খাগড়াছড়ি, দীঘিনালা ও রাঙ্গামাটিতে ১৮, ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলার উপর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিবেদন

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় শনিবার, ৫ অক্টোবর, ২০২৪
  • ১৩৩ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- গত ১৮-১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ খাগড়াছড়ি সদরে ও দীঘিনালায় এবং ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ রাঙ্গামাটি সদরে বিশেষ মহলের সহযোগিতায় সেটেলার বাঙালিরা পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ কার্যালয়সহ জুম্ম জনগণের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা ও জুম্মদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে ও ঘরবাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা সংঘটিত করেছে। উক্ত সাম্প্রদায়িক হামলায় ৪ জন জুম্ম নিহত হয়েছে (সেটেলার বাঙালি কর্তৃক দীঘিনালায় একজন জুম্ম, খাগড়াছড়ি সদরে সেনাবাহিনীর গুলিতে ২ জন জুম্ম এবং রাঙ্গামাটি সদরে সেটেলার বাঙালি কর্তৃক একজন জুম্ম)। এছাড়া এই সাম্প্রদায়িক হামলায় শতাধিক জুম্ম আহত হয়েছে, অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত ও লুণ্ঠিত হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ কার্যালয়সহ শতাধিক ঘরবাড়ি ও দোকানপাট।

ঘটনার সূত্রপাত:

গত ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, মো: মামুন (৪০) নামের এক সেটেলার বাঙালি খাগড়াছড়ি সদরের মধুপুর এলাকা থেকে গোল্ডি চাকমা (৪৫) নামে এক ব্যক্তির মোটরবাইকটি চুরি করে দ্রুত চালিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে রাস্তার পাশের একটি বৈদ্যুতিক খুঁটির সাথে ধাক্কা খেয়ে ওই চোর মো: মামুন বাইক থেকে পড়ে যায় এবং গুরুতর আহত হয়। তখনই আশেপাশের বাঙালি ও জুম্ম জনতা এসে “চোর, চোর” বলে মো: মামুনকে মারধর করে। মারধরের ফলে মামুন বেহুঁচ হয়ে যায়। পরে মামুনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।

পুলিশ ও একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, নিহত বাইকচোর মো: মামুন একজন মূলত পেশাধার চোর। তার বিরুদ্ধে থানায় ১৭টি মামলা চলমান রয়েছে। তন্মধ্যে ১৪টি হচ্ছে চুরির মামলা, ৩টি মাদক সংক্রান্ত মামলা। এছাড়া ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে মৃত মামুনের স্ত্রী মুক্তা আক্তার কর্তৃক খাগড়াছড়ি সদর থানায় দায়েরকৃত হত্যা মামলায়ও মুক্তা আক্তার প্রধান আসামী হিসেবে ১। মো: শাকিল (২৭), পিতা- আব্দুল মান্নান, শালবন (শাপলার মোড়), খাগড়াছড়ি সদর; ২। রফিকুল আলম (৫৫), পিতা মৃত ওবায়দুল হক, পানখাইয়া পাড়া, খাগড়াছড়ি সদর; ও ৩। দিদারুল আলম (৫০) পিতা মৃত ওবায়দুল হক, পানখাইয়া পাড়া প্রমুখ তিনজন সেটেলার বাঙালির নাম উল্লেখ করেছেন।

মো: মামুনের মৃত্যুর পরপরই সেটেলার বাঙালিরা সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে প্রচার করতে থাকে যে জুম্মরাই পরিকল্পিতভাবে মামুনকে মেরে ফেলেছে। এভাবে অপপ্রচার চালিয়ে ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি সদরের মধুপুরে হামলার চেষ্টা করে। এরপর ১৯ সেপ্টেম্বর দীঘিনালা ও খাগড়াছড়ি এবং ২০ সেপ্টেম্বর রাঙ্গামাটিতে সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো হয়।

খাগড়াছড়ি সদরের মধুপুরে হামলার চেষ্টা:

মো: মামুনের মৃত্যুর পর অপপ্রচার চালিয়ে ১৮ সেপ্টেম্বরের সন্ধ্যার পর থেকে সেটেলার বাঙালিরা খাগড়াছড়ি শহরের মধুপুরে জুম্মদের ঘরবাড়িতে হামলার চেষ্টা করে। এসময় হাসপাতাল ও শালবন এলাকা থেকে শত শত সেটেলার বাঙালি এসে মধুপুরে হামলার চেষ্টা করে। তবে জুম্মদের সংঘবদ্ধ প্রতিরোধের ফলে সেটেলার বাঙালিরা এক পর্যায়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়।

