আর যদি মুখ দিয়ে বাধা দিতে না পারে, তবে যেন অন্তর দিয়ে বাধা দেয়। আর এটি দুর্বল ঈমানের পরিচয়।’
পুলিশের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া। ধর্মীয় দৃষ্টিতে এটি ফরজে আইন। পুলিশ সদস্যরা শপথ নিয়ে চাকরিতে প্রবেশ করেছেন মানুষের নিরাপত্তা প্রদানের জন্য। যদি তারা এই পবিত্র অঙ্গীকার ভুলে যান, তাহলে তাদেরকে সমাজ, রাষ্ট্র এবং মহান স্রষ্টার কাছে জবাবদিহি করতে হবে নিশ্চয়ই।
সুদীর্ঘকাল ধরে সমাজতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব, রাজকর্ম, কিংবা আইনগতভাবে জননিরাপত্তার যে মহৎ আদর্শ লালিত হয়েছে, তা বৃটিশ উপনিবেশিক পুলিশী ব্যবস্থায় ব্যাপকভাবে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। বৃটিশ ঔপনিবেশিক আইনে এবং প্রশিক্ষণে আইন প্রয়োগকারীদের কাজকে শক্তিপ্রয়োগের ক্ষমতাসম্পন্ন হিসেবে দেখানো হয়েছে। প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে তাদের শেখানো হয়েছে, যেন তারা কেবল শক্তিপ্রয়োগকারী একটি যন্ত্র।
সমাজবিজ্ঞানীরা যে মহিমান্বিত দায়িত্ব হিসেবে জননিরাপত্তার ধারণা দিয়েছেন, ধর্মতত্ত্বে যে পবিত্র এবং স্বর্গীয় দায়িত্ব হিসেবে দেখানো হয়েছে, রাজকর্মে যে সর্বোচ্চ অঙ্গীকার হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, তা এ ঔপনিবেশিক আইনে প্রতিফলিত হয়নি। বরং এ আইনের মাধ্যমে শোষণ, নিপীড়নের ‘ক্ষমতা’ এবং শক্তিপ্রয়োগের দর্শন পুলিশের মননে স্থায়ীভাবে গেঁথে গেছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এ দেশের পুলিশ এ প্রত্যয় ও দর্শনের মধ্যে আটকে রয়েছে।
আলবার্ট বান্দুরা এবং বার্কোভিচসহ অনেকের সামাজিক শিক্ষণ তত্ত্ব এ প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ। তাদের মতে, মানুষ পারিপার্শ্বিকতা থেকে যা দেখে ও শেখে, তা চেতন এবং অবচেতনভাবে আত্মস্থ করে। পরে, প্রায়োগিক ক্ষেত্রে সেই শেখারই পুনরাবৃত্তি ঘটে।
এটি গভীরভাবে উপলব্ধি করার বিষয় যে, পুলিশ কেবল আইন প্রয়োগকারী শক্তিপ্রয়োগকারী কোনো যন্ত্র নয়। তাদের ভেতরে সুকুমার গুণাবলী ও নৈতিক সত্ত্বার বিকাশের প্রয়োজন আছে।
আইন ও শক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাদের কাছে অপরাধ দমন ও প্রতিরোধ কেবল একটি কাজ নয়, বরং এটি সমাজসেবার একটি অংশ। মানুষের মৌলিক ও মানবাধিকার নিশ্চিত করা, আসামি গ্রেপ্তার, স্বাক্ষ্য সংগ্রহ ও উপস্থাপন — এসব কেবল আইনি দায়িত্ব নয়; এ দায়িত্বকে স্বর্গীয় হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।
পুলিশকে এ দায়িত্ব পালনে অনুপ্রাণিত করতে, তাদের মধ্যে স্রষ্টার প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করার মনোভাব জাগাতে নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। এ জন্য সঠিক প্রশিক্ষণ ও শিক্ষণ জরুরি।
লেখক,মোঃ নজরুল ইসলাম, এনডিসি: গবেষক, ডিআইজি, এপিবিএন, পার্বত্য জেলা সমূহের কার্যালয়, রাঙ্গামাটি