ডেস্ক রির্পোট:- সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের ভয়াবহ দুর্নীতির তথ্য সামনে আসায় পুলিশের ভেতরে বিব্রতকর অবস্থা তৈরি হয়েছে। পরিবার, স্বজন কিংবা বন্ধুদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছেন বাহিনীর বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা। থানা থেকে সদর দপ্তর পর্যন্ত চলছে বেনজীরকাণ্ড নিয়ে আলোচনা। তবে ব্যক্তি বেনজীরের অপকর্মের দায় যাতে বাহিনীতে না পড়ে, সেজন্য তার অনিয়ম-দুর্নীতির শাস্তি চান পুলিশের সৎ কর্মকর্তারা। অন্যদিকে, পুলিশের ভেতর বেনজীর বলয়ের লোক হিসেবে পরিচিতরা অনেকটা নীরব হয়ে আছেন। বিশেষ করে সাবেক আইজিপির বিভিন্ন অপকর্মের সহযোগীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে বলে জানা গেছে।
পুলিশ সূত্রের খবর, বেনজীর আহমেদ ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি) হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে র্যাবের মহাপরিচালক এবং সর্বশেষ আইজিপির দায়িত্ব পালন পর্যন্ত বাহিনীর ভেতরে নিজস্ব একটি বলয় তৈরি করেছিলেন। সেই বলয়ের সদস্যদের দিয়ে পুলিশের কেনাকাটা, রেশন ও পরিবহন নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে সব কাজ করিয়েছেন। দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিঘায় বিঘায় জমি কেনা থেকে শুরু করে তা দেখভাল করার কাজেও লাগিয়েছেন পুলিশের সদস্যদের। শক্তিশালী ওই বলয়ের কাছে পেশাদার কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন কোণঠাসা হয়েছিলেন।
পুলিশের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, বেনজীর বলয়ে দুই ধরনের লোক ছিল। এক গ্রুপকে পুলিশের কেনাকাটাসহ আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ আছে, এমন পদগুলোতে বসানো হতো। আরেক গ্রুপকে পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন জেলায় পদায়ন করা হতো।
এদের দিয়েই মূলত দাপট খাটিয়ে জমি কেনা থেকে শুরু করে সব করাতেন বেনজীর। তারাই এসব সম্পদ দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করতেন।
ওই কর্মকর্তা বলেন, বেনজীরের সম্পদ বাড়াতে গিয়ে কেউ কেউ নিজেও সম্পদশালী হয়েছেন। আরেকটা গ্রুপ তোষামোদি করে বদলি বা পদায়নে সুবিধা নিয়েছেন।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের নানা স্তরে বেনজীরের সুবিধাভোগী রয়েছেন, যারা তার আমলে প্রভাব খাটিয়েছেন বাহিনীতে। গুরুত্বপূর্ণ জেলাগুলোর এসপি থেকে শুরু করে ঢাকা মহানগর পুলিশসহ (ডিএমপি) বিভিন্ন মহানগর পুলিশ, রেঞ্জ ও গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটগুলোতে বেনজীরের আমলে তারা দায়িত্ব পালন করেছেন। এই গ্রুপের প্রভাবে সিনিয়র কর্মকর্তারাও তখন কোণঠাসা হয়ে থাকতেন।
সূত্র বলছে, বেনজীর আহমেদ ডিএমপি কমিশনার থাকাকালে একজন উপকমিশনার পুরো রাজধানী দাপিয়ে বেড়াতেন। ওই কর্মকর্তা কমিশনারের ওপর ভর করে অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। বর্তমানে সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি পদে রয়েছেন তিনি। বেনজীর আইজিপির দায়িত্ব পালনকালে সদর দপ্তরের দাপুটে এক এআইজি এখন উত্তরাঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটে রয়েছেন। সাবেক আইজিপির ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত একজন