দীঘিনালায় হামলা:

গত ১৯ সেপ্টেম্বর বিকাল ৪:০০ টার দিকে বাঙালি ছাত্র পরিষদের ব্যানারে সেটেলার বাঙালিরা সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে দীঘিনালা উপজেলা সদরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশের শেষদিকে সেটেলার বাঙালিরা দীঘিনালা সদরে জুম্মদের উপর লাঠিসোটা ও ইটপাটকেল দিয়ে হামলা করে। এ সময় সেটেলার বাঙালিদের নিক্ষিপ্ত ইট-পাটকেল রিপুয়ে চাকমা নামে একজন জুম্মের কপালে আঘাত করে।

এসময় আশেপাশের জুম্মরা “উজো উজো” বলে আক্রান্তদের বাঁচাতে এগিয়ে আসলে সেটেলার বাঙালিরা পিছু হটে। সেটেলার বাঙালিরা যখন পিছু হটতে থাকে তখনি সেনাবাহিনীর একটি দল সেখানে আসে এবং জুম্মদের ধাওয়া করে তাড়িয়ে দেয়। সেনা সদস্যরা জুম্মদেরকে বলে যে, “তোমরা চলে যাও, কিচ্ছু হবে না। আমরা আছি। তোমরা এখানে থাকলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠবে।”

জুম্মরা চলে যাওয়ার কয়েক মিনিট পরেই সেটেলার বাঙালিরা আবার দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে দীঘিনালা সদরে হামলা চালাতে আসে। এসময় বিকাল আনুমানিক ৫:০০ টার দিকে সেটেলার বাঙালিরা সেনাবাহিনীর চোখের সামনেই বটতলার লারমা স্কোয়ার স্টেশন বাজারে অগ্নিসংযোগ করে। এতে জুম্মদের অন্তত ৫২টি দোকান ও বাড়ি এবং ২৪টি মোটরবাইক ও অটোরিক্সা ভস্মীভূত হয়। এ হামলায় কমপক্ষে ৫ কোটি টাকার সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসময় সেনাবাহিনীকে নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়।

এরপর সেটেলার বাঙালিরা দীঘিনালা সদরের কলেজ টিলা ও বাবু পাড়ায় হামলার চেষ্টা করে। সেসময় জুম্ম গ্রামবাসীরা সংঘবদ্ধ হয়ে সেটেলার বাঙালিদের প্রতিরোধ করে। এভাবে প্রায় রাত ৯:০০ টা পর্যন্ত জুম্মদের উপর সেটেলার বাঙালিরা হামলা ও অগ্নিসংযোগের চেষ্টা চালিয়ে থাকে।

এ হামলায় মাইনী ব্রিজ এলাকায় দীঘিনালা সদরের উদোলবাগানের হান্দারা চাকমার ছেলে ধন রঞ্জন চাকমা (৫২) নামে এক জুম্ম গুরুতর আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ধন রঞ্জন চাকমার হাত ও পায়ের রগ কেটে দেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। দীঘিনালায় সেটেলারদের হামলায় এবং সেনাবাহিনীর লাঠিপেটায় কমপক্ষে ৪ জন জুম্ম আহত হয়।

খাগড়াছড়ি সদরে গুলি বর্ষণ:

দীঘিনালায় হামলার প্রতিবাদে এবং জুম্ম গ্রামগুলোর সুরক্ষার জন্য ১৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা আনুমানিক ৬:৩০ টার দিকে খাগড়াছড়ি সদরের স্বনির্ভর, নারানখেয়্যা এলাকায় একদল আদিবাসী জুম্ম ছাত্র-যুবক জড়ো হতে থাকে। এসময় সেখানে সেনাবাহিনীর একাধিক দল উপস্থিত হয়। এরপর ইউপিডিএফরা গাছবান ও পেরাছড়া থেকে একদল ছাত্র-যুবককে অনন্ত মাষ্টার পাড়া সুরক্ষার জন্য পাঠিয়ে দেয়। উক্ত ছাত্র-যুবকদের সাথে সেনাবাহিনী মুখোমুখী হয় এবং সামান্য দূর থেকে উভয়ের মধ্যে বাকবিতন্ডা ও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।

