ডেস্ক রির্পোট:- ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার সবদালডাঙ্গা উমেদ আলী উচ্চবিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত সহকারী শিক্ষক (ইংরেজি) মির্জা শিউলি বেগম। এমপিওভুক্ত শিক্ষক হিসেবে সরকারের কাছ থেকে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন তিনি। অথচ শিক্ষক হওয়ার জন্য শিউলি বেগম যে ‘শিক্ষক নিবন্ধন’ সনদ জমা দিয়েছেন, সেটিই ভুয়া। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে বিষয়টি ধরা পড়ায় এখন তাঁকে সরকারের কাছ থেকে নেওয়া ১৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা ফেরত দিতে হবে।
মির্জা শিউলি বেগমের মতো মোট ১৫৪ জন শিক্ষকের জাল সনদ ধরা পড়েছে ডিআইএর তদন্তে। এ জন্য তাঁদের কাছ থেকে ১৬ কোটি টাকার বেশি অর্থ ফেরত নেওয়া এবং তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। এমপিওভুক্ত হিসেবে সরকারের কাছ থেকে বেতন-ভাতা বাবদ এই অর্থ নিয়েছিলেন তাঁরা।
ডিআইএর তদন্তের কালপর্ব ছিল ২০২১ সালের ২১ নভেম্বর থেকে ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এর আগে গত বছরের ১৮ মে ডিআইএর তদন্তে (তদন্তের কালপর্ব ২০১৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ২০ নভেম্বর পর্যন্ত) বের হওয়া জাল সনদধারী ৬৭৮ জন শিক্ষককে চাকরিচ্যুত, অর্থ ফেরত নেওয়া এবং ফৌজদারি মামলা করার নির্দেশ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া ডিআইএ ২০১৩ থেকে ২০২২ সালের ২৫ মে পর্যন্ত মোট ১ হাজার ১৫৬ জন জাল সনদধারী শিক্ষক শনাক্ত করেছিল। পরে এসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
ডিআইএর একের পর এক তদন্তে এভাবে শিক্ষকদের জাল সনদের তথ্য বেরিয়ে আসার ঘটনায় রীতিমতো অবাক শিক্ষাবিদেরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। এই পেশায় আসার ক্ষেত্রে অনিয়মের আশ্রয় নেওয়া ঘৃণিত অপরাধ। এদের কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’
এদিকে শিক্ষা খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করার আগে শিক্ষাগত সব সনদ যথাযথভাবে যাচাই করার কথা। কিন্তু জাল সনদ জানার পরও অবৈধ সুবিধা নিয়ে বিষয়টি চেপে যান মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা। ফলে সনদ জাল হওয়ার পরও তাঁরা এমপিওভুক্ত হয়ে যান। পেতে থাকেন বেতন-ভাতা বাবদ সরকারি অর্থও। তবে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) মাধ্যমে অনলাইনে সনদ যাচাইয়ের ব্যবস্থা করার পর জাল সনদের হার কিছুটা কমেছে।
জানতে চাইলে মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ গতকাল শনিবার বলেন, ‘জাল সনদধারীদের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান জিরো টলারেন্স। কারও বিরুদ্ধে অনিয়মের প্রমান মিললে অবশ্যই তাকে শাস্তির আওতায় আনা হবে।’
ডিআইএর প্রধান কাজ স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন দপ্তর বা সংস্থা পরিদর্শন এবং নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা। পরিদর্শন শেষে প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ও প্রশাসনিক অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা তুলে ধরার পাশাপাশি ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এর ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিয়ে থাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
হাতে পাওয়া ডিআইএর তদন্ত প্রতিবেদনের অনুলিপি থেকে জানা যায়, যে ১৫৪ শিক্ষকের সনদ জাল পাওয়া গেছে, তাঁদের মধ্যে ৭৩ জন এনটিআরসিএর শিক্ষক নিবন্ধনের ভুয়া সনদ দেখিয়েছেন। অন্য জাল সনদগুলোর মধ্যে জাতীয় কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ও গবেষণা একাডেমি, বগুড়ার (নেকটার) ৬৯টি, রয়েল ইউনিভার্সিটির ৭টি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪টি ও শহর সমাজসেবা কার্যালয়, শেরপুরের ১টি।
জাল সনদের তালিকা পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৫৪টি জাল শিক্ষক নিবন্ধন সনদের মধ্যে ১৪৮ জন শিক্ষক এমপিওভুক্ত। এই শিক্ষকদের কাছ থেকে মোট ১৬ কোটি ৪ লাখ ৩ হাজার ৮৪৪ টাকা আদায়ের সুপারিশ করা হয়েছে। বাকি ৬ জন শিক্ষক এমপিওভুক্ত নন, তাই তাঁদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের সুপারিশ করা হয়নি।
জানতে চাইলে ডিআইএর পরিচালক (রুটিন দায়িত্বে) বিপুল চন্দ্র সরকার বলেন, ডিআইএর তদন্তে জাল সনদের বিষয়টি ধরা পড়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়েছে। এখন নিয়ম অনুযায়ী চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
সার্বিক বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব (নিরীক্ষা ও আইন) মূকেশ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘জাল সনদধারী শিক্ষকদের বিষয়ে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত কঠোর। এর আগেও তদন্তে বের হওয়া জাল সনদধারী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এবারও বিধিবিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’আজকের পত্রিকা