এসপি রয়েছেন দেশের পূর্বাঞ্চলের একটি জেলায়। ঢাকায় পুলিশের একটি সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানে ডিআইজি পদে রয়েছেন তার একজন সহযোগী। তেমনি পুলিশ সদর দপ্তরে রয়েছেন একজন অতিরিক্ত ডিআইজি, যিনি বেনজীরের সব অবৈধ সম্পত্তির কাগজপত্র যাচাই করতেন। পুলিশ সদর দপ্তরেই একজন অতিরিক্ত আইজিপি রয়েছেন, যিনি বেনজীরের পুরো আমলেই ভালো পদায়ন পান। ওই কর্মকর্তা নিজে সৎ হিসেবে পরিচিত হলেও বেনজীরের অবৈধ আয়ের সহযোগী ছিলেন। এ ছাড়া ডিএমপির একটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটের অতিরিক্ত ডিআইজিসহ বিভিন্ন ইউনিটে অন্তত ২০ জন কর্মকর্তা রয়েছেন, যারা বেনজীরকে নানা অবৈধ সুযোগ করে দিয়ে কিংবা বেনজীরের অবৈধ আদেশ পালন করে নিয়মিত পদোন্নতি ও পদায়ন নিয়েছেন। এ ছাড়া তিনি ডিএমপি কমিশনার থাকাকালে সরকার বলয়ের বাইরে অন্তত তিন কর্মকর্তাকে গুরুত্বপূর্ণ পদে রেখে তাদের দিয়ে টাকা হাতিয়েছেন। ওই কর্মকর্তারা এরই মধ্যে অবসরে গেছেন।
বিভিন্ন জায়গায় দায়িত্ব পালন করা বেনজীর ২০১০ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ডিএমপি কমিশনার ছিলেন। এরপর র্যাব মহাপরিচালক হিসেবে ২০২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল আইজিপি পদে যোগ দিয়ে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর অবসরে যান।
পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, বেনজীরের এই গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনকালে পুলিশের কারা কোন পদে ছিলেন, সেটা খুঁজলেই তার সহযোগীদের সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সাবেক আইজিপি বা র্যাবপ্রধান হিসেবে বেনজীর আহমেদ যে অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন, অনাচার করেছেন এবং মানুষকে জিম্মি করে বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জিম্মি করে সার্বিকভাবে যেটা করেছেন, সেটা তিনি এককভাবে করেছেন, তা ভাবার কোনো সুযোগ নেই। এখানে মূলহোতা হিসেবে তাকে যেমন জবাবদিহি করতে হবে, এটা যেমন রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং একইভাবে যারা এই যোগসাজশে জড়িত এবং তাকে সুরক্ষা দিয়েছেন, তাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনা দরকার।’
তিনি বলেন, ‘বেনজীরের সঙ্গে যারা যোগসাজশ করেছেন, তাদেরও জবাবদিহির আওতায় না আনলে এই ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো প্রতিকার হবে না। রাষ্ট্রকে এই বার্তা দিতে হবে যে, যে কোনো অবস্থান থেকেই অপরাধ করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই।’
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নথি অনুযায়ী, বেনজীর ও তার পরিবার ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে অন্তত ২০৪ দশমিক ৫ একর জমির মালিক হয়েছেন। এর মধ্যে পুলিশ ও র্যাবের প্রধান থাকার সময়ে কিনেছেন ১১২ একর জমি। ঢাকা, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর ও কক্সবাজারে তার এবং তার স্ত্রী ও তিন মেয়ের মালিকানাধীন জমির সন্ধান পেয়েছেন দুদকের তদন্তকারীরা। ঢাকার গুলশানে রয়েছে অভিজাত চার ফ্ল্যাট আর গোপালগঞ্জে ন্যাচারাল পার্ক। অবশ্য পুলিশ সূত্রের খবর, বেনজীর অন্যের নামেও নানা সম্পদের মালিক হয়েছেন, নানা কোম্পানিতে রয়েছে মালিকানা শেয়ার। বিদেশে রয়েছে নানা সম্পদ।
