ডেস্ক রির্পোট:- বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী বাতাসের মানে অবনতি ঘটছে। যার ফলে মানুষের মধ্যে নানা রোগের প্রভাব দেখা দিতে শুরু করেছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বায়ুদূষণ বাংলাদেশে মৃত্যুর প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বায়ুদূষণে মৃত্যুর হার উচ্চ রক্তচাপ, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও তামাকের কারণে হওয়া মৃত্যুর হারকেও ছাড়িয়ে গেছে। বায়ুদূষণজনিত রোগে সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে শিশুরা। বায়ুদূষণের কারণে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যু হারে ২০২১ সালে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম।
বৃহস্পতিবার (২০ জুন) ইউনিসেফের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট (এইচইআই) থেকে প্রকাশিত নতুন এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী বাতাসের মানের উদ্বেগজনক অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে।
স্টেট অব গ্লোবাল এয়ারের (এসওজিএ) ২০২৪ সালের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়াসহ পূর্ব-পশ্চিম, মধ্য এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় আফ্রিকার দেশগুলোতে বায়ুদূষণজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি। শুধু ২০২১ সালেই বাংলাদেশে ২ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি মৃত্যুর কারণ ছিল এই বায়ুদূষণ, যা জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বড় ধরনের এক চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে উচ্চ রক্তচাপের কারণে দুই লাখ, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের কারণে এক লাখ ৩০ হাজার ৪০০ ও তামাকের কারণে এক লাখ ৩০ হাজার ১০০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুরা বেশি বায়ুদূষণজনিত রোগের শিকার হয়ে থাকে। এর প্রভাবে অপরিণত অবস্থায় জন্মগ্রহণ, কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ, হাঁপানি ও ফুসফুসের রোগসহ বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দেয়। বাংলাদেশসহ আফ্রিকা ও এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে লোয়ার-রেসপাইরেটরি-ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বা নিম্ন শ্বাসনালির সংক্রমণে পাঁচ বছরের কম বয়সি যত শিশুর মৃত্যু হয়, তার ৪০ শতাংশের জন্যই দায়ী বায়ুদূষণ। ২০২১ সালে বাংলাদেশে বায়ুদূষণের কারণে ১৯ হাজারেরও বেশি পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যু রেকর্ড করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০২১ সালে বায়ুদূষণ সম্পর্কিত কারণে বিশ্বব্যাপী পাঁচ বছরের কম বয়সী ৭ লাখের বেশি শিশুর মৃত্যু হয়। সারা বিশ্বে এই বয়সী শিশুদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে ‘অপুষ্টির’ পরই ‘বায়ুদূষণ’ দ্বিতীয় শীর্ষস্থানীয় ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। মারা যাওয়া এই শিশুদের মধ্যে প্রায় ৫ লাখ শিশুর মৃত্যু হয়েছে আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে; দূষিত জ্বালানি ব্যবহার করে ঘরের ভেতরে রান্না করাই ছিল এই বায়ুদূষণের কারণ।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে ব্যাপক হারে ওজোন গ্যাসের উপস্থিতি রয়েছে, যা বায়ুদূষণজনিত রোগের অন্যতম কারণ। ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী ওজোন-সম্পর্কিত ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিসঅর্ডার (সিওপিডি)-জনিত মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ৫০ শতাংশ। এর মধ্যে ভারতে ২ লাখ ৩৭ হাজার, চীনে ১ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ এবং বাংলাদেশে ১৫ হাজারের মৃত্যু হয়েছে।
শিশুর স্বাস্থ্যের ওপর বায়ুদূষণের ভয়াবহ প্রভাব বেশ পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে। বায়ুদূষণের ফলে শিশুদেরই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেখা যায়; বায়ুদূষণের ক্ষতিকর এই প্রভাব, শিশু মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থাতেই শুরু হয়ে সারা জীবনের জন্য স্থায়ী হতে পারে। প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুরা তাদের শরীরের ওজোনের অনুপাতে বেশি বাতাস গ্রহণ করে। দূষিত বায়ুর সঙ্গে তারা দূষিত সব উপাদানও গ্রহণ করে থাকে। যার ফলে মারাত্মক প্রভাব পড়ে তাদের বিকাশমান, ফুসফুস, শরীর ও মস্তিষ্কের ওপর।
জরুরি পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে বাংলাদেশে ইউনিসেফের রিপ্রেজেন্টেটিভ শেলডন ইয়েট বলেন, লাখ লাখ মানুষ, বিশেষ করে শিশুরা স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। নিম্নমানের বাতাসে ক্ষতিকর প্রভাব শিশুদের ওপরই বেশি দেখা যায়। এর প্রভাবে তারা হাঁপানি ও নিউমোনিয়ার মতো রোগে আক্রান্ত হয়। শুধু আজকে আমাদের শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্য নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও বাতাসের গুণগত মান উন্নত করতে টেকসই সমাধান বাস্তবায়ন করা গুরুত্বপূর্ণ।
প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম। তিনি বলেন, গত ২০ বছরে আমরা বায়ুদূষণের বিষয়ে অনেক কথা বলেছি। কিন্তু যখন যথাযথ উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়টি আসে, তখন আমরা খুব কমই পদক্ষেপ দেখতে পাই। এমনকি যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, প্রয়োজনের তুলনায় সেগুলো খুবই অপ্রতুল। গবেষণাটিতে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক—উভয় ধরনের দূষণের বিপদ এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণের কারণে শিশুদের ঝুঁকির বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।