পৌনে ১১:০০ টার দিকে ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে সেনাবাহিনীর একটি গাড়ি স্বনির্ভর এলাকার দিকে যাচ্ছিল। পাছবান ও পেরাছড়া থেকে আসা ছাত্র-যুবকরা সেনাবাহিনী সেই গাড়িটি রাস্তায় অবরোধ করে। সেনাবাহিনীর সাথে বাক-বিতন্ডায় জড়িয়ে পড়ে। জুম্ম ছাত্ররা কান্তা-গুলতি ব্যবহার করে। এক পর্যায়ে সেনাবাহিনী সেখানে গুলিবর্ষণ করে। এসময় সেনাবাহিনীর গুলিতে কমপক্ষে ২০ জুম্ম ছাত্র-যুবক আহত হয়। ছাত্রদের কারো কারো পেটে, হাটুতে, পায়ে গুলি লেগে গুরুতর আহত হয়। আহতদের মধ্যে গুরুতর আহত একজন চট্টগ্রামে স্থানান্তর করা হয়েছে।

তাদের মধ্যে স্বনির্ভর এলাকায় সেনাবাহিনীর গুলিতে ২ জন নিহত হয়। নিহত ২ ব্যক্তি হলেন- ১. জুনান চাকমা (২০), পীং- রুপায়ন চাকমা, ঠিকানা- জামতলা, খাগড়াছড়ি সদর, তিনি পানছড়ি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। ২. রুবেল ত্রিপুরা (৩০), পিতা: গর্গজ মনি ত্রিপুরা, ঠিকানা- পল্টনজয় পাড়া, পেরাছড়া ইউপি, খাগড়াছড়ি সদর।

রাঙ্গামাটি সদরে হামলা:

২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ সকাল ১০:০০ টার দিকে, রাঙ্গামাটি জেলা সদরে সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আদিবাসী জুম্ম ছাত্র-যুবকের উদ্যোগে ১৯ সেপ্টেম্বরের দীঘিনালা-খাগড়াছড়িতে জুম্মদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি রাঙ্গামাটি জিমনেসিয়াম প্রাঙ্গণ থেকে শুরু হয়ে যখন রাজবাড়ী পেট্রোল পাম্প এলাকায় পৌঁছে, তখন একদল উত্তেজিত মিছিলকারী কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার গাড়ি ভাঙ্গার চেষ্টা করে। মিছিলটি হ্যাপী মোড়ে পৌঁছলে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন বাঙালিকে ধাওয়া করে মিছিলকারীরা। মিছিলটি যখন বনরূপা পেট্রোল পাম্প এলাকায় পৌঁছে, তখন প্রথমে বনরূপা বিলাস বিপনী নামক দোকানের পাশ থেকে এবং পরে দোকানের ছাদ থেকে একজন সেটেলার কর্তৃক পাহাড়ি ছাত্রদের মিছিলে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে থাকে। এতে মিছিলকারীরা উত্তেজিত হয়ে বাঙালিদের উদ্দেশ্যে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। এতে মিছিলকারী ছাত্রদের সাথে বাঙালিদের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়।

এরপর সেটেলার বাঙালিরা বনরূপায় জুম্মদের বসতবাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে। সেটেলার বাঙালিরা সেভরন ও মেডিনেট ক্লিনিকে, বিজন সরণী এলাকায় জুম্মদের বিভিন্ন দোকানপাটে, জনসংহতি সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কার্যালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে। অন্যদিকে কাঠালতলীস্থ ঐতিহ্যবাহী মৈত্রী বিহারে হামলা ও ভাঙচুর এবং তবলছড়িস্থ আনন্দ বিহারে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। মৈত্রী বিহারের গেইট ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে সেটেলাররা বুদ্ধমুর্তি, আসবাবপত্র ও দানবাক্স ভেঙ্গে ফেলে। মৈত্রী বিহার থেকে ৭টি দানবাক্স, মাসিক চাঁদা ৯০ হাজার টাকা, ১০টি বুদ্ধমূর্তি ও ল্যাপটপ লুট করে নিয়ে যায় সেটেলাররা। আনন্দ বিহারে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে বিহারের জানালার কাঁচ ভেঙ্গে দেয় ও বুদ্ধমুর্তির উপর আঘাত করে। সেটেলার বাঙালিরা হাসপাতাল এলাকা ও টিএন্ডটি এলাকায় জুম্মদের ঘরবাড়িতে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে।

