মেহেদী হাসান পলাশ:- সংস্কৃত বা তৎসম শব্দ থেকে বাংলায় আত্মীকৃত দুর্গম শব্দের অর্থ যেখানে সহজে যাওয়া যায় না বা যেখানে অতিকষ্টে যাওয়া যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামকে দুর্গমাঞ্চল বলা হয় কারণ, এখানে সহজে যা যাতায়াত করা যায় না। এর অনেকাংশে অতিকষ্টে যাওয়া যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের এই দুর্গমতার প্রধান কারণ এর ভূপ্রকৃতি- জঙ্গলাকীর্ণ পর্বতময় ভূমি। এই জঙ্গলাকীর্ণ পর্বতের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত সীমিত। এটাও দুর্গমতার অন্যমত প্রধান কারণ। তবে এই পাহাড়ের এই যোগাযোগ বা যাতায়াত ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে চলেছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের এক মেগা প্রকল্প- যার নাম সীমান্ত সড়ক। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে যোগাযোগ ও যাতায়াত ব্যবস্থায় শুধু বিশাল পরিবর্তনই আসবে না, বরং এর মধ্য দিয়ে দুর্গম পার্বত্যাঞ্চল হয়ে উঠবে সুগম এবং জাতীয় ও আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থার এক গুরুত্বপূর্ণ নেটওয়ার্ক গড়ে উঠবে। সীমান্ত সড়ক পাহাড় সম্পর্কে মানুষের প্রচালিত ধারণাই পাল্টে দেবে এমন অভিমত স্থানীয়দের।
সীমান্ত সড়ক কী?
পার্বত্য চট্টগ্রামের অবকাঠামগত উন্নয়ন ও সীমান্ত সুরক্ষার লক্ষ্যে ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সীমান্ত সড়ক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এই প্রকল্পটির মাধ্যমে খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় থেকে শুরু হয়ে বান্দরবান জেলার সীমান্ত সংলগ্ন এলাকা পর্যন্ত মোট ১০৩৬ কিলোমিটার রাস্তা নির্মিত হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে তিন পার্বত্য জেলার ১২টি উপজেলার মধ্যে সংযোগ সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এর মাধ্যমে স্থানীয় পাহাড়ী ও বাঙালিদের কর্মসংস্থান যেমন বাড়বে, তেমনি স্থানীয় পর্যায়ে ব্যাপক অর্থনৈতিক পরিবর্তন ঘটবে। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এই সীমান্ত সড়কের কারণে পার্বত্য অঞ্চলের অর্থনীতির এক বিরাট বিপ্লব ঘটবে। এমনকি কৃষি সম্ভাবনার কারণে এখানে অনেক প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সীমান্ত সড়কের সাধারণ তথ্য
সীমান্ত সড়কের মোট দৈর্ঘ্য- ১০৩৬ কিলোমিটার।
এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে রয়েছে ৩১৭ কিলোমিটার। এতে সংযোগ সড়ক রয়েছে ৯৭ কিলোমিটার। এগুলো হলো:
১. গিলাতলী-লোগাং ৮ কিলোমিটার
২. সাজেক- উদয়পুর ১২ কিলোমিটার
৩. মারিশ্যা-মাঝিপাড়া ২২ কিলোমিটার
৪. রাজস্থলী-সাইচল ৪০ কিলোমিটার ও
৫. বগালেক- দোপানিছাড় ১৫ কিলোমিটার।
প্রথম পর্যায়ে সীমান্তবর্তী সড়ক রয়েছে ২২০ কিলোমিটার। এরমধ্যে ভারত সীমান্তবর্তী সড়ক রয়েছে ১২৪ কিলোমিটার। এগুলো হলো:
১. রামগড়- তানাক্কাপাড়া ১৪ কিলোমিটার
২. তানাক্কাপাড়া- নাড়াইছড়ি ৩২ কিলোমিটার
৩. বৈরাগীপাড়া-হারিঝাপাড়া ৪১ কিলোমিটার
৪. মাঝিপাড়া- ৫ কিলোমিটার
৫. ধুলাছড়ি-লংলাই ৩২ কিলোমিটার।
এছাড়াও প্রথম পর্যায়ে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী ৯৬ কি.মি. রাস্তা অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। এগুলো হলো:
১. বঙ্কুপাড়া- দোপানিছড়া ৯ কিলোমিটার
২. ঘুমধুম- বাইশফাঁড়ি- লেম্বুছড়ি- পোয়ামুহুরী- ফাতরাঝিরি ৮৭ কিলোমিটার
সীমান্ত সড়কের দ্বিতীয় পর্যায়ে ৩৬০ কিলোমিটার সংযোগ তৈরি করা হবে। এতে সংযোগ সড়ক থাকবে ১০৪ কিলোমিটার। এগুলো হলো:
১. নাড়াইছড়ি-লক্ষীছড়ি- সীমানাছড়া ৩৩ কিলোমিটার
২. ফারুয়া- ফকিরাছড়ি ২৫ কিলোমিটার
৩. তিন্দু- মদক ২০ কিলোমিটার
৪. রুমা- গর্জনিয়া- জামছড়ি ২৬ কিলোমিটার।
