রাঙ্গামাটি:- ক্ষমতা অপব্যবহার ও ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বারদের সাথে স্বার্থের দ্বন্দ্বের কারণে দুর্বৃত্তদের গুলিতে বড়থলী ইউপি চেয়ারম্যান আতোমং মারমা নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
গত ২১ মে রাত সাড়ে ১১টার দিকে বড়থলি মারমা পাড়ার একটি বাড়িতে উঠানে থাকা অবস্থা আতোমং মারমাকে গুলি করে দুর্বৃত্তরা। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার বিলাইছড়ি উপজেলা বড়থলি ইউনিয়নের বড়থলী মারমা পাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৯ মে মধ্য রাতে মারা যান আতোমং। সে বড়থলী ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন।
এ ঘটনায় ৩১ মে রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি থানায় ৮ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা দায়ের করা হয়। নিহত চেয়ারম্যান আতোমং মারমার বড়ভাই ক্যসিংমং মারমা বাদী হয়ে এই মামলাটি করেন। ওই মামলায় অজ্ঞাতনামা আরও ১০/১২ জনকেও মামলায় আসামি করা হয়।
রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা এএসপি আবুল কাশেম চৌধুরী জানান এর মধ্যে মামলার এজাহারভুক্ত চারজন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকি আসামিদের ধরতে রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের পুলিশের একটি টিম আলাদা আলাদা করে কাজ করছে। এ মামলায় কোনো নিরপরাধ লোকজনকে আটক করা হবে না বলে জানিয়েছেন এএসপি আবুল কাশেম চৌধুরী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি গেজেটের মাধ্যমে নতুন ইউনিয়ন পরিষদ হিসেবে সৃষ্ট হবার পর ২০১৫ সালে প্রথম বড়থলী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২৬ আগস্ট।
নির্বাচনে মেম্বার ও মহিলা মেম্বার পদে নির্বাচিত হলেও তাদের সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী আওয়ামী লীগের নেতা সুজন ত্রিপুরা পরাজিত হন। এতে মেম্বার ওয়াইভার ত্রিপুরা, সাধুচন্দ্র ত্রিপুরা ও সত্যচন্দ্র ত্রিপুরা সহ আরো অনেকে খুশি হতে পারেননি। চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন তাদের অসমর্থিত প্রার্থী আতোমং মারমা। তিনি ছিলেন জনসংহতি সমিতির বড়থলী ইউনিয়নের সভাপতি। তবে নির্বাচনে জনসংহতি সমিতি কিংবা আওয়ামী লীগের কোন দলীয় প্রভাবে প্রভাবিত হয়নি। সাবেক মেম্বার যাকব ত্রিপুরা ও বর্তমান মেম্বার অনোচন্দ্র ত্রিপুরা বলেছেন, এই ইউনিয়নের ত্রিপুরা মারমা ও তঞ্চঙ্গা তিন সম্প্রদায়ের বসবাস। নির্বাচনের সময় তঞ্চঙ্গ্যা ও মারমা সম্প্রদায়ের ভোটারেরা এক হয়ে যায়। ফলে থেকে যায় শুধু ত্রিপুরা সম্প্রদায় ভোটার। এ অবস্থায় প্রত্যক্ষ ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আতোমং মারমা। হেরে যান ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের প্রার্থী সুজন ত্রিপুরা।
চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের মধ্যে যেভাবে দ্বন্দ্ব শুরু:
ইউনিয়ন পরিষদের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, চেয়ারম্যান ও মেম্বারগণ শপথ গ্রহণের পরবর্তীতে সরকারের গৃহীত পরিবেশ বান্ধব খাদ্য কর্মসূচির আওতায় ইউনিয়ন পরিষদের কেজি প্রতি ১০ টাকায় ৩০ কেজি করে দরিদ্র পরিবারের মাঝে চাল বিক্রেতা হিসেবে ডিলারশিপ নেন ৪নং ওয়ার্ডের মেম্বার ওয়াইভার ত্রিপুরার বড়ভাই এবং ৪, ৫ ও ৬নং ওয়ার্ডের মহিলা মেম্বার জয়ন্তী ত্রিপুরার স্বামী ফিলিপ ত্রিপুরা (৫৫)। তখন জনসংহতি সমিতির পদধারী সক্রিয় সদস্য হিসেবে ডিলারশিপ পেতে চেয়ারম্যানও তাকে সহযোগিতা করেন। কিন্তু ডিলারশিপ নিয়ম-কানুন অনুসরণ করতে কোনো ভাবেই সম্ভব হয়নি। কেননা, ডিলারকে চালগুলোর উত্তোলন করতে হয়- বিলাইছড়ি উপজেলা সদর থেকে। কারণ বড়থলী ইউনিয়ন থেকে সরাসরি বিলাইছড়ি উপজেলা সদরে যাওয়া সড়ক যোগাযোগ কিংবা কোন নৌ-পথের ব্যবস্থা নেই। বিলাইছড়ি যেতে হলে রুমা ও বান্দরবান হয়ে যেতে হয়- বড়থলীবাসীকে। মূলত একারণে চালের ডিলার ফিলিপ ত্রিপুরা চাল গুলো গুদাম থেকে উত্তোলন করে কালোবাজারে বিক্রি করে দিয়ে উপকারভোগীদের টাকা দেয়ার চেষ্টা করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, হত দরিদ্রদের মাঝে পরিবেশবান্ধব কর্মসূচি শুরুর দিকে বড়থলী ইউনিয়নের সুবিধাভোগীর সংখ্যা প্রথম দিকে প্রায় ২৭০ জন ছিল। তালিকাভুক্ত এসব দরিদ্র লোকেরা প্রতি কেজিতে দশ টাকায় মোট ৩০ কেজি করে কেনার সুযোগ পাওয়ার কথা। কিন্তু ডিলার ফিলিপ ত্রিপুরা চালগুলো উত্তোলন করে কেজিতে ৪০ থেকে ৫০ টাকা দরে কালোবাজারে বিক্রি করে দেন। চাল পরিবর্তে টাকা বিতরণ হলে প্রত্যেক উপকারভোগী নগদ ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু উপকারভোগীদের মধ্যে প্রতিজনকে নগদ টাকায় ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা করে দেন ডিলার ফিলিপ ত্রিপুরা। তাও খুব অনিয়মিত। এতে তালিকাভূক্ত উপকারভোগী ও বড়থলী বাসিন্দারা প্রায় অনেকদিন যাবত পরিবেশবান্ধব চাল কিংবা টাকা পাননি। এতে দুর্গম এলাকা বড়থলী ইউনিয়নে উপকারভোগী ও সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড মেম্বারদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ-অসন্তোষ দেখা দেয়। ভৌগলিকগত দুর্গম বিবেচনায় স্থানীয় অতি দরিদ্রদের মধ্যে পরিবেশ বান্ধব চালের পরিবর্তে টাকা বিতরণ নিশ্চিত করতে স্থানীয় মেম্বারদের মাধ্যমে টাকা বিতরণ করতে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে চাপ করা হয়- ডিলার ফিলিপ ত্রিপুরাকে। ওই সময় ফিলিপ ত্রিপুরার কাছে লাভের অংশ ও দাবি করেন চেয়ারম্যান।