রাঙ্গামাটিতে সেটেলার বাঙালিরা পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ কার্যালয়ে ও বিশ্রামাগারে হামলা চালিয়ে সরকারি সম্পত্তি ক্ষতিসাধন করে। এসময় হামলাকারীরা আঞ্চলিক পরিষদের ১টি পিকআপ, ৫টি পাজেরো, ব্যক্তিগত ২টি গাড়ি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের ১টি পাজেরো ও ১টি পিকআপে অগ্নিসংযোগ করে। এছাড়া আঞ্চলিক পরিষদের বিল্ডিংয়ে অগ্নিসংযোগ করে থাকে। আগুন জ্বলতে থাকার সময় সেনাবাহিনীর একটি দল আঞ্চলিক পরিষদে গেইটে অবস্থান নেয়। এসময় আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি আসলে সেটেলাররা আগুন নেভাতে বাধা দেয়। পুড়ে অংগার হয়ে যাওয়ার পরই ফায়ার ব্রিগেডকে আগুন নেভাতে অনুমতি দেয়।

বনরূপা ও কালিন্দীপুরে হামলায় এক জুম্ম যুবক নিহত এবং প্রায় শতাধিক জুম্ম আহত হয়। তন্মধ্যে হাসপাতালে আহত ২৭ জন জুম্ম, রাজবন বিহার হাসপাতালে ২৫ ও ঘরে ঘরে ২৮ জন জুম্ম চিকিৎসা নিয়েছে বলে জানা গেছে। আহতদের মধ্যে গুরুতর জখম হওয়ায় ২ জনকে চট্টগ্রামে প্রেরণ করা হয়। মৈত্রী বিহারে ভাঙচুর ও লুটপাটসহ জুম্মদের ২৪টি ঘরবাড়ি, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও দোকানে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। এতে প্রায় ৫ কোটি টাকার সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে জানা যায়।

নিহত ব্যক্তি হলেন অনিক কুমার চাকমা (১৮), পীং- আদর সেন চাকমা, গ্রাম- নোয়া আদাম, মগবান ইউনিয়ন, রাঙ্গামাটি সদর উপজেলা। তিনি কাপ্তাই কর্ণফুলী সরকারি ডিগ্রি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক ১ম বর্ষের ছাত্র। তিনি নিউ মার্কেট সংলগ্ন কালিন্দীপুর সড়কে সেটেলার বাঙালিদের হামলায় নিহত হন। তাকে লাঠিসোটা নিয়ে আঘাত করতে করতে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। হামলা ও অগ্নিসংযোগের পর রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।

উল্লেখ্য যে, সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলনের রাঙ্গামাটির মিছিলে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফের দুই শতাধিক ছাত্র যুবক অংশগ্রহণ করেছে বলে জানা গেছে। জেলা শিক্ষা অফিসের সামনে পৌঁছলে অন্যান্য শ্লোগানের সাথে “পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন কর, করতে হবে” শ্লোগানটি তুলে ধরলে অধিকাংশ ছাত্র “বাস্তবায়ন কর, করতে হবে” বললেও ইউপিডিএফের সেই ছাত্র-যুবকরা “ভূয়া, ভূয়া” বলে চিৎকার করে। মিছিলটি জিমনেসিয়াম প্রাঙ্গণ থেকে শুরু হয়ে শিল্পকলা একাডেমীর কাছে পৌঁছলে সেখান থেকে প্রায় ২০০ জন অপরিচিত ছাত্র-যুবক মিছিলে সামিল হয়, যাদেরকে সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলনের সংগঠকরা চিনেন না বলে জানিয়েছেন।

