ডেস্ক রির্পোট:- পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের আরো বিপুল সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল বুধবার আদালতের আদেশে এসব সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। এর ফলে বেনজীর ও তাঁর পরিবারের সম্পদ জব্দের হ্যাটট্রিক করল দুদক। তৃতীয় দফায় তাঁদের নামে বান্দরবানে ৭৫ বিঘাসহ মোট ৭৭ বিঘা জমি, রূপগঞ্জে ১০ কোটি টাকা মূল্যের বাংলো, উত্তরায় সাততলা বাড়ি, আদাবর-বাড্ডায় আটটি ফ্ল্যাট, মাছ ও গরুর খামার, টেলিভিশন চ্যানেল ও গার্মেন্টসের শেয়ারের তথ্য পাওয়া গেছে।
গতকাল দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা উপপরিচালক হাফিজুল ইসলামের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন বেনজীরের এসব অবৈধ সম্পদ জব্দ করার আদেশ দেন। নিয়ম অনুযায়ী, আদালতের আদেশের মধ্য দিয়ে এসব অবৈধ সম্পদ জব্দ করে দুদক।
দুদক সূত্র জানায়, বেনজীর এই সম্পদগুলো বিক্রির চেষ্টা করছেন—এ ধরনের তথ্য পেয়ে সম্পদগুলো জব্দ করতে আদালতের দ্বারস্থ হয় দুদক। আদালত দুদকের আবেদন আমলে নিয়ে বেনজীরের সম্পদ জব্দের আদেশ দেন।
দুদকের আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে, আরো সম্পদের তথ্য পেলে একই ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তৃতীয় দফায় জব্দ করা অবৈধ সম্পদের মালিকানায়ও যথারীতি বেনজীর আহমেদ, তাঁর স্ত্রী জীশান মীর্জা, তিন মেয়ে ফারহিন রিস্তা বিনতে বেনজীর, তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীর, জাহরা জারিন বিনতে বেনজীর এবং তাঁদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
এদিকে বেনজীর, তাঁর স্ত্রী ও দুই মেয়েকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুই দফা ডাকলে তাঁরা দুদকে হাজিরা দেননি। ফলে আগামী ২৩ জুন তাঁদের হাজির হতে বলেছে দুদক।
এর আগে ২৩ ও ২৬ মে দুই দফা বেনজীর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা ৬২১ বিঘা জমি ও ১৯টি কম্পানির শেয়ার, গুলশানে চারটি ফ্ল্যাট জব্দের আদেশ দেন আদালত। জব্দের পর গত ৭ জুন সম্পদগুলোর মালিকানা থেকে বেনজীরকে সরিয়ে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়। সম্পদের পাশাপাশি ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, ৩৩টি ব্যাংক হিসাব এবং তিনটি বিও হিসাব (শেয়ার ব্যবসার বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট) অবরুদ্ধ করার আদেশ দেন আদালত।
দুদকের আবেদনে বলা হয়, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে নিজ নামে, স্ত্রী ও কন্যাদের নামে দেশে-বিদেশে শত শত কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ করা হয়।
দুদকের অনুসন্ধানে জানা গেছে, অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তাঁদের মালিকানাধীন ও তাঁদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তরের চেষ্টা করছেন, যা করতে পারলে মামলার অনুসন্ধানের ধারাবাহিকতায় মামলা দায়ের, চার্জশিট দাখিল, আদালত কর্তৃক বিচার শেষে সাজার অংশ হিসেবে অপরাধলব্ধ আয় থেকে অর্জিত সম্পত্তি সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্তকরণসহ সব উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে।