এ প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে ২৫৬ কি.মি সীমান্তবর্তী সড়ক অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। এরমধ্যে ভারত সীমান্তবর্তী সড়ক রয়েছে ২০১ কিলোমিটার। এগুলো হলো:
১. অযোধ্যা-তানাক্কা পাড়া ৫১ কিলোমিটার।
২. ভাগীরাতপাড়া- নাড়াইছড়ি ২৫ কিলোমিটার
৩. বেতলিং- বৈরাগীপাড়া ২৫ কিলোমিটার।
৪. মাঝিপাড়া- ঘাসকাপাছড়া ২৫ কিলোমিটার
৫. কারলা ছাড়া- বড়কারদিয়া ২৫ কিলোমিটার
৬. কুঞ্জছড়া- থেগামুখ ২৫ কিলোমিটার ও
৭. থালিপাড়া- ছাইতংপাড়া ২৫ কিলোমিটার।
এ ছাড়াও এ প্রকল্পে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী ৫৫ কিলোমিটার সড়ক অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। এটা হলো: ফাতরাজিরা- লিকরি ৫৫ কিলোমিটার।
সীমান্ত সড়কের তৃতীয় পর্যায়ে সম্ভাব্য ৩০৭ কিলোমিটার সড়ক নির্মিত হতে পারে। এছাড়াও থানচি-রেমাক্রি-মদক-লিকরি ৮০ কিলোমিটার সড়কের ৫২ কিলোমিটার মিয়ানমার সীমান্তবর্তী অংশে সীমান্ত সড়ক প্রকল্পের মোট দৈর্ঘ্যের সাথে যুক্ত হবে।
সীমান্ত সড়ক প্রকল্পটি জানুয়ারি ২০১৮ অনুমোদিত হয়েছে। এতে প্রাক্কলিত বাজেট ৩৮৬০.৮২ কোটি টাকা। বর্তমানে প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের ৩১৭ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ৮৫% কাজ অর্থাৎ আনুমানিক ২৭০ কিলোমিটার কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে জানা গেছে। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড।
সীমান্ত সড়কের গুরুত্ব
যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্পের প্রথম উপকারভোগী হচ্ছে স্থানীয় মানুষ। স্বাভাবিকভাবেই সীমান্ত সড়কেরও প্রধান উপকার ভোগী হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্ত তথা দুর্গম এলাকায় বসবাসকারী বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ ও স্থানীয় বাঙালিরা। এই সীমান্ত সড়ক তাদের জীবনমান উন্নয়নে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। বিশেষ করে সীমান্ত সড়কের মাধ্যমে তারা পরস্পরের মধ্যে কানেক্টিভিটি তথা যোগাযোগ বৃদ্ধি করে তাদের জীবন মানের উন্নয়ন ঘটাবে নিজেরাই। এছাড়াও তারা আগে যেখানে পৌঁছাতে চার পাঁচ ঘন্টা লাগতো এখন সেখানে ২০-৩০ মিনিটে পৌঁছে যেতে পারবে। এর ফলে তাদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে। শিশুরা শিক্ষার্থীরা দূরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে পড়াশোনা করতে পারবে। ফলে তাদের শিক্ষার হার বাড়বে। অসুস্থ রোগীদের সীমান্ত সড়ক ব্যবহার করে দ্রুত উপজেলা বা জেলা সদরের হাসপাতালে নিয়ে আসতে পারবে। ফলে অসংখ্য জীবন রক্ষা পাবে। সীমান্ত সড়কের ফলে স্থানীয় কৃষকেরা তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণে বেশ সুবিধা পাবে। বিশেষ করে তাদের পণ্যগুলো বাজারে আনা নেয়ায় সময় ও খরচ সাশ্রয়ী হবে। এই সড়ক ব্যবহার করে দূরের আমদানিকারকরা স্থানীয় বাজারে পণ্য সংগ্রহ করতে যেতে পারবে। ফলে স্থানীয় কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের ভালো মূল্য পাবে। সড়কের কারণে শহরের সাথে তাদের যোগাযোগ বৃদ্ধি করার ফলে তাদের লিভিং স্ট্যান্ডার্ড অনেক উন্নত হবে। সামাজিকভাবে তারা দুর্গম এলাকায় বসবাসে আগের থেকে আরো অনেক বেশি নিরাপত্তা বোধ করবে। সীমান্ত সড়ক পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নে কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে সে বিষয়ে নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
যোগাযোগ