অন্যদিকে মিছিলটি ডেপুটি কমিশনারের কার্যালয় পর্যন্ত প্রদক্ষিণ করে আবার জিমনেসিয়াম প্রাঙ্গণে ফিরে আসার কথা থাকলেও সেসব অপরিচিত ইউপিডিএফ ছাত্র-যুবকরা জোর করে মিছিলটি বনরূপায় দিকে এগিয়ে নেয়। এরপর হ্যাপী মোড়ে পৌঁছলে সেই যুবকরা বাঙালিদেরকে ধাওয়া করে। অপরদিকে বনরূপায় পেট্রোল পাম্পে মিছিলটি পৌঁছতে না পৌছতেই দোকানের ছাদের উপর থেকে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করলে সেসব অপরিচিত ছাত্র-যুবকরা মিছিল থেকে পাল্টা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে পরিস্থিতিকে উত্তেজিত করে তোলে।

ঘটনার সাথে পিসিপি’র নাম জড়িয়ে আইএসপিআরের বিবৃতি:

গত ১৯ সেপ্টেম্বর ও ২০ সেপ্টেম্বর, যথাক্রমে খাগড়াছড়িতে ও রাঙ্গামাটিতে জুম্মদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনার সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) নাম জড়িয়ে ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ আইএসপিআর এক বিবৃতি প্রকাশ করে। আইএসপিআরের উক্ত বিবৃতিতে রাঙ্গামাটিতে সাধারণ জুম্ম শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সংঘটিত ঘটনায় পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ এর উপর দায় চাপিয়ে দেয়ার হীন চেষ্টা চালানো হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে দুই দিনব্যাপী সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলা ও আইএসপিআর এর বক্তব্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। পিসিপির প্রতিবাদে বলা হয় যে, আইএসপিআরের বক্তব্য সাম্প্রদায়িক, দায়িত্বহীন, একপেশে ও উস্কানিমূলক। উক্ত কর্মসূচিতে পিসিপি’র কোন সম্পৃক্ততা ছিল না। বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার হীন উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে জুম্মদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা সংগঠিত করা হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করার জন্য সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর অপতৎপরতায় এধরনের সাম্প্রদায়িক হামলা সংগঠিত হচ্ছে বলে পিসিপি মনে করে। পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ দুই দিনব্যাপী সংঘটিত ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে এসে শাস্তি প্রদানসহ অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছে।

উপসংহার:

পার্বত্য চট্টগ্রামে এ ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা নতুন কিছু নয়। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর বিশেষ মহলের পৃষ্টপোষকতায় এবারের সাম্প্রদায়িক হামলাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে ২১টি সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে। এ ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করা এবং সে লক্ষ্যে জুম্মদের অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা, জুম্মদের ভূমি জবরদখল করা, তাদের চিরায়ত জায়গা-জমি থেকে উচ্ছেদ করা, সর্বোপরি জুম্মদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করা।

এখানে আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, ২০শে সেপ্টেম্বর আইএসপিআরের দেয়া বিবৃতিতে “খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে চলমান উত্তেজনা তিন পার্বত্য জেলায় ভয়াবহ দাঙ্গায় রূপ নিতে পারে” বলে বলা হয়েছে। আইএসপিআরের এই বক্তব্য অনেকটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগাম প্রচারণার সামিল, যা দাঙ্গাকারীদের দাঙ্গা সংঘটনে উস্কে দেয়ার ষড়যন্ত্র বলে বিবেচনা করা হয়। আইএসপিআরের মতো একটি দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ এভাবে কখনোই ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগাম প্রচারণা চালাতে পারে না। এটা অনেকটা মানুষের মনে ভীতি ও ত্রাস সৃষ্টির সামিল বলে গণ্য করা যেতে পারে।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার প্রকৃত রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের ক্ষেত্রে ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্যেই পার্বত্য সমস্যার সমাধানের সূত্র নিহিত রয়েছে। তাই আসুন, আপামর জুম্ম জনগণ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বৃহত্তর আন্দোলনে সামিল হই।

সুপারিশমালা:

১। ১৯-২০ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি, দীঘিনালা ও রাঙ্গামাটিতে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার বিভাগীয় তদন্তের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

২। নিহত ও আহত ব্যক্তি এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সরকারের তরফ থেকে যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসা প্রদান করা।

৩। খাগড়াছড়ি, দীঘিনালা, রাঙ্গামাটি সাম্প্রদায়িক হামলায় জড়িত ব্যক্তিদেরকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা। প্রেস বিজ্ঞপ্তি

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.net
Website Design By Kidarkar It solutions