তাই অনুসন্ধান শেষে মামলা দায়ের, তদন্ত শেষে চার্জশিট দাখিল, এরপর আদালত কর্তৃক বিচার শেষে সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্তের সুবিধার্থে তথা সুষ্ঠু অনুসন্ধান ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে স্থাবর সম্পত্তিসমূহ ক্রোক ও অস্থাবর সম্পত্তি ফ্রিজ করা একান্ত প্রয়োজন।
দুদকের আইনজীবী মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর বলেন, তৃতীয় দফায় বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে বাড্ডা ও আদাবরে আটটি ফ্ল্যাট ক্রোকের আদেশ দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ২৪ কাঠা জমি, বান্দরবানে ৭৫ বিঘা জমি ও উত্তরায় তিন কাঠা জমি ক্রোকের আদেশ দিয়েছেন আদালত। এর বাইরে সিটিজেন টেলিভিশন ও টাইগার ক্রাফট অ্যাপারেলস লিমিটেডের শেয়ার অবরুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত।
রূপগঞ্জে ১০ কোটি টাকার বাংলোবাড়ি
আদালতের আদেশে বেনজীর পরিবারের রূপগঞ্জ সাবরেজিস্ট্রি অফিসের ১৪৪৫২ নম্বর সাফ-কবলা দলিলে ছয় কাঠার চারটি প্লট ও স্থাপনা জব্দ করা হয়েছে। ২০২২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর আনন্দ হাউজিং সোসাইটির কাছ থেকে সাভানা ইকো রিসোর্ট প্রাইভেট লিমিটেডের নামে এই জমি কেনা হয়। যার দলিল নম্বর ৬৭৬৯, ৬৭৭০, ৬৭৭১ ও ৬৭৭২। সাভানা ইকো রিসোর্টের মালিকানায় আছেন বেনজীরের স্ত্রী, বড় ও মেজো মেয়ে।
২৪ কাঠা এই জমির রেজিস্ট্রেশন করা জমির দলিল মূল্য দেখানো হয়েছে ২৪ লাখ ৪০ হাজার। অনুসন্ধান বলছে, ২০০৭ সালে আনন্দ হাউজিং প্রতিষ্ঠার পর কখনোই প্রতি কাঠা জমি এক লাখ টাকায় বিক্রি হয়নি। বরং শুরুর দিকে পাঁচ লাখ টাকা প্রতি কাঠা বিক্রি হলেও বর্তমানে প্রায় ৪০ লাখ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। বেনজীর পরিবার ২০২২ সালে এই জমি ক্রয় করে। ওই সময়ের বাজারদর অনুযায়ী, ২৪ কাঠার ওই প্লটের দাম ১০ কোটি টাকা। এদিকে বর্তমানে ওই জমির ওপর বিলাসবহুল বাংলোবাড়ি রয়েছে। এতে ব্যবহার করা হয়েছে বিদেশ থেকে আমদানি করা মূল্যবান মার্বেল পাথর ও টাইলস।
আদাবর-বাড্ডায় আট ফ্ল্যাট, উত্তরায় সাততলা বাড়ি
রাজধানীর আদাবর ও বাড্ডায় বেনজীর পরিবারের সদস্যদের নামে আটটি ফ্ল্যাটের সন্ধান পেয়েছে দুদক। এর মধ্যে আদাবরের পিসিকালসার হাউজিংয়ে ছয়টি ও বাড্ডার রূপায়ণ মিলেনিয়াম স্কয়ারে দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে।
বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জীশান মীর্জার মালিকানায় রয়েছে আদাবরের ছয়টি ফ্ল্যাট। পিসিকালসার হাউজিংয়ের ৯ নম্বর রোডের খ ব্লকের ৫৩ নম্বর হোল্ডিংয়ে ফ্ল্যাটগুলোর অবস্থান। ফ্ল্যাটগুলো হলো- এ/১, বি/১, এ/৩, বি/৩, এ/৫ ও বি/৫।
এদিকে ২০১৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ৮০৬২ দলিলে ৩৯.০৯ শতাংশের ওপর নির্মিত রূপায়ণ মিলেনিয়াম স্কয়ারের দুটি ফ্ল্যাট কেনে বেনজীর পরিবার। ১৪ তলা ভবনের অষ্টম তলায় ই-৭ ও এফ-৭ অফিস স্পেস ও দুটি কার পার্কিংসহ আয়তন ৩০৭৫ বর্গফুটের ফ্ল্যাটগুলোর দাম দেখানো হয়েছে ৬৫ লাখ ৮৭ হাজার ৫০০ টাকা। এ ছাড়া উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরে তিন কাঠা জমিতে থাকা সাততলা ভবনও জব্দ করেছে আদালত। ১৯৯৭ সালের ১ জানুয়ারি ১৪ নম্বর দলিলে এই জমি কেনে বেনজীর পরিবার।
বান্দরবানে বেনজীর পরিবারের ৭৫.৭৫ বিঘা জমি
বান্দরবান সদরের সুয়ালক মৌজায় থাকা ৭৫.৭৫ বিঘা বা ২৫ একর জমি জব্দের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। আদালতের আদেশে বলা হয়, বান্দরবান পার্বত্য জেলার বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ১০২/১৬ হলফনামায় ২০১৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর ১৬১/২০১৮ মূলে ২৫ একর জমি কেনে বেনজীর পরিবার। আমমোক্তারনামায় ৩৯৪ নম্বর সুয়ালক মৌজায় ৬১৪ নম্বর দাগের মিট নং ০৩ ও হোল্ডিং নং ৭২০।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বান্দরবান কেরানিহাট সড়কের মাঝেরপাড়া এলাকায় বাংলাদেশ চা বোর্ডের বান্দরবান ইফনিট অফিসের সামান্য দূরে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের এই জমির অবস্থান। ওই জমিতে একটি দ্বিতল ভবন, মাছ ও গরুর খামার রয়েছে।
নোটারি পাবলিকের কাছে নিবন্ধন করা আমমোক্তারনামা অনুযায়ী, বর্ণিত ওই জমির মালিক বান্দরবান পৌরসভার মধ্যমপাড়ার বাসিন্দা শাহজাহান। রাবার চাষের জন্য তিনি সরকারের কাছ থেকে ২৫ একর জমি লিজ পেয়েছিলেন। আমমোক্তারনামায় বলা হয়েছে, চাকরিসূত্রে বর্তমান প্রস্তাবিত লিজ গ্রহণকারী (বেনজীর আহমেদ, তাঁর স্ত্রী জীশান মীর্জা ও কন্যা ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীর) দেশের বিভিন্ন এলাকা ও দেশের বাইরে থাকায় জমির লিজ বা ক্রয়সংক্রান্ত কার্যক্রম সম্পাদন এবং তদারক করা সম্ভব নয় বলে মংওয়াইচিং মারমার সঙ্গে জমি ক্রয় ও আনুষঙ্গিক কার্যাদি সম্পাদন করতে নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে ক্ষমতা অর্পণ চুক্তি করেন।
এসব সম্পদের সঙ্গে বেনজীর পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল সিটিজেন টিভির শেয়ার অবরুদ্ধ করা হয়। এর আগে গ্রিন টিভির মালিকানা অবরুদ্ধ করেন আদালত। তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান টাইগার ক্রাফট অ্যাপারেলস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগও অবরুদ্ধ করা হয়।
বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’ এবং ‘বনের জমিতে বেনজীরের রিসোর্ট’ শিরোনামে গত ৩১ মার্চ ও ২ এপ্রিল পৃথক দুটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। প্রতিবেদনে বেনজীর আহমেদের বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের তথ্য উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেদন দুটি প্রকাশের পর দেশে-বিদেশে ব্যাপক সাড়া পড়ে। মূলত এর পরই দুদক বেনজীর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়।
গত ২১ এপ্রিল বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে দুদক চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করেন হবিগঞ্জ-৪ (মাধবপুর-চুনারুঘাট) আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। পরদিন দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন এক সংবাদ সম্মেলনে বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরুর তথ্য জানান। দুদকের উপপরিচালক হাফিজুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি টিম অভিযোগটি অনুসন্ধান করছে। টিমের অপর সদস্যরা হলেন সহকারী পরিচালক নিয়ামুল আহসান গাজী ও জয়নাল আবেদীন।
বেনজীর আহমেদ ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুলিশের আইজি ছিলেন। এর আগে তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার ও র্যাবের মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ৩৪ বছর সাত মাসের চাকরিজীবনে বেনজীর বেতন-ভাতা হিসেবে আনুমানিক দুই কোটি টাকা আয় করেছেন।কালের কণ্ঠ