ডেস্ক রির্পোট:- ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আলোচনায় এসেছে রাষ্ট্র সংস্কার ইস্যু। দীর্ঘ ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠানসহ গুরুত্বপূর্ণ সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। বিশেষ করে নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করা, জনপ্রশাসন ও পুলিশকে দলীয়করণ, দুর্নীতি, বিচার ব্যবস্থায় নগ্ন হস্তক্ষেপ ছিল ব্যাপক হারে। সংবিধানকে করেছে কাটাছেঁড়া। ভেঙে পড়েছে রাষ্ট্রীয় কাঠামো। এমতাবস্থায় নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। তারই প্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস উপলক্ষ্যে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে সংস্কারের লক্ষ্যে ৬টি কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন প্রধান উপদেষ্টা। সেগুলো হলো- ড. বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, সফর রাজ হোসেনের নেতৃত্বে পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন, বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমানের নেতৃত্বে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, ড. ইফতেখারুজ্জামানের নেতৃত্বে দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন, আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, প্রফেসর আলী রিয়াজের নেতৃত্বে সংবিধান সংস্কার কমিশন।
যদিও সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে শুরুতে ড. শাহদীন মালিকের নাম ঘোষণা করা হয়েছিল। বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে তাদের এ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এদিকে যারা এ কমিশনে থাকছেন তারা সবাই সম্পূর্ণ অবৈতনিক হিসেবে কাজ করবেন বলে জানা গেছে। কেউ কোনো ধরনের বেতন ভোগ করবেন না। এ বিষয়ে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমাকে বলা হয়েছে সম্পূর্ণ অবৈতনিক। তাই আমি গ্রহণ করেছি। অন্যথায় এ দায়িত্ব নিতাম না। গঠিত ৬টি কমিশনের আগামী মঙ্গলবার থেকে কাজ শুরু করার কথা রয়েছে। পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে সংস্কারের সুপারিশ তারা সরকারের কাছে উপস্থাপন করবেন। সেই সুপারিশ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার কথা। তবে সংস্কার কাজ শুরু আর মাত্র একদিন বাকি থাকলেও এখনো দৃশ্যত কোনো কাজ দেখা যাচ্ছে না। বিশেষ করে কমিশনের প্রধান ছাড়া অন্য কোনো সদস্য এখনো যুক্ত করা হয়নি। প্রধান উপদেষ্টা জানিয়েছিলেন, এসব কমিশনের অন্য সদস্যদের নাম কমিশন প্রধানদের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করা হবে। কমিশনগুলোর আলোচনা ও পরামর্শ সভায় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, ছাত্র-শ্রমিক-জনতা আন্দোলনের প্রতিনিধি, নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন। কবে নাগাদ কমিশনের অন্য সদস্যদের যুক্ত করা হবে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্যও পাওয়া যায়নি।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর নুরুল আমিন বেপারী বলেন, ৬টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। আমি মনে করি সংস্কার কমিশনকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সংস্কারের রূপরেখা দেয়া উচিত। তাহলে এটি টেকসই হবে। অন্যদিকে সংবিধানের বিষয়েও কথা হচ্ছে পুনর্লিখন না সংস্কার এসব বিষয়ে। পুনর্লিখন করতে হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিতে হবে। কারণ তারা না চাইলে এটি নির্বাচিত সরকার সংসদে পাস করবে না। নতুন সংবিধান কিন্তু সংসদে পাস করতে হবে। এ ছাড়াও এ কমিশনগুলোর মধ্যে কেউ কেউ শুরুতে বিতর্ক তৈরি করে ফেলেছেন। যেমন একজন বলেছেন, আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচন বৈধতা হবে না। তিনি বলবেন তবে বলার একটা স্পেস আছে। এখন না। তখন আলাপ আলোচনার মধ্যদিয়ে আসতে হবে যে কীভাবে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে আসবে। খুব বুদ্ধি খাটিয়ে কথা বলতে হবে। তাদের কথার অনেক মূল্য আছে। গত ১৯শে সেপ্টেম্বর ৬ কমিশন প্রধানদের নিয়ে বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সরকারের ৪ জন উপদেষ্টা ও তার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম। বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, জনপ্রশাসন এবং সংবিধান সংস্কারে যে ৬টি কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে, তারা ১লা অক্টোবর থেকে কাজ শুরু করবেন। কাজ শেষে ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে বলে আশা করছে সরকার।