সীমান্ত সড়কের ফলে পাহাড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে। সীমান্ত সড়ক স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ এবং জীবনমানের উন্নয়নের পাশাপাশি জাতীয় উন্নয়নেও ব্যাপক অবদান রাখবে। এই সীমান্ত সড়ক পাহাড়ের সাথে সমতলের যোগাযোগ বৃদ্ধি করবে। সীমান্ত সড়কের মাধ্যমে পাহাড়ের অত্যন্ত গভীরে ও প্রত্যন্ত এলাকায় মানুষের যাতায়াত বাড়বে। ফলে পাহাড়ের সাথে সমতলের দূরত্ব কমবে এবং আন্তঃসম্পর্ক বৃদ্ধি পাবে। যেকোন প্রয়োজনে তারা খুব দ্রুত শহরে যেতে পারবে এবং নাগরিক সুবিধাগুলো তাদের কাছে পৌঁছানোর সহজতর হবে। এই সড়কে যেসকল যানবাহন চলাচল করবে সেসকল যানবাহনের মালিক, চালক, সহকারি, মেকানিক, এবং পরিবহন ব্যবসার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত বিভিন্ন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এতে স্থানীয়রা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে।
অর্থনীতি
সীমান্ত সড়ক পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। যা প্রকারান্তরে জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে পাহাড়ে নতুন নতুন উদ্যোগ, উদ্যোক্তা ও স্কোপ সৃষ্টি হবে। বিভিন্ন ধরনের কর্মসংস্থানমূলক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে। স্থানীয় কাঁচামাল নির্ভর ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প গড়ে উঠবে। স্থানীয়ভাবে তৈরি বিভিন্ন হস্তশিল্প ও পণ্য শহরে বা দেশের বিভিন্ন প্রান্তরে পৌঁছানো সহজ হবে। দূর দূরান্তের ব্যবসায়ীরা এই সড়ক সুবিধা ব্যবহার করে পাহাড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে তাদের উৎপাদিত ফসল ও পণ্য সংগ্রহ করবে ফলে তারা তাদের উৎপাদিত ফসল ও পণ্যের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে পারবে। সীমান্ত সড়ক পাহাড়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিপুল কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করবে- যা পাহাড়ের অর্থনীতিতে ব্যাপকভাবে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।
শিক্ষা
পাহাড়ের শিক্ষা বিস্তারের অন্যতম প্রধান অন্তরায় দুর্গমতা ও অপ্রতুল যোগাযোগ ব্যবস্থা। দূর্গমতার কারণে যেমন পাহাড়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা কঠিন। তেমনি সেখানে ভালো কোন শিক্ষক যেতেও অনাগ্রহী থাকে। ফলে পাহাড়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হয় স্থানীয় স্বল্পশিক্ষিত বর্গা শিক্ষকদের মাধ্যমে। সীমান্ত সড়কের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ার ফলে যেমন সেখানে উন্নত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব হবে, তেমনি দক্ষ শিক্ষকগণ সহজে সেখানে গিয়ে পাঠদান করতে আগ্রহী হবে। অর্থাৎ তারা ক্লাস নিয়ে আবার চলে আসতে পারবে। এছাড়াও যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রত্যূলতার কারণে নারী ও শিশুদের দূর-দূরান্তের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গিয়ে শিক্ষা গ্রহণ সম্ভব হতো না। এখন উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে সহজেই তারা দূরের ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে উন্নত শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে। এতে পাহাড়ের যেমন শিক্ষার হার যেমন বাড়বে। সেই সাথে শিক্ষিত মানুষ তাদের জীবন মানের উন্নয়ন নিজেরাই ঘটাতে সক্ষম হবে।
স্বাস্থ্য
পাহাড়ে বসবাসকারী মানুষের স্বাস্থ্য সমস্যা ও উন্নত চিকিৎসার প্রধান অন্তরায় অপ্রতুল যোগাযোগ ব্যবস্থা। যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে সেখানে যেমন ভাল হাসপাতাল গড়ে তোলা সম্ভব হতো না, তেমনি উন্নত চিকিৎসা সামগ্রী প্রেরণ করাও সম্ভব হতো না। এছাড়াও দুর্গমতার কারণে ভালো ডাক্তার সেখানে থাকতে চাইতো না। ফলে হাসপাতাল থাকলেও ডাক্তারের অভাবে স্থানীয় জনগণ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পেত না। বিশেষ করে জরুরি প্রয়োজনে অসুস্থ রোগীকে দ্রুত শহরের হাসপাতালে পাঠানো ছিল সবচেয়ে কঠিন কাজ। সীমান্ত সড়ক এই সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করার এক অভূতপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। এই সড়ক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে যেমন প্রত্যন্ত অঞ্চলে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা যাবে এবং উন্নত চিকিৎসা সামগ্রী প্রেরণ করা যাবে। একই সাথে দক্ষ চিকিৎসকগণ সেখানে গিয়ে চিকিৎসা দিতে আগ্রহী হবেন। একই সাথে কোনো সঙ্কটাপন্ন রোগীকে দ্রুত শহরে হাসপাতালে পাঠানো সহজতর হবে। এতে পাহাড়ের স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক উন্নতি ঘটবে এবং অনেক জীবন রক্ষা পাবে।
কৃষি
পার্বত্য চট্টগ্রাম মূলত একটি কৃষি নির্ভর এলাকা। এই এলাকার প্রায় সকল মানুষই কৃষি উপর নির্ভরশীল। কিন্তু পর্যাপ্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকার কারণে তাদের পক্ষে আধুনিক কৃষি সরঞ্জাম ও কৃষি উপকরণ ব্যবহার করা সম্ভব ছিল না। এছাড়া তাদের উৎপাদিত কৃষি পণ্যের সঠিক দাম তারা পেত না। কেননা ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণ ছিল অত্যন্ত কষ্টকর ব্যাপার। অনেক সময় বাজারজাত করণের অভাবে উৎপাদিত ফল ও ফসল নষ্ট হতো অথবা কমদামে বিক্রি করতে বাধ্য হতো। এই সীমান্ত সড়ক নির্মাণের ফলে একদিকে যেমন কৃষকরা তাদের কৃষি সরঞ্জাম ও উপকরণ সহজে জমিতে বহন করে নিয়ে যেতে পারবে। অন্যদিকে উন্নত কৃষি উপকরণ তাদের কাছে সহজলভ্য হবে। এরফলে তাদের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। একই সাথে উৎপাদিত পণ্য খুব সহজেই বাজারজাত করতে পারবে। পণ্যের সঠিক মূল্য পাওয়ার কারণে তারা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে।
ব্যবসা-বাণিজ্য
সীমান্ত সড়ক নির্মাণের ফলে পার্বত্য এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যগুলো যেমন খুব সহজে বাজারজাত করা সম্ভব হবে। একই সাথে তারা বড় শহরের ব্যবসায়ীদের যোগাযোগ করে পণ্য পাঠাতে পারবে। দূরদূরান্তের ব্যবসায়ীরা সীমান্ত সড়ক ব্যবহার করে পার্বত্য অঞ্চলের প্রত্যন্ত বাজারগুলোতে যাতায়াত করতে পারবে এবং সেখানে উৎপাদিত পণ্য ক্রয় করে শহরগুলোতে নিয়ে আসতে পারবে। এর ফলে পাহাড়ে ব্যবসা বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজলভ্য হওয়ার কারণে নতুন ব্যবসায়িক উদ্যোগ ও বিনিয়োগ প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে।
শিল্প
সীমান্ত সড়ক নির্মাণের ফলে পাহাড়ে উৎপাদিত কৃষি নির্ভর ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প গড়ে উঠবে। যাতায়াত সুবিধার কারণে বিনিয়োগকারীরা সেখানে শিল্প কারখানা গড়ে তুলতে উৎসাহী হবেন। একই সাথে সেখানকার ঐতিহ্যবাহী হস্ত ও কারুশিল্প পণ্য শহরে রপ্তানি করা সহজ হওয়ায় এখাতে বিনিয়োগ বাড়বে। এতে একদিকে যেমন পাহাড়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, অন্যদিকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে স্থানীয় জনগণ।
পর্যটন
উন্নয়ন অধ্যয়নে বলা হয়ে থাকে, মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সাথে বিনোদনের চাহিদাও বৃদ্ধি পায়। এসব বিনোদনের মধ্যে টুরিজম বা ভ্রমণ অন্যতম খাত। বিগত এক দশকে বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারণে পর্যটন বা ভ্রমণ প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু আয়তনে ক্ষুদ্র এবং আকর্ষণীয় প্রাকৃতিক পর্যটন স্পটের স্বল্পতা কারণে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ টুরিজম সেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। যে কয়টি পর্যটন স্পট রয়েছে সেগুলোতে মানুষ যেতে যেতে অনাগ্রহী হয়ে উঠবে একসময়। এতে বাংলাদেশের মানুষ ভ্রমণের পিপাসা মেটাতে বিদেশমুখী হবে। এতে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে যাবে। তাই পর্যটন খাতে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় ও অর্জন করতে বাংলাদেশে নতুন নতুন পর্যটন স্পট এক্সপ্লোরেশন করার বিকল্প নেই। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়া দেশে এমন সম্ভাবনাময় স্থান খুবই অপ্রতুল। দূর্গমতার কারণে সেটাও আধেয় হয়ে ওঠেনি। সীমান্ত সড়ক সে সুযোগের দ্বার উন্মোচন করেছে।