পরে উপকারভোগীদের বিতরণ করার জন্য সিংহভাগ নগদ টাকা ইউপি চেয়ারম্যান আতোমং মারমার হাতে ও সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড মেম্বারদের মাধ্যমে টাকা পাঠায়। এতে বিপত্তি বাঁধে ডিলার ফিলিপ ত্রিপুরা। কারণ সেবারেও ঠিকমত কোন উপকারভোগীদের কাছে টাকা পৌঁছেনি। ফিলিপ ত্রিপুরা বিশেষ করে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন চেয়ারম্যানের উপর।
কারণ চেয়ারম্যানের হাতে যত টাকা দেয়া হয়েছিল, সেই টাকা কাউকে বিতরণ না করে তার লাভের অংশ হিসেবে সব টাকা পকেটে ভরেন তিনি। সেখান থেকে ফিলিপ ত্রিপুরা ও চেয়ারম্যানের মধ্যে বাক-বিতণ্ডা বিতর্ক ও মনমালিন্যের সূচনা হয়। সম্পর্কে দূরত্ব বাড়তে থাকে দুজনের মধ্যে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুইজন ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার বলেছেন, ফিলিপ ত্রিপুরা উগ্র ও প্রবল রাগী প্রকৃতির মানুষ। অল্প কথায় রেগে যায়। কারণে-অকারণ কারোর সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে ধাক্কাধাক্কি- মারামারি করতে কোনো দ্বিধাবোধ করতেন না। একদিন পরিবেশ বান্ধব চালগুলোর সুবিধা ভোগীদের কাছে বিক্রি না করে কালো বাজারে বিক্রি করার বিষয়ে তর্ক-বিতর্কের এক পর্যায়ে চেয়ারম্যান আতোমং মারমাকে লাথি মারতে মুখোমুখি হয়-ফিলিপ ত্রিপুরা। ওই সময় উপস্থিত মেম্বাররা তাকে কোনো মতে থামিয়েছিল।
সূত্র মতে, ফিলিপ এর স্ত্রী জয়ন্তী ত্রিপুরা মহিলা মেম্বার ও পরিবেশ বান্ধব চালের ডিলার হবার কারণে ইউনিয়ন পরিষদে আসা-যাওয়া নিয়মিত ছিল।
ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যেরা বলেছেন, চেয়ারম্যান কর্তৃক ফিলিপ ত্রিপুরার পাঁচ লাখ বেশি টাকা আত্মসাতের কথা মাঝে মধ্যে শুনেছিলেন। এই অভিযোগটি নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনসহ এমনকি আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের সামনেও এই বিষয়টি নিয়ে উপস্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু ডিলার ফিলিপ ত্রিপুরা বিশ্বাসযোগ্য ও প্রমাণযোগ্য কোন দলিল কোথাও দেখাতে পারেননি। তাছাড়া নগদ টাকা গ্রহণের বিষয়টি বারবার অস্বীকার করে আসছিলেন চেয়ারম্যান আতোমং। এ অবস্থায় বিষয়টি অমীমাংসিত-ই থেকে যায়। ফলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ফিলিপ ত্রিপুরা চেয়ারম্যানের প্রতি চাপা ক্ষোভ ও অসন্তোষ বাড়তে থাকে।
সূত্র আরো জানায়, বড়থলী ত্রিপুরা পাড়ার বাসিন্দা বিদ্যারাম ত্রিপুরার ছেলে ফিলিপ ত্রিপুরাকে স্থানীয়রা ভয়ের আড়ালে দেখতো। সেই মিজোরাম বাংলাদেশ সীমান্তে অবৈধ ব্যবসায় জড়িত। রাগী প্রকৃতি মানুষ হিসেবে এলাকার লোকজন তার সাথে বিতর্কের জড়ানো থেকে এড়িয়ে থাকতো।
অভিযোগ আছে, ফিলিপ ত্রিপুরা তার নিকটতম আত্মীয় গুনোচন্দ্র ত্রিপুরা ও দেমন্দ্র ত্রিপুরা মাধ্যমে মিজোরাম থেকে লোকাল গান বা এলজি (স্থানীয়ভাবে গাধা বন্দুক বলে থাকে) ও এসবিবিএল (কার্তুজ) -এ গুলি তৈরি করার সামগ্রী হিসেবে বারুদ এনে বিভিন্ন জনের কাছে বিক্রি কাজে জড়িত ।
সূত্র মতে, দেড় থেকে দুই বছর আগে ফিলিপ ত্রিপুরার ভাগিনা দেমন্দ্র ত্রিপুরা মিজোরাম থেকে বারুদ নিয়ে আসে। ওই সময় রুমা বাজারে একটি আবাসিক হোস্টেলে এক মহিলাকে নিয়ে অবস্থান করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে আটক করে।
বান্দরবানের রোয়াংছেড়ি উপজেলা সদর ইউনিয়নের ব্যাংকছড়ি পাড়ার বাসিন্দা হাসিচন্দ্র ত্রিপুরা (৬৭) জানিয়েছেন, তার ছেলে দেমন্দ্র ত্রিপুরা এখনও বান্দরবান জেলে আছে। ফিলিপ ত্রিপুরা আমার ছেলেকে জেল থেকে বের করে আনার ব্যবস্থা কথা জানালেও এখনো পর্যন্ত কোন কিছুই হয়নি। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক দেমন্দ্র ত্রিপুরাকে আটকের পিছনে বড়থলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আতোমং এর হাত রয়েছেন বলে ফিলিপ ত্রিপুরার মনে প্রবল সন্দেহ জন্ম দেয়। দেমন্দ্র ত্রিপুরাকে জেলে যাওয়া নিয়ে খুবইও খেপে উঠেন ফিলিপ ত্রিপুরার ছোট ভাই ও বড়থলী ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের মেম্বার ওয়াইভার ত্রিপুরাও।
ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যরা জানিয়েছেন, শপথ গ্রহণের পর থেকে ৪নং ওয়ার্ডের ওয়াইভার ত্রিপুরা এমনিতে চেয়ারম্যান ইউনিয়ন পরিষদে নিত্যদিনের কর্মকান্ডের ভুল-ত্রুটি খুঁজে পিছনে পিছনে লেগে থাকত। সুযোগ বুঝে চেয়ারম্যানের গুরুত্বপূর্ণ কাগজ গোপনে ফটোকপি করে নিজের কাছে রাখত এবং চেয়ারম্যানের কিছু গোপনীয় কাজের তথ্য বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে প্রচার ও সরবরাহ করত। এতে চেয়ারম্যান ও নাম্বার ওয়াইভার ত্রিপুরার প্রতি খুবই অসন্তুষ্ট ছিল। মূলত; এই কারনে মেম্বারকে উন্নয়নের বরাদ্দ ভাগ বন্টনেও কম দিতেন চেয়ারম্যান। এ নিয়ে প্রায় সময় চেয়ারম্যান আতোমং ও মেম্বার ওয়াইভার ত্রিপুরার মধ্যে তর্ক-বিতর্ক মনমালিন্য লেগেই থাকত। এরমধ্যে গয়াল (বন্য গরুর একটি প্রজাতি) বিক্রি করার উদ্দেশ্যে বাড়ির উঠানে বেঁধে রাখেন ফিলিপ ত্রিপুরা। গয়ালটিকে দেখে তাঁর বলে দাবি করেন চেয়ারম্যান আতোমং।
স্থানীয় মেম্বার চিংলামং মারমা বলেন, গয়ালটির মালিকানা নিয়ে চেয়ারম্যান ও মেম্বার এর মধ্যে স্থানীয়দের নিয়ে সামাজিকভাবে বিচার হয়েছিল। কিন্তু দু’জনে রায় মেনে নিতে নারাজ। এই অবস্থায় স্থানীয় একটি বিশেষ বাহিনী ক্যাম্পে করা হয়- বিচার। ওই বিচারে সিদ্ধান্ত হয় যে, সামাজিক নিয়মে গয়ালটি মালিকানা, যে তার দাবি করে শপথ গ্রহণ করতে পারবে সে হবে-গোয়ালটির প্রকৃত মালিক। সামাজিকভাবে বিশ্বাসের বিশেষিত একটি স্থানে শপথ করতে গেলে এতে অনীহা প্রকাশ করে ওয়াইভার ত্রিপুরা। পরে মালিকানা নিয়ে বিতর্কিত গয়াটির চেয়ারম্যানের ভাগে চলে যায়। এ নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে গয়াল চোর প্রচারিত হলে চেয়ারম্যানের প্রতি ক্ষোভে ফেটে পড়েন মেম্বার ওয়াইভার ত্রিপুরা। এসব রেশ কাটতে, না কাটতেই তার ভাগিনা দেমন্দ্র ত্রিপুরা রুমা বাজার থেকে একটি আবাসিক হোটেল থেকে এক মহিলা সহ আটক হয়- আইন-শৃঙ্খলার বাহিনীর হাতে। ওই ঘটনায় ওয়াইভার ত্রিপুরার অদৃশ্যে মনের আগুনে জ্বলে ওঠে।
স্থানীয়রা জানায়, গয়াল চুরির ঘটনায় ওয়াইভার ত্রিপুরার সাথে বড়থলী মারমা পাড়া বাসিন্দা সাহ্লা চিং মারমা জড়িত ছিল। সে মারমার সম্প্রদায় হলেও প্রথমে দুইবার বিয়ে করেন ত্রিপুরা মেয়েকে। এ কারণে মেম্বার ওয়াইডার ত্রিপুরা, তার আপন বড় ভাই ফিলিপ ত্রিপুরা ও সুজন ত্রিপুরার বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত।
সূত্রমতে, ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী সুজন ত্রিপুরার পক্ষে কাজ করেন সাহ্লাচিং মারমা ও তার আত্মীয়স্বজনেরা। নির্বাচিত হওয়ার পর চেয়ারম্যান আতোমং মারমা, তার বিপক্ষে অবস্থান করা কয়েকটি পরিবার পাহাড়ে জুম চাষ করা থেকে শুরু করে বিভিন্নভাবে সমস্যায় সম্মুখীন হয়ে পড়েন। এতে অতিষ্ঠ হয়ে পরবর্তীতে সুবিধা সময়ে বেশ কয়েকটি পরিবার নিজ জন্মস্থান পাড়া গ্রাম ছেড়ে পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার রাখাইন রাজ্যে পাড়ি জামান। ওই তখন ওই সব পরিবারের সঙ্গে রাখাইন রাজ্যে পরিবার নিয়ে পাড়ি জমাতে চেয়েছিল সাহ্লাচিং। কিন্তু প্রতিবেশীদের মধ্যে লাগালাগি ষড়যন্ত্রকারী দুষ্ট ব্যক্তি হিসেবে তাকে তাদের সাথে আসতে নিষেধ করে ভিনদেশে পাড়ি জমানো লোকেরা।
বড়থলি পাড়াবাসীরা জানায়, দুষ্ট প্রকৃতি সাহ্লাচিং মারমা পাড়ায় নিজ বাড়িতে একরাত কাটলে এক সপ্তাহ আর কোথায় কাটে রাত? কেউ জানতো না। ২০২৩ সালে শীত মৌসুমে একটি কুকুর চুরি করে বমদের কাছে বিক্রি করে দেয়। বিষয়টি পাড়ার মধ্যে জানাজানি হলে সামাজিক সালিশি বিচার হয়। অন্য একজনের কুকুর চুরি করে বিক্রি করে দেয়ার অপরাধে চেয়ারম্যান আতোমং মারমা তাকে ৫০০০ টাকা জরিমানা করেন। জরিমানার টাকা কুকুর মালিকে দিতে অস্বীকার করেন সাহ্লাচিং মারমা এবং চলে যান পুকুরপাড়া বাসিন্দা ও ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে পরাজিত চেয়ারম্যান প্রার্থী সুজন ত্রিপুরা বাড়িতে। সেখানে প্রায় ২০ দিন থাকার পর বাড়িতে এর পাড়ায় এসে জরিমানা টাকা দিতে বাধ্য হয়। পাড়ার বন ধ্বংসসহ এলাকার মধ্যে একজন আরেকজনের মধ্যকার ষড়যন্ত্র ও উস্কানিদাতা এই অভিযোগ এনে সাহ্লাচিং মারমাকে একহাত করেন চেয়ারম্যান আতোমং মারমা। এ সুযোগে সাহ্লাচিং মারমাকে নিজের কাছে টেনে নেয় ফিলিপ ত্রিপুরা। চলতি বছর শুরুর দিকে পাড়ার দুই জোড়া জোবাদের মধ্যে অসামাজিক ঘটনার ঘটে সাহ্লাচিং মারমা বাড়িতে। তার বোনের মেয়েও ছিল। এই ঘটনায় সামাজিক বিচারে দুইজনকে শুকর জরিমানা সহ বিয়ে দেয়া হয়। তবে তবে আরেকজন মেয়ে অপ্রাপ্ত বয়স্ক তাই মেয়েটিকে অভিযুক্ত ছেলের সাথে বিয়ে দেয়া থেকে বিরত রাখা হয়। শূকর দেও মওকুফ করা হয়। এই ