রাজধানীতে ‘ব্লক রেইড’: টার্গেট শিক্ষার্থী ও বিরোধীরা

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০২৪
  • ৭৭ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- রাত ১১টা। আকাশে হেলিকপ্টারে টহল। সাইরেন বাজিয়ে হঠাৎ মহল্লার চারপাশ ঘিরে ফেলেন সেনাবাহিনী ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা। হ্যান্ডমাইকে পুলিশের পক্ষ থেকে ঘোষণা আসে, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালাবে।

কেউ বাসা থেকে বের হবেন না।’ ঘোষণা শেষ হতেই সড়কের বাতি বন্ধ করে দেওয়া হয়। তারপর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। বাসায় ঢুকেই পুলিশের প্রশ্ন—আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে সহিংসতা চালিয়েছে, এমন কেউ বাসায় আছেন কি না। এরপর প্রশ্ন চলে একের পর এক, সঙ্গে চালানো হয় ঘরের প্রতিটি কোনায় তল্লাশি। জবাবের হেরফের হলেই গ্রেপ্তার।

রাজধানীর শাহীনবাগ এলাকায় গত বৃহস্পতিবার পুলিশের ‘ব্লক রেইড’-এর সময় তৈরি হওয়া এমন ভীতিকর পরিস্থিতি তুলে ধরেন মুদিদোকানি হাফিজুর ইসলাম। তাঁর দাবি, সে রাতে এলাকা থেকে বেশ কয়েকজনকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

অভিযানসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ঢাকায় যাঁরা সহিংসতা চালিয়েছেন এবং তাঁদের যাঁরা মদদ দিয়েছেন, তাঁদের ধরতেই এই অভিযান। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এলাকা ভাগ করে সন্দেহভাজনদের আটক করা হয়। পরে তাঁদের যাচাই-বাছাই করে গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। সূত্র আরও জানায়, গত কয়েক দিনে রাজধানীর উত্তরা, তেজগাঁও, মোহাম্মদপুর, ঢাকার বসুন্ধরা, রামপুরা, বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, মহাখালী, শাহীনবাগ ও মগবাজার এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এসব এলাকা থেকে হাজারখানেক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

সন্দেহভাজনদের কিসের ভিত্তিতে আটক করা হচ্ছে, সে বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুটি অংশে অভিযান চালায় পুলিশ। একাংশ অভিযান চালায় বিএনপি-জামায়াত ও তাঁদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর নেতা-কর্মীদের ধরতে। অন্য অংশের পুলিশ কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেওয়া সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালায়।

ব্লক রেইডের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপারেশনস) বিপ্লব কুমার সরকার গতকাল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আন্দোলন ঘিরে যাঁরা সহিংসতা চালিয়েছেন, তাঁদের ধরতে অভিযান চলছে। যত দিন পর্যন্ত জড়িতদের আইনের আওতায় না আনা যাবে, তত দিন অভিযান চলবে।’

কোন এলাকা আর কী কী বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে অভিযান চালানো হচ্ছে, জানতে চাইলে পুলিশের এই পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, দু-তিন দিন বিরতি দিয়ে এলাকা ধরে ধরে কিছু কৌশল নিয়ে আগানো হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন সব অপরাধীকে ধরা যাবে, অন্যদিকে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে হয়রানির শিকার হতে হবে না।

শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে রাজধানীসহ সারা দেশে সহিংসতা, হামলা, ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। পাঁচ দিন ধরে অচল করে রাখা হয় রামপুরা, বাড্ডা ও যাত্রাবাড়ী, কদমতলী এলাকা। সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয় সরকারি স্থাপনায়। কয়েক দিনের এই সংঘর্ষে সারা দেশে নিহত হয় দুই শতাধিক মানুষ। দেশব্যাপী এমন পরিস্থিতি খানিকটা নিয়ন্ত্রণে আনার পর গত রোববার রাত থেকে রাজধানীসহ সারা দেশে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ছবি এবং ভিডিও ফুটেজ দেখে নাশকতাকারীদের শনাক্ত করে তাদের গ্রেপ্তারে ব্লক রেইড চলছে।

গতকাল শনিবার বিকেলে ঢাকা মহানগর পুলিশ এক বার্তায় জানিয়েছে, ঢাকায় সহিংসতার ঘটনায় ২০৭টি মামলায় এখন পর্যন্ত ২ হাজার ৫৩৬ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। আটককৃতদের অনেককে পুরোনো মামলায়ও গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। তবে সারা দেশ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১১ দিনে (১৭-২৭ জুলাই) সারা দেশে মোট গ্রেপ্তার ৬ হাজার ছাড়িয়েছে।

সর্বশেষ গত শুক্রবার উত্তরা এলাকায় অভিযান চালায় পুলিশ। অপূর্ব হাসান নামের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া এক শিক্ষার্থী জানান, তাঁরা কয়েকজন বন্ধু মেস করে বেশ কয়েক মাস ধরে একসঙ্গে থাকেন। সে রাতে পুলিশের কয়েকজন সদস্য হঠাৎ কড়া নেড়ে বাসায় প্রবেশ করেন। পরিচয়পত্র দেখার পর আন্দোলনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে জানতে চান। পাশাপাশি শরীরে কোনো ক্ষতস্থান আছে কি না, তা দেখতে চান। যাওয়ার সময় নেটের লাইন কেটে দিয়ে চলে যান।

রাইড শেয়ারিং পেশায় নিয়োজিত বনশ্রীর এক বাসিন্দা জানান, গত বৃহস্পতিবার রাত ১টায় তাঁর বাসায় রেইড দেওয়া হয়। পুলিশের কয়েকজন সদস্য বাসার বাইরে রাস্তায় অবস্থান নেন। আর কয়েকজন তাঁদের বাসায় প্রবেশ করেন। তাঁদের কাছে থাকা তালিকার সঙ্গে নাম-ঠিকানা মিলিয়ে নেন। আগামী কয়েক দিন ঢাকার বাইরে থাকা আত্মীয়দের বাসায় আনতে নিরুৎসাহিত করে তাঁরা চলে যান।

এদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, ব্লক রেইড নামে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বাসায় অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ। দলটির অভিযোগ, গতকাল যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকনের বাসায় তল্লাশি করে তাঁকে না পেয়ে তাঁর ভায়রা, শ্যালক ও শ্যালকের ছেলেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে। গণঅধিকার পরিষদের উচ্চতর পরিষদের সদস্য আবু হানিফকে তাঁর বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। তল্লাশি করা হয়েছে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির গণশিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ও ইউট্যাবের মহাসচিব অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খানের বাসায়।

‘ব্লক রেইড’ দিয়ে গ্রেপ্তারের সমালোচনা করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘বিরোধী দলের নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি এখন কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরও ব্লক রেইড দিয়ে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আইডি কার্ড দেখামাত্রই গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছে।

আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের বলেন, সহিংসতাকে কেন্দ্র করে চিহ্নিত অপরাধীদের গ্রেপ্তারে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চলছে। এরই মধ্যে বিএনপি-জামায়াতের বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেককে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.net
Website Design By Kidarkar It solutions