কোটাবিরোধী আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা,তথ্য লুকানোর চেষ্টা মামলায়

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় শনিবার, ৩ আগস্ট, ২০২৪
  • ৯৭ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সহিংসতা ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে যারা নিহত হয়েছেন, তাদের একজন অনলাইন সংবাদমাধ্যম ঢাকা টাইমসের সাংবাদিক মেহেদী হাসান। তার শরীরে গুলির চিহ্ন রয়েছে। স্বজন এবং প্রত্যক্ষদর্শী সহকর্মীরা বলছেন, ১৮ জুলাই যাত্রাবাড়ী এলাকায় সংঘর্ষ চলাকালে মেহেদী ওই এলাকায় পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি নিজের মোবাইল ফোনে পুলিশের এপিসি থেকে গুলি ছোড়ার ছবি নিচ্ছিলেন। তখন পুলিশের গুলিতে তিনি মারা যান।

অথচ ওই ঘটনায় যাত্রাবাড়ী থানায় দায়ের মামলায় বলা হয়েছে, ‘কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের আড়ালে থাকা সন্ত্রাসীদের গুলিতে সাংবাদিক মেহেদী নিহত হন। কারা গুলি করেছে, সেটি তদন্তের মাধ্যমে বেরিয়ে আসবে।’ গত ২৭ জুলাই যাত্রাবাড়ী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. হোসেন জায়েদ বাদী হয়ে মামলাটি করেন। এতে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করা হয়। এজাহারে মেহেদীসহ ওইদিন ওই এলাকায় দুজনকে পিটিয়ে ও পাঁচজনকে গুলি করে হত্যার কথা বলা হয়েছে।

অবশ্য সাংবাদিক মেহেদীর ছোট ভাই জাহিদ আশিক গতকাল শুক্রবার বলেছেন, তার ভাই পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন। তার ভাইয়ের সহকর্মী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে জেনেছেন, পুলিশ এপিসি বা রায়ট কার থেকে গুলি ছুড়ে সংঘর্ষ নিবৃত্ত করছিল। ওই সময় মেহেদী ছবি তোলার সময় সেখান থেকে গুলি লাগে।

শুধু মেহেদীর মৃত্যুর ঘটনাতে দায়ের এই মামলাটিতেই নয়, কোটা সংস্কার আন্দোলনে সহিংসতায় হতাহত হওয়ার ঘটনায় পুলিশের দায়ের মামলার কয়েকটি এজাহার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এসব মামলায় পুলিশের পক্ষ থেকে গুলি করার তথ্য নেই। যদিও সহিংসতা ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে হতাহতের বেশিরভাগের শরীরে গুলির চিহ্ন রয়েছে। এই সংঘর্ষ থামাতে কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেডের সঙ্গে শটগানের মতো আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছে পুলিশ। অভিযোগ উঠেছে, অপেক্ষাকৃত এসব দুর্বল অস্ত্রের বাইরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী লেথাল আর্মসের (প্রাণঘাতী) গুলিও ব্যবহার করেছে। নিহতদের অনেক স্বজন অভিযোগ তুলেছেন, পুলিশের গুলিতে তাদের স্বজনদের মৃত্যু হয়েছে।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গত ২৫ জুলাই এক বিবৃতিতে দাবি করেছে, ‘বিক্ষোভ দমনে আইনবহির্ভূতভাবে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলাদেশে সহিংসতার ভিডিও বিশ্লেষণ করে তারা এর প্রমাণ পেয়েছে।’

মামলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে মৃত্যুর তথ্য না থাকার বিষয়ে জানতে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র পুলিশ সুপার ইনামুল হক সাগরের সরকারি ফোন নম্বরে কয়েক দফা ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। অবশ্য ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মুখপাত্র ডিসি ফারুক হোসেন বলেন, ‘সাধারণ ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ভেতর সহিংসতা সৃষ্টি করে হাজার হাজার লোকজন অংশ নিয়েছে, স্বার্থান্বেষী মহল নেমেছিল, দুষ্কৃতকারীরা নেমেছিল। তারা তাণ্ডব চালিয়েছে এবং তাদের ভেতর থেকে গুলি করেছে। আত্মরক্ষার্থে পুলিশও গুলি করেছে। বহুমুখী তৎপরতা ছিল এই সহিংসতায়।’

তিনি বলেন, ‘ছাত্রদের আন্দোলনে বিএনপি নেমেছে, জামায়াত নেমেছে, শিবির নেমেছে। তারা স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে। বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে তারা গুলি করে একটা ঝামেলা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে। এখন এই মামলাগুলো তদন্ত করে দেখা হবে, কার গুলিতে কে মারা গেছেন, এগুলো দেখে মামলাগুলো নিষ্পত্তি করা হবে।’

