ডেস্ক রির্পোট:- দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) নিয়ে চলছে রমরমা ব্যবসা। ভিটেমাটি বিক্রি করে আইসিইউর বিল মেটাতে নিঃস্ব হচ্ছেন রোগীর স্বজনরা। সাধারণ রোগীকে আইসিইউতে নিয়ে বিল তোলা, লাইফ সাপোর্টে রেখে দিনের পর দিন বিল বাড়ানোর অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায় স্বজনদের মুখে। সরকারি হাসপাতালের একটি আইসিইউ শয্যার জন্য সংকটাপন্ন ৭০-৮০ জন রোগী সিরিয়ালে থাকেন। ফলে জীবন বাঁচাতে স্বজনদের ছুটতে হয় বেসরকারি হাসপাতালে।
ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে গত ১ জুন রাজধানীর পল্লবীর ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল অ্যান্ড কার্ডিয়াক সেন্টারে ভর্তি হয়েছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা নাদিয়া নূর (৩০)। ভর্তির পাঁচ দিন পরই মারা যান চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা এই রোগী। চিকিৎসায় অবহেলা আর রোগী নিয়ে ব্যবসার অভিযোগ করে নাদিয়ার স্বামী আনিসুর রহমান পলাশ বলেন, ভর্তির পর সারা দিনে তার ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণে চলে আসে এবং রাতে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করলে দেখা যায় পেটে ১৬ সপ্তাহের সন্তানও সুস্থ আছে। কিন্তু পর দিনই নাদিয়ার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। আইসিইউতে নেওয়া হয়। এ সময় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় রোগীকে আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার। আইসিইউর দায়িত্বরতদের এ সিদ্ধান্ত জানালে তারা পোশাক বদলের কথা বলে এ রোগীকে দুই ঘণ্টা কোনো ধরনের স্যালাইন, অক্সিজেন ছাড়াই ফেলে রাখে। এতে ওর অবস্থা খারাপ হলে অন্য হাসপাতালে নিতে পারিনি। এরপর পেটে বাচ্চাটা মারা যায়, নাদিয়া লাইফ সাপোর্টে চলে যান। ওই দুই ঘণ্টার অবহেলা আমার রোগীর প্রাণহানির জন্য দায়ী।
এ হাসপাতালের আইসিইউ থেকে অন্য হাসপাতালে নেওয়ার কথা জানানোর পরই এ রকম ব্যবহার করে। রোগীর স্বজনদের আবেগ পুঁজি করে বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিক এ ধরনের অনৈতিক ‘ব্যবসা’ করছে। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসন অর্থ জরিমানা করলেও সে বিষয়ে তোয়াক্কা করছে না হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো। একই কায়দায় চালিয়ে যাচ্ছে তাদের অর্থ আদায়ের বাণিজ্য। বলা হয়, হাসপাতালগুলো জরিমানা দেয় লাখ লাখ টাকা, আর উপার্জন করে কোটি কোটি টাকা। তাহলে তাদের জরিমানা দিতে সমস্যা কোথায়!
চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যখন কোনো ব্যক্তির স্বাভাবিক সিস্টেমগুলো একদমই কাজ করে না, যখন তাকে ইনস্ট্রুমেন্টাল সাপোর্ট দেওয়ার প্রয়োজন, তখনই কেবল তাকে আইসিইউতে নিতে হয়। যেমন, যদি কারও ব্লাড প্রেশার (রক্তচাপ) অনেক কমে যায়, তখন তাকে একদম কন্টিনিউয়াস মনিটর করে ব্লাড প্রেশার বাড়ানোর জন্য ওষুধ দিতে হয় কিংবা যন্ত্রের সাহায্য ছাড়া যদি কারও শ্বাস নিতে কষ্ট হয় তখন তাকে আইসিইউতে নিতে হয়। অর্থাৎ যার নিবিড় পরিচর্যা দরকার কেবল তাকেই আইসিইউতে নিতে হবে, তার আগে নয়।
সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোয় রোগী ভর্তি হলেই তাকে আইসিইউতে নেওয়া হচ্ছে এবং সেখানে দিনের পর দিন রাখা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইসিইউ থেকে অর্থ আদায় করতেই হাসপাতালগুলো এ ধরনের অনৈতিক কাজ করছে। পাঁচ তারকা হাসপাতালে আইসিইউ বেড ভাড়া এবং আনুষঙ্গিক খরচ মিলিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজার টাকা পড়ে যায়। মাঝারি মানের হাসপাতালে ২০-৩০ হাজার টাকা খরচ পড়ে যায়। আইসিইউ, সিসিইউ এবং এনআইসিইউ নিয়ে অভিযোগ থেকে মুক্ত হতে পারছে না ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোর সঙ্গে দেশের নামিদামি হাসপাতালগুলোও। অহেতুক রোগীদের আইসিইউতে রেখে তারা মোটা অঙ্কের টাকা চার্জ করে থাকে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই রোগীদের রাখা হয় আইসিইউতে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশে রোগীর শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় আইসিইউ বেড ও আনুষঙ্গিক খরচ কেমন হবে সে-সংক্রান্ত সরকারি কোনো নীতিমালা নেই। তাই এ সেবা খাতকে রীতিমতো বাণিজ্যিক খাতে পরিণত করা হয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলো জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা রোগীর স্বজনদের আবেগ পুঁজি করে বেপরোয়াভাবে ভাড়া হাঁকাচ্ছে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের। কোনো বিকল্প না পেয়ে সারা জীবনের জমানো সঞ্চয় ভেঙে এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ভিটেমাটি বিক্রি করে প্রিয় মানুষটিকে বাঁচাতে সব উজাড় করে দিচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। তার পরও তাদের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে না প্রত্যাশিত সেবা। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, দেশের মানুষের প্রত্যাশিত সেবা নিশ্চিতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। অবৈধ, মানহীন হাসপাতালের বিরুদ্ধে আমরা সোচ্চার। কোথাও রোগী ঠকানো কিংবা ভোগান্তির অভিযোগ পেলে চলছে অভিযান। সত্যতা মিললে জরিমানা থেকে শুরু করে ক্লিনিক সিলগালা পর্যন্ত করা হচ্ছে। মানুষের প্রয়োজনীয় সেবা নিশ্চিতে আমরা সার্বক্ষণিক মনিটরিং করছি।বাংলাদেশ প্রতিদিন