তারপর দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংস্কারের ধারণা নিয়ে আলোচনা শুরু করবে। তারপর এ নিয়ে পরামর্শমূলক মতবিনিময় করা হবে; যেখানে সমাজের সব পর্যায়ের মানুষের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। তবে কী কী বিষয়ে সংস্কার আনা হবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটির জন্যই কমিশন। তারা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে কী কী সংস্কার করা দরকার। তবে এসব কমিশন নিয়ে কিছুটা অস্বস্তিতে রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। বিশেষ করে সংবিধান সংস্কার কমিশন নিয়ে আপত্তি দেখা গেছে বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির। ২১শে সেপ্টেম্বর দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সংবিধানের আমূল পরিবর্তন বা নতুন সংবিধানের জন্য জনগণের নির্বাচিত সংসদই শ্রেয়। সংবিধান সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তার জন্য উচিত ছিল বিপ্লবী সরকার করা। সেটি হয়নি। এই সংবিধানের অধীনে শপথ না নেয়া। সেটা তো হয়নি। সংবিধানের অধীনেই তো শপথ নিয়েছে। তাহলে ওই জিনিসটাকে (বর্তমান সংবিধান) সামনে রেখে সেভাবে (সংশোধন) করতে হবে। আমরা নিজেরাই দল থেকে উদ্যোগ নিচ্ছি, সংবিধানের কী কী পরিবর্তন হতে পারে, সেই কাজ শুরু করেছি। তিনি বলেন, সংবিধান পরিবর্তন করতে হলে আগে মানুষের কাছে যেতে হবে, তারা কীভাবে সংবিধানের পরিবর্তনটা চায়। আরেকটা বিষয় আছে, আমি-আপনি-আমরা কয়েকজন এক্সপার্ট মিলে করে দিলাম, সেটা একটা। কিন্তু সংবিধানের আমূল পরিবর্তন বা নতুন সংবিধান করতে হলে আপনাকে গণপরিষদ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জনমতের বিষয়টি তো আছেই, তারপরে আইনগত দিকগুলোও দেখতে হবে। আমূল পরিবর্তনের জন্য জনগণের ‘ম্যান্ডেট’ সবচেয়ে নিরাপদ। এদিকে দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান একটি বিদেশি গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমি যতটুকু বুঝতে পারছি, এই কমিশনের কাজ হবে দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করা বা এটাকে কার্যকর করা। আমার নিজের অভিজ্ঞতা, গবেষণালব্ধ জ্ঞান এবং গুড প্যাকটিস যেগুলো আছে, সেগুলোকে বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশের প্রেক্ষিত বিবেচনায় নিয়ে কাজ করতে হবে। ২০০৪ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন গঠিত হয়েছে।
দুদক নিয়ে মানুষের যে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির বিশাল ঘাটতি, সেটি বিবেচনায় নিয়ে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের যে আমলাতান্ত্রিক প্রেক্ষিত, সেটি বিবেচনায় রেখে এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলনের যে মূলমন্ত্র, রাষ্ট সংস্কারে সেটিও বিবেচনায় রাখতে হবে। কমিশনে যাদের সদস্য করা হবে, তাদের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা একটি সুপারিশ করার চেষ্টা করবো। দুদককে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন যাতে ঘটে, সেটা মাথায় রেখেই কাজ করতে হবে। এভাবে আমরা কাজটা শুরু করতে চাই। অন্যদিকে সম্প্রতি জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে সংস্কার কাজ দীর্ঘ হতে পারে জানিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, নির্বাচনী ব্যবস্থার সব দিক নিয়ে আমরা পর্যালোচনা করবো এবং তার ভিত্তিতে সুপারিশ প্রণয়ন করবো। এটা বাস্তবায়নের দায়িত্ব আমাদের নয়। ৯০ দিন আমাদের সময় দেয়া হয়েছে।মানবজমিন