কিন্তু তিনি কীভাবে এত সম্পদের মালিক হলেন? পুলিশ সূত্রের খবর, বেনজীরের বড় আয়ের উৎস ছিল পুলিশের কেনাকাটা। তিনি ডিএমপি কমিশনার থাকাকালে ডিএমপি অফিস থেকেই কেনাকাটা করাতেন। এই কেনাকাটায় লজিস্টিক বিভাগে নির্দিষ্ট উপকমিশনার থাকলেও তিনি নিজস্ব কর্মকর্তা দিয়ে শুধু স্বাক্ষর নিয়ে কেনাকাটা করতেন। কিন্তু বেনজীর যখন আইজিপি পদে যোগ দেন, তখন এই কেনাকাটাকে তিনি কেন্দ্রীয়করণ করেন। অর্থাৎ সারা দেশে পুলিশের যত ধরনের কেনাকাটা আছে, তা পুলিশ সদর দপ্তর ক্রয় করার নিয়ম করেন তিনি। এরপর নিজের পর্যন্ত প্রতিষ্ঠান থেকে কেনাকাটা করা হতো।
পুলিশ সূত্র জানায়, পুলিশের কাগজ, কলম, পোশাক, অস্ত্র-গুলি, লাঠি-হ্যালমেট, গাড়িসহ এই ধরনের কেনাকাটায় পুলিশ বাহিনীতে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয় বছরে। এসব কেনাকাটায় যেগুলোতে টেন্ডার দরকার হতো, সেগুলোতে লোক দেখানো টেন্ডার হলেও মূলত বেনজীর সিন্ডিকেট কেনাকাটার দায়িত্ব পেত। এ থেকে তিনি বড় অঙ্কের কমিশন হাতিয়ে নিতেন। এর বাইরে পুলিশ বাহিনীতে শত শত কোটি টাকার সোর্স মানি রয়েছে। এই টাকার কোনো আনুষ্ঠানিক হিসাব না হওয়ায় বেনজীর বড় অঙ্ক নিজের কাছে রেখে দিতেন। তার আমলে প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের ইউনিটে প্রয়োজনীয় সোর্স মানি দেওয়া হলেও বেশিরভাগ ইউনিটে নামমাত্র সোর্স মানি সরবরাহ করতেন তিনি।
ঢাকা মহানগর পুলিশে দায়িত্ব পালন করছেন—এমন একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বেনজীরের আমলে কেনা কলম থেকে শুরু করে কোনো ইক্যুইপমেন্ট তারা ব্যবহার করতে পারতেন না। কলমের কালি বেরিয়ে পোশাক নষ্ট হওয়ার অবস্থায় চলে গিয়েছিল ওই সময়ে। কাপড়ের মান খারাপ হওয়ায় কনস্টেবলরাও ইউনিফর্ম পরতেন কষ্ট করে।
ওই কর্মকর্তারা বলেন, পুলিশের রেশন আর পরিবহনের জ্বালানি ক্রয় ও পরিবহন ব্যবস্থাপনায় প্রতি বছর বড় অঙ্কের টাকা খরচ হয়। এসব খাতেও বেনজীরের ঘনিষ্ঠজন ছাড়া কেউ দায়িত্ব পেতেন না। তার লোকজন কমিশন পৌঁছে দিতেন তাকে।
সূত্র বলছে, বেনজীরের অবৈধ আয়ের বড় উৎস ছিল পুলিশের আবাসনের জমি কেনা ও দেশের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ স্থাপনা নির্মাণ। পুলিশ আবাসনের জমি ক্রয়ের সময়ে তিনি প্রভাব বিস্তার আবাসন কোম্পানিকে নামমাত্র টাকা দেন। কিন্তু পুলিশের কাছ থেকে বাজারমূল্য পরিশোধ দেখান। এজন্য তার নিজস্ব বলয়ের কমিটি কাজ করেছে। এ ছাড়া বেনজীরের আমলে দেশের যেখানেই পুলিশ ব্যারাক, থানা ভবন, পুলিশ লাইন্সসহ পুলিশের স্থাপনা হয়েছে, এসব খাত থেকেও বড় অঙ্কের কমিশন হাতিয়েছেন তিনি। এর বাইরে বিভিন্ন প্রভাবশালীকে অনৈতিক সুযোগ দিয়ে টাকা কামিয়েছেন। এসব ক্ষেত্রেও ব্যবহার করেছেন পুলিশ সদস্যদেরই।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, বদলি বা পদায়নের ক্ষেত্রে বেনজীর খুব একটা সুযোগ নিতেন না। তবে নিজের অনুগতদের সুবিধাজনক ইউনিট ও পদে পদায়ন করে তাদের মাধ্যমে পরে নানা সুযোগ নিতেন তিনি। যারা বেনজীরের কাছ থেকে বদলি-পদোন্নতির মতো সুযোগ নিয়েছেন, তারা এখন বেশ আতঙ্কে। একসময়ে হাঁকডাক দেওয়া প্রভাবশালী ওই কর্মকর্তারা এখন চুপচাপ অফিস করছেন। অনেকে ভোল পাল্টে তার বিরুদ্ধে নানা সমালোচনাও করছেন। তবে পুলিশের ভেতর থেকেই এদের চিহ্নিত করা উচিত বলেও আলোচনা শুরু হয়েছে।কালবেলা