ডেস্ক রির্পোট:- সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধীদের রোববারের ‘বাংলা ব্লকেড’ আন্দোলনে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন এলাকায় সড়ক মহাসড়ক অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা।
তাদের কথা আদালতের মাধ্যমে নয়, আন্দোলনের মাধ্যমেই দাবি আদায় করবেন।
অন্যদিকে, আন্দোলনের সাত দিনের মাথায় এসে এ নিয়ে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন,‘হাইকোর্টের রায়, এটার বিরুদ্ধে এভাবে আন্দোলন করা, এটা তো সাবজুডিস। কারণ, আমরা সরকারে থেকে কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো কথা বলতে পারি না। হাইকোর্ট রায় দিলে সেটা হাইকোর্ট থেকেই আবার আসতে হবে।’
এর জবাবে কোটা-বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কারীদের একজন আসিফ আহমেদ বলেন,‘২০১৮ সালের শুরুতে কোটার বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীরা হাইকোর্টে রিট করতে গিয়েছিল। তখন আদালত বলেছিলেন এটা সরকারের বিষয়, আদালতের কিছু করার নেই। সেই আদালতই এখন রায় দিয়েছে কোটার বহাল রাখার জন্য। একই আদালতের দুই রকম কথা হতে পারে না। সরকার চাইলে এর যৌক্তিক সমাধান করতে পারে।’
অন্যদিকে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক মনে করেন,‘সরকারের হাতে সমাধান আছে। সরকার কোটা বহালের উচ্চ আদালতের রায় কার্যকর করে তা আবার প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাতিল করতে পারে। তাতেই সমাধান।’
তবে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন মনে করেন,‘পুরো বিষয়টি এখন বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। এটা শেষ হওয়ার আগে সরকারের করার কিছু নেই।’
যেভাবে আবার আন্দোলন
কোটা-বিরোধী আন্দোলন এবারই নতুন নয়। কোটা-বিরোধী আন্দোলনের মুখে সরকার ২০১৮ সালে কোটা পদ্ধতি সংস্কার করে। পরিপত্র জারি করে সরকারি দফতর, স্বায়ত্তশাসিত বা আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন কর্পোরেশনে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কোটা বাতিল করে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর নবম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত সরাসরি নিয়োগে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে একটি পরিপত্র জারি করে। সেখানে বলা হয়েছিল, ৯ম গ্রেড (পূর্বতন ১ম শ্রেণি) এবং ১০ম-১৩তম গ্রেড (পূর্বতন ২য় শ্রেণি) পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাতালিকার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে হবে। ওই পদসমূহে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হয়। নারী কোটা ১০ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ, উপজাতি পাঁচ ও প্রতিবন্ধীদের এক শতাংশ কোটা বাতিল করা হয়।
এই পরিপত্রের মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ বাতিল চ্যালেঞ্জ করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্ম কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল ২০২১ সালে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করে। গত ৫ জুন রায় দেয় হাইকোর্ট। রায়ে সরকারের পরিপত্র বাতিল করে মুক্তিযোদ্ধা ৩০ শতাংশ কোটা বহাল রাখার আদেশ দেয়া হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রপক্ষ’ আবেদন করলে ৪ জুলাই আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে নিয়মিত আপিল করতে বলেন। ফলে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ ও আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে কোট বহাল থাকছে। আর বিরুদ্ধে এখন আন্দোলন চলছে।
আদালতের বাইরে কি সমাধান সম্ভব?
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন,‘সরকার এর আগে প্রজ্ঞাপন জারি করে কোটা বাতিল করেছিল। ফলে এটা স্পষ্ট যে সরকারের হাতে কোট বাতিলের ক্ষমতা আছে। এখন যেহেতু আদালতের রায়ে কোটা আবার বহাল হয়েছে তাই সরকার চাইলে কোটা বহালের প্রজ্ঞাপন জারি করে দুই-একদিন পরে তা আবার বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারে। আদালতের ব্যাপারে সরকার তো কিছু বলতে পারে না। কিন্তু তার প্রজ্ঞাপন জারি করার ক্ষমতাও আছে। রাষ্ট্রপক্ষ এখন যে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল প্রক্রিয়ায় আছে সেই আপিলেরও দরকার নেই। তাতে সময় নষ্ট হবে। সরকার হাইকোর্টের রায়ই বাস্তবায়ন করে পরে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাতিল করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।’
তার কথা,‘যারা কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে তারা তো পুরোপুরি কোটা বাতিল চাইছে না। তার চাইছে সংস্কার। মুক্তিযোদ্ধাদের ৩০ শতাংশ কোটা আর দরকার নাই। কারণ মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের আর কারো সরকারি চাকরির বয়স আছে বলে মনে হয় না, তাদের থার্ড জেনারেশন চলছে। আদিবাসী, বিশেষ চাহিদা-সম্পন্ন ব্যক্তি, অনগ্রসর ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী ও ক্ষেত্র বিশেষে নারীদের জন্য কিছু এভাবে সর্বোচ্চ ১০-১২ শতাংশ কোট রাখা যায়। এজন্য সরকার ওই কৌশলে আদালতের রায় বাস্তবায়ন ও পরে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সংস্কার করতে পারে। প্রয়োজনে এজন্য একটি কমিশনও গঠন করা যায়।’
তবে তবে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন,‘এখন তো বিষয়টি বিচারাধীন, বিচারবিভাগের অধীনে। এখন তো কারো কিছু করার নাই। আমরা হাইকোর্টের রায়ের পর পরই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছি। আপিল শুনানির জন্য আদালত সময় নিয়েছে। শুনানির পর আদালত কি সিদ্ধান্ত দেয় সেটা দেখতে হবে। বিচার-প্রক্রিয়া চলাকালে তো কিছু করা যাবে না।’