সীমান্ত সড়কের কারণে পাহাড়ে পর্যটন খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা দূর্গমতা ও অবকাঠামোর অভাবে পাহাড়ের যেসব অঞ্চলে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পর্যটন স্পট গড়ে ওঠেনি, সীমান্ত সড়ক নির্মাণের ফলে পাহাড়ে নতুন নতুন পর্যটন স্পট গড়ে উঠবে। এবং খুব সহজেই দেশ ও বিদেশের পর্যটকরা সীমান্ত সড়ক ব্যবহার করে সেসকল পর্যটন স্পট ভ্রমণ করবে। পর্যটকেরা শুধু ভ্রমণ খাতে নয়, পাহাড়ে উৎপাদিত ফল, ফসল ও পণ্য ক্রয় করবে। এতে করে একদিকে যেমন পাহাড়ের নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, তেমনি অর্থনীতিতে আসবে নতুন জোয়ার।
নিরাপত্তা
সীমান্ত সড়কের ফলে পাহাড়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বিপ্লবী পরিবর্তন আসবে। দুর্গমতার সুযোগ নিয়ে সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যেসব অঞ্চলে আস্তানা গেঁড়েছিল, সীমান্ত সড়ক নির্মাণের ফলে নিরাপত্তা বাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী খুব সহজেই এবং দ্রুত ওইসব অঞ্চলে পৌঁছাতে পারবে। ফলে সন্ত্রাসীদের পক্ষে সন্ত্রাস কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। একই সাথে দুর্গম এলাকার মানুষকে জিমি করে তারা যেভাবে চাঁদাবাজি সন্ত্রাস ও নির্যাতন চালিয়ে আসছিল, দূর্গমতার কারণে মানুষ বাধ্য হয়ে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সাহস করত না এখন সীমান্ত সড়ক নির্মাণের ফলে নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত টহল ও যাতায়াতের ফলে মানুষের সাহস ও আস্থা বৃদ্ধি পাবে। ফলে তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নিতে সাহসী হবে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত টহলের ফলে চাঁদাবাজি, অপহরণ, নির্যাতন, সন্ত্রাসী কার্যক্রম হ্রাস পাবে। এতে করে স্থানীয় জনগণের জীবনে নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়াও সীমান্তে পুলিশ, বিজিবির পেট্রলিং সহজ হওয়ার কারণে আন্তঃসীমান্ত অস্ত্র চোরাচালান ও সন্ত্রাসীদের চলাচল নিয়ন্ত্রণে এই সড়ক নেটওয়ার্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ইতোমধ্যেই স্থানীয় সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর সীমান্ত সড়কের বিরোধিতা থেকে বোঝা যায়, এ সড়ক নেটওয়ার্ক তাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।
মাদক নিয়ন্ত্রণ
দুর্গমতার সুযোগ নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের পৃষ্ঠপোষকতায় বা নির্দেশে পাহাড়ের সাধারণ কৃষকদের কিছু অংশ গাঁজা, পপির মতো মাদক চাষ করে থাকে। পর্যাপ্ত সড়ক যোগাযোগের অভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনেক সময় এসবের খোঁজ পায় না বা অভিযান চালাতে পারে না। সীমান্ত সড়ক নির্মাণের ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখন খুব সহজেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করতে পারবে। এ ছাড়াও গোল্ডেন ট্রায়াংঙ্গলের অংশ হিসেবে এ অঞ্চলে আন্তঃসীমান্ত মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণে সীমান্ত সড়ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এ ছাড়াও সীমান্তে পুলিশ, বিজিবির পেট্রলিং সহজ হওয়ার কারণে আন্তঃসীমান্ত মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণে এই সড়ক নেটওয়ার্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ
দুর্গমতার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে আন্তঃসীমান্ত চোরাচালানীরা সহজেই চোরাচালান করে থাকে। পর্যাপ্ত সড়ক যোগাযোগ না থাকায় বিজিবি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চোরাচালানিদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট কার্যক্রম পরিচালনা করতে সক্ষম ছিলো না। সীমান্ত সড়ক নির্মাণের ফলে এখন বিজিবি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খুব সহজেই চোরাচালানিদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে পারবে। এছাড়াও সীমান্তে টহল জোরদার করা সম্ভব হলে চোরাচালান হ্রাস পাবে।
সীমান্ত নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনা
আমরা জানি দুর্গমতার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সীমান্ত নিরাপত্তা দুর্বল। এখানকার অনেক স্থানে নিয়মিত, জরুরী ও দ্রুত টহল দেয়া সম্ভব হয় না। সীমান্ত সড়ক নির্মাণের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম সীমান্তগুলোতে নিয়মিত, জরুরী পরিস্থিতিতে দ্রুত টহল প্রদান সম্ভব হবে। এছাড়াও সীমান্তের দুই পারের নিরাপত্তা রক্ষীরা পারস্পারিক যোগাযোগের মাধ্যমে সীমান্তের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে। এতে সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। এছাড়াও দুর্গমতার কারণে এখানকার সন্ত্রাসীদের আক্রমণ প্রতিহত ও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে দ্রুত রেসপন্স করা সম্ভব হয় না অনেক সময়। এই সড়ক নেটওয়ার্কের ফলে এই সীমাবদ্ধতা দুর হবে অনেকাংশে।
আঞ্চলিক যোগাযোগ ও বাণিজ্য
সীমান্ত সড়ক শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে তাই নয়, বরং এটি আঞ্চলিক তথা বাংলাদেশ-ভারত ও বাংলাদেশ মিয়ানমার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে বিশাল ভূমিকা রাখবে। এই সীমান্ত সড়কের ফলে রামগড়- সাবরুম, থেগামুখ স্থলবন্দর, ঘুমধুম-মংডু ও মিয়ানমারের চীন রাজ্যের সাথে যোগাযোগ ও বাণিজ্য সুযোগ বৃদ্ধি করবে। সীমান্ত হাটগুলো কার্যকর হতে পারবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপকভাবে ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক বাণিজ্য ও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠবে।
আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস ও বিচ্ছিন্নতাবাদ দমন
সকলেই জানেন পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্তবর্তী তিন দেশেই সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। মূলত দুর্গমতার সুযোগ নিয়ে এসব বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। দুর্গম সীমান্তের সুযোগ নিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসবাদীরা সীমান্তের উভয় পাড়ে যাতায়াত, অপহরণ, পলায়ন, ঘাঁটি নির্মাণ, অস্ত্র ও মাদক চোরাচালানের মত ভয়ঙ্কর সমাজ ও রাষ্ট্র বিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। চলমান সীমান্ত সড়ক সম্পূর্ণ রূপে নির্মিত হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্ত প্রহরা, সীমান্ত নিরাপত্তা ও সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে তাতে আন্তঃসীমান্ত বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী ও চোরাচালানীদের তৎপরতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে।
মোদ্দা কথা, বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত এই সীমান্ত সড়ক এমন একটি মেগা প্রজেক্ট যা কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক উন্নয়নেই ভূমিকা রাখবে না বরং জাতীয় ও আঞ্চলিক অর্থনৈতিক, যোগাযোগ, বাণিজ্যিক, পর্যটন, সীমান্ত নিরাপত্তা, চোরাচালান, অস্ত্র ও মাদক পাচার, সন্ত্রাস ও বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে এক বৈপ্লবিক ভূমিকা পালন করবে। ♦ লেখক: চেয়ারম্যান, সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশন, সম্পাদক, পার্বত্যনিউজ।