মামলার এজাহার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ১৯ জুলাই দুপুরে রাজধানীর কদমতলীতে তিন বছরের শিশু আবদুল আহাদ গুলিতে নিহত হয়। ওই ঘটনায় গত ২৮ জুলাই কদমতলী থানার এসআই কে এম জাহান-ই-আলম বাদী হয়ে মামলা করেন। এজাহারে অজ্ঞাতপরিচয় সাত থেকে আট হাজার ‘দুষ্কৃতকারী’কে আসামি করে বলা হয়, ‘দুষ্কৃতকারীরা কদমতলী থানা আক্রমণ এবং বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ, লাঠিসোটা ও লোহার রড দিয়ে আঘাত, ককটেল ও পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ এবং গুলিবর্ষণ করে। পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও শটগান ব্যবহার করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার পর পুলিশ জানতে পারে, কোটাবিরোধী আন্দোলনের আড়ালে থাকা দুষ্কৃতকারীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে আবদুল আহাদ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে।’

গত মাসের শুরুর দিকে কোটা সংস্কারের দাবিতে মাঠে নামেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এই আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নেয় ১৬ জুলাই থেকে। টানা ২১ জুলাই পর্যন্ত চলে ভয়াবহ সংঘর্ষ। এর মধ্যে সহিংসতায় ১৭ জুলাই ছাড়া অন্য চার দিন নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। নিহতদের মধ্যে আন্দোলনকারী, পথচারী, সাংবাদিক, পুলিশ ছাড়াও বাসার ভেতর অবস্থান করেও গুলিতে নিহতের ঘটনা রয়েছে। এখন পর্যন্ত সরকারি হিসাবে ওই চার দিনে ১৫০ জন নিহত হয়েছেন। যদিও গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য বলছে, এই সংখ্যা দুইশর বেশি। এর মধ্যে রাজধানীতে অন্তত ৯০ জন নিহত হন। তারা ঘটনাস্থল এবং পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

ভয়াবহ এই হতাহতের ঘটনায় ৩০ জুলাই পর্যন্ত রাজধানীর ৫০টি থানায় ২৬৪টি মামলা হয়। এসব মামলার মধ্যে ৫৩টি হত্যা মামলা রয়েছে। পুলিশ বাদী হয়ে করা হত্যা মামলাগুলোর প্রায় সব এজাহারে ঘটনার বিবরণের পর প্রায় অভিন্নভাবে ‘দুষ্কৃতকারীদের’ গুলিতে মৃত্যু লেখা হয়েছে।

হত্যাকাণ্ডের ধারায় করা মামলাগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সহিংসতায় সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছে যাত্রাবাড়ী এলাকায়। ওই থানায় ১৬টি হত্যা মামলা হয়েছে। পাশের কদমতলী থানায় এই মামলার সংখ্যা পাঁচটি। বাড্ডা থানায় চারটি, নিউমার্কেট, লালবাগ, পল্টন ও ভাটারা থানায় তিনটি করে হত্যা মামলা হয়। এ ছাড়া রামপুরা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, কাফরুল ও গুলশান থানায় দুটি করে এবং ধানমন্ডি, সূত্রাপুর, খিলগাঁও, বনানী, উত্তরা-পশ্চিম ও উত্তরা-পূর্ব থানায় একটি করে হত্যাকাণ্ডের ধারায় মামলা হয়। যদিও সংঘর্ষের ঘটনায় প্রতিটি এলাকাতেই একাধিক ব্যক্তি নিহত হন। তবে কোনো ঘটনাতেই পুলিশের ‘গুলিতে মৃত্যু হয়েছে’ এমন তথ্য উল্লেখ নেই।

এসব থানার মধ্যে কয়েকটি থানার ওসিদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তারা মামলার তথ্য নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি। দুটি থানার ওসি অনানুষ্ঠানিকভাবে বলেছেন, সংঘর্ষে নিহত হওয়ার ঘটনায় পৃথক পৃথক মামলা হয়নি। একই ঘটনায় নিহত হওয়ায় হয়তো একটি এজাহারেই একাধিক ঘটনা এসেছে। যেসব ঘটনায় নিহতের স্বজনরা মামলা করেননি, সেসব ঘটনায় নিয়ম অনুযায়ী পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে। মামলাগুলোর তদন্তের পর বোঝা যাবে কার গুলিতে বা কীভাবে মৃত্যু হয়েছে।

পুলিশের সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কারও বাড়াবাড়ি থাকলে তা নিরূপণ করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। তথ্য লুকিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না।’

রাজধানীর ১১ থানা এলাকায় সবচেয়ে বেশি সহিংসতা:

সহিংসতার ঘটনায় ৩০ জুলাই পর্যন্ত রাজধানীর ৫০ থানায় দায়ের ২৬২ মামলার সংখ্যা বিশ্লেষণ করে ১৬ থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত ঢাকার কোন এলাকায় কতটুকু সহিংসতা হয়েছে বা কোন এলাকা শান্ত ছিল, তার একটা চিত্র পাওয়া যাচ্ছে। সেই তথ্য অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, ঢাকার ১১টি থানা এলাকায় সবচেয়ে বেশি সহিংস ঘটনা ঘটেছে। ১০ থানায় দুটি করে সহিংসতা হয় এবং ছয়টি থানায় একটি করে সহিংস ঘটনা ঘটে। তবে মামলার তথ্যানুযায়ী, ৮টি থানা এলাকায় কোনো সহিংসতা হয়নি।

মামলার সংখ্যা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ডিএমপির আট ক্রাইম জোনের মধ্যে ওয়ারী বিভাগে সবচেয়ে বেশি সহিংসতা হয়েছে। এই বিভাগের এলাকাগুলোর মধ্যে সহিংসতার ঘটনায় মোট ৫০টি মামলা হয়েছে। এসব মামলার মধ্যে যাত্রাবাড়ী থানায় ৩৬টি এবং কদমতলী থানায় ১০টি মামলা হয়েছে। এ ছাড়া ডেমরা থানায় তিনটি, ওয়ারী ও গেন্ডারিয়া থানায় একটি করে মামলা হয়েছে। রমনা ক্রাইম বিভাগে মামলা হয়েছে ৪১টি। এই বিভাগের শাহবাগ থানায় ১৫টি, নিউমার্কেট থানায় ১২টি, ধানমন্ডিতে আটটি এবং রমনা থানায় পাঁচটি মামলা হয়। এই দুটি এলাকার পর বেশি সহিংসতা হয় মতিঝিল বিভাগ ও গুলশান বিভাগে। এই দুটি এলাকায় ৩৭টি করে মামলা হয়। মতিঝিল বিভাগের পল্টন থানায় ১৩টি, খিলগাঁও থানায় আটটি, রামপুরা থানায় সাতটি, সবুজবাগ থানায় তিনটি ও মুগদা থানায় দুটি সহিংসতার ঘটনা ঘটে। গুলশান বিভাগের বনানীতে ১৪টি, বাড্ডায় ১১টি, গুলশানে ছয়টি, ভাটারায় চারটি এবং ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকায় দুটি মামলা হয়। সহিংসতার ঘটনায় ৩০টি মামলা হয় উত্তরা বিভাগের চার থানায়। এর মধ্যে উত্তরা পশ্চিম থানায় ১৪টি, উত্তরা পূর্ব থানায় ১৩টি ও বিমানবন্দর থানায় দুটি মামলা হয়। তেজগাঁও বিভাগের থানাগুলোর মধ্যে মোহাম্মদপুর থানা এলাকায় সবচেয়ে বেশি সহিংসতা হয়। ওই থানায় ১২টি মামলা হয়। এ ছাড়া তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে ছয়টি, হাতিরঝিল থানায় পাঁচটি, শেরেবাংলা নগর, তেজগাঁও ও আদাবর থানায় দুটি করে মামলা হয়। এই তথ্য থেকে দেখা যায়, পুরো তেজগাঁও বিভাগে সহিংসতা ছিল। মিরপুর বিভাগে সহিংসতার ঘটনায় ২৪টি মামলা হয়। এর মধ্যে মিরপুর থানায় ১১টি, কাফরুলে আটটি, পল্লবীতে তিনটি ও রূপনগরে দুটি মামলা হয়। লালবাগ বিভাগে মামলা হয় ১৭টি। এর মধ্যে লালবাগ থানাতেই ১০টি মামলা হয়। এ ছাড়া চকবাজার, বংশাল ও সূত্রাপুরে দুটি করে মামলা হয়।

৮ থানা এলাকার পরিস্থিতি ছিল স্বাভাবিক:

মামলাগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কলাবাগান, কোতোয়ালি, ওয়ারী, গেন্ডারিয়া, শাহজাহানপুর এবং তুরাগ—এই ছয় থানা এলাকায় একটি করে সহিংসতার মামলা হয়েছে। অর্থাৎ এসব থানা এলাকা অপেক্ষাকৃত শান্ত ছিল। তবে ১৬ থেকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত হাজারীবাগ থানা, কামরাঙ্গীরচর থানা, শ্যামপুর থানা, ভাসানটেক, দারুস সালাম, শাহআলী থানা, খিলক্ষেত থানা, দক্ষিণখান ও উত্তরখান থানা এলাকায় কোনো মামলা হয়নি।

এসব থানার পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে আভাস মিলেছে, এসব এলাকায় সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তুলনামূলক কম। ফলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিল না।কালবেলা

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.net
Website Design By Kidarkar It solutions