ডেস্ক রির্পোট:- ফাঁস হওয়া প্রশ্নে কোন বছর কারা বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন; কারা নেপথ্যে প্রশ্নফাঁসের মদদ দিয়েছেন, পিএসসির কোন কোন কর্মকর্তা এসব তথ্য জানতেন সবই বেরিয়ে এসেছে গ্রেফতারকৃতদের আদালতে স্বেচ্ছায় দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে। একই সাথে একটি গোয়েন্দা সংস্থা ও সিআইডির কর্মকর্তারা পিএসসির সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলী এবং অডিটর প্রিয়নাথ রায়ের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে দেয়া তথ্য সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছেন। এ দু’জনের স্বীকারোক্তিতে বেরিয়ে এসেছে প্রশ্নফাঁসের মূল হোতাদের নামও। সাম্প্রতিক চীন সফর নিয়ে গতকাল গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, যখন ধরা পড়েছে, তদন্ত হবে, বিচার হবে। যারা বেনিফিশিয়ারি, যদি তাদের খুঁজে বের করা যায়, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেব। নেব না কেন? তাদের চাকরি করার কোনো অধিকারই থাকবে না। শেখ হাসিনা বলেন, প্রশ্ন হচ্ছে এদের খুঁজে বের করে দেবে কে? যদি ওরা বলে তখন প্রমাণ করতে পারলে দেখা যাবে। আমি বিশ্বাস করি, এর বেনিফিশিয়ারি যারা, ওদের ধরা উচিত। তাহলে আর ভবিষ্যতে কেউ করবে না।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় পাস করা কর্মকর্তাদের ৯০ ভাগই দুর্নীতিবাজ। তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা উচিত। এদের চাকরিতে থাকার কোনো অধিকার নাই। কারণ তারা চাকরিতে নিয়োগ পেয়েছে অপরাধ করে। যে অপরাধ চাকরির জন্য ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, পিএসসির অধীনে অনুষ্ঠিত বিসিএস ক্যাডার ও নন-ক্যাডারের বিভিন্ন পদে নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেছে। ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সুযোগ নিয়ে চাকরি বাগিয়েছেন প্রথম শ্রেণির অনেক কর্মকর্তাও। প্রশ্নফাঁসকাণ্ডে গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের জবানবন্দিতে ৩৩তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা, ৪৬তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত অধিদপ্তরে উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষা, পলিটেকনিক্যাল কলেজের জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের তথ্য উঠে এসেছে। সবশেষ, রেলওয়ের দশম গ্রেডের উপসহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগের প্রশ্নপত্র ট্রাংকের তালা কেটে পিএসসির অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম সাজু প্রশ্ন ফাঁস করেছেন বলে আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছেন।
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আবেদ আলী বলেছেন, প্রিয়নাথ রায় চাকরিপ্রার্থীদেরকে তার কাছে পৌঁছে দিতেন। চুক্তি হতো ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকায়, অগ্রিম নেওয়া হতো ২ থেকে ৫ লাখ টাকা। হতো সেই বিপুল অর্থের ভাগবাটোয়ারা। আর এসব করতেন প্রিয়নাথ রায়। প্রায় ৪৫০ জনকে প্রশ্নপত্র দিয়ে চাকরি পাইয়ে দিতে তিনি সহযোগিতা করেছেন। ঠাকুরগাঁওয়ে এলাকায় তেমন সম্পদ না থাকলেও দিনাজপুর ও ঢাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রিয়নাথের আছে বাড়ি-গাড়িসহ অঢেল সম্পত্তি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিআইডির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামের রাইতু রায় ও রাজবালা দম্পতির সন্তান প্রিয়নাথ রায়। চার ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় তিনি। অভাবের সংসারে বেড়ে ওঠা প্রিয়নাথ এসএসসি পরীক্ষার সময় হারান বাবাকে। এইচএসসির পরে বন বিভাগে চাকরি নেন তিনি। ডিগ্রি পাস করে সেনাবাহিনীর অডিটর পদে যোগ দেন। এরপর তিনি জড়িয়ে পড়েন চাকরি প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে। অপকর্মে ছেলের জড়িয়ে পড়ায় তার মা দায়ী করছেন পুত্রবধূকে। তিনি বলেন, আমার ছেলেকে ফাঁসানো হয়েছে। বউয়ের বুদ্ধিতে সে চলে। ঠাকুরগাঁও সদর থানার ওসি ফিরোজ ওয়াহিদ সাংবাদিকদের বলেন, চাকরি দেওয়ার নাম করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে বিভিন্ন জেলায় রয়েছে প্রিয়নাথের নামে একাধিক মামলা। কিন্তু কয়েক বছর ধরে তিনি বাড়িতে আসেন না।
জানতে চাইলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সিআইডির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, প্রশ্নফাঁসে পিএসসির কর্মকর্তারা হলেন মূল খেলোয়াড়। উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীর ও জাফর এবং সহকারী পরিচালক আলমগীর প্রশ্ন ফাঁস করতেন। অফিস সহকারী সাজেদুল, ডেসপাস রাইটার খলিলদের মাধ্যমে প্রার্থী সংগ্রহ করে ফাঁস করা প্রশ্ন সরবরাহ করা হতো। ভাড়া বাসায় ডেকে প্রার্থীদের তা পড়ানো হতো। বিনিময়ে নেওয়া হতো মোটা অঙ্কের টাকা। গাড়িালক সৈয়দ আবেদ আলী এবং অডিটর প্রিয়নাথ রায় লেনদেন ও প্রশ্নফাঁসের বুথ পরিচালনা করতেন। তিনি বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত তদন্তে আরও অনেকের নাম পেয়েছি। ‘হাইপ্রোফাইল’ কিছু নামও এসেছে। সেসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য এবং আসামিদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে অন্য জড়িতদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে আবেদ আলীর সম্পৃক্ততা পায় একটি গোয়েন্দা সংস্থা। তাকে গ্রেপ্তারও করা হয়। প্রশ্নপত্র ফাঁসে কারা জড়িত, অন্যান্য প্রশ্নপত্র কীভাবে ফাঁস করা হয় সেই তথ্যও তিনি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে দেন। সে সময় আবেদ আলী পিএসসির চেয়ারম্যানের কাছে অঙ্গীকার করেন যে, আর কখনো প্রশ্নফাঁস করবেন না। তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী ওই সময়ের চেয়ারম্যান পিএসসির আবেদ আলীসহ যে কয়জন কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন তাদের চাকরিচ্যুত করেন। কিন্তু চাকরিচ্যুত হওয়ার পর আবেদ আলী প্রশ্নফাঁসের কাজটি পুরাদমে শুরু করেন। তার সঙ্গে বড় একটি গ্রুপ জড়িত। ওই সময় ভর্তি পরীক্ষার এই প্রশ্নগুলো বিজিপ্রেসের যারা টাইপ করতো, সেখানে ছিল আবেদ আলীর লোক। তারা প্রশ্নগুলো মুখস্থ করে ফেলতো। তারা সবাই মিলে প্রশ্নফাঁস করতো। তারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করে বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে পাঠাতো। সেই কোচিং সেন্টারগুলোও শনাক্ত করে গোয়েন্দা সংস্থা। তবে এদের পেছনে নেপথ্যের শক্তি এতো শক্তিশালী ছিল যে, তাদের কিছুই করা যায়নি।
উল্লেখ্য, প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে গত ৮ জুলাই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে আবেদ আলীসহ মোট ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় ওইদিন রাতে পল্টন থানায় বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন আইনে সিআইডির এসআই নিপ্পন চন্দ্র চন্দ বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলায় ৩১ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় ৫০-৬০ জনকে আসামি করা হয়েছে।ইনকিলাব