আদালতের রায় সরকার বাস্তবায়ন করে তার পর প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে আবার সরকার কোটা বাতিল করতে পারে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘সবসময় সরকারের হাতে সব কিছু থাকে না। দেখা যাক আপিল বিভাগ রায়ে কি বলেন। ওটা দেখে তারপর সরকার কিছু করতে পারে। বিচারাধীন বিষয়ে সরকার তো কিছু করতে পারে না। আমাদের আদালতের তো কিছু রীতিনীতি আছে। সেখানে তো সরকার হাত দিতে পারে না। আগে পুরো বিচার প্রক্রিয়া শেষ হোক। তারপর সরকার বিবেচনা করে দেখতে পারে কি করা যায়। কিন্তু বিচারাধীন অবস্থায় তো সরকারের কিছু করার নাই।’
কোটা-বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কারীদের একজন আসিফ মাহমুদ বলেন,‘আমরা কোটা সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধান চাচ্ছি। আমাদের সংবিধানে কোটা আছে। তাই প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, সত্যিকার অর্থে যারা অনগ্রসর তাদের জন্য কোটা রাখা যায়। এটা পাঁচ শতাংশের মধ্যে রাখতে হবে। কোটা সংস্কার করে এর স্থায়ী সমাধান করতে হবে।’
তার কথায়,‘২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি সাধারণ শিক্ষার্থীরা কোটার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেছিল। তখন আদালত বলেছিল এটা সরকারের বিষয়। পরে ওই বছরই সরকার আন্দোলনের মুখে কোটা বাতিল করে। এখন আবার কোটা বাহাল রাখতে আদালত রায় দিলো। এটা আসলে একটা প্রহসন। আমরা চাই এই প্রহসনের অবসান। আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাবো।’
এর বিপরীতে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন বলেন,‘আমরা আদালতের রায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ৩০ শতাংশ কোটা ফিরে পেয়েছি। সরকারকে এখন কোটা বহালের প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে। কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন বাতিল করতে হবে। সরকার যদি আদালতের রায়ের ওপর কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করে তাহলে আমরা সারাদেশে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলব।’
তার কথা,‘এখন যারা কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছে তারা মূলত মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল চায়। তাদের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ভুল বুঝিয়ে মাঠে নামিয়েছে।’
অন্যদিকে কোটা বিরোধী আন্দোলন নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন,‘বিচারাধীন বিষয় নিয়ে অপেক্ষা না করে হঠাৎ করে রাস্তায় নেমে এলাম, রাস্তাঘাট বন্ধ করে দিলাম, এর পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র আছে কি না, প্রশ্ন থাকতে পারে। স্থিতিশীলতাকে বিনষ্ট করার জন্য অনেকেই অনেকভাবে উসকানি দেয়।’
আন্দোলন চলবে
রোববার বলতে গেলে দুপুরের পর ঢাকা অচল হয়ে পড়ে। সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড়ে দুপুরেই অবরোধ করেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা। এতে ঢাকার একাংশের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিকেল ৩টার পর শাহবাগ মোড়ে অবরোধ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তারা শাহবাগ মোড় থেকে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল পর্যন্ত অবস্থান নেয়। এই অবরোধের কারণে ঢাকার অধিকাংশ এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া ঢাকায় বাংলা মোটর, চানখার পুল, পুরনো ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার এলাকায় অবরোধ করা হয়। পুরো ঢাকার সড়কে ব্যাপক পুলিশ মোতায়ের করা হয়েছে।
ঢাকার বাইরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের পার্শ্ববর্তী সড়ক মহাসড়ক অবরোধ করেন।
শাহবাগে অবরোধে অংশ নেয়া শিক্ষার্থী সায়মা রহমান বলেন,‘আমি নারী হয়েও নারী কোটা চাই না। আমরা নারীরা এখন অনেক স্বাবলম্বী। কোনো কোটার সুবিধা নিয়ে চাকরি চাই না। আমরা কোটা ব্যবস্থার অবসান চাই।’
আরেকজন শিক্ষার্থী আবিদ হোসেন বলেন,‘৫৬ শতাংশ কোটার মুখে মেধাবীরা এখন সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে। কোটা বৈষম্য সৃষ্টি করছে। আমরা কোটার অবসান চাই।’
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা নানা প্ল্যাকার্ড নিয়ে অবরোধে অংশ নেন, স্লোগান দেন। তার মধ্যে আছে,‘সারা বাংলায় খবর দে, কোটা প্রথার কবর দে’, ‘কোটা নয়, মেধা চাই’, ‘চাকরি পেতে, স্বচ্ছ নিয়োগ চাই’, ‘কোটা প্রথা নিপাত যাক, মেধাবীরা মুক্তি পাক’, ‘এই বাংলায় হবে না, বৈষম্যের ঠিকানা’।
কোটা-বিরোধীরা বলেন, শুধু প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরি নয়, সব ধরনের চাকরিতেই কোটা সংস্কার করতে হবে।
কোটা বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কারী একজন আসিফ মাহমুদ অভিযোগ করেন,‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে কোটা-বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের ভয় দেখানো হচ্ছে। কয়েকজনকে হল থেকে বের করে দেয়ার অপচেষ্টা আমরা রুখে দিয়েছি।’
তিনি বলেন,‘আমাদের এই বাংলা ব্লকেড, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। আমরা আরো নতুন কর্মসূচি দেব। ঢাকায় প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে হবে। দেশের অন্যান্য এলাকার শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিদিন তাদের সুবিধা-মতো সময়ে করবেন।
রোববার সন্ধ্যার পরও শাহবাগে শিক্ষার্থীরা অবস্থান করছিলেন। গত সাত দিন ধরে তারা আন্দোলনে আছেন। সূত্র : ডয়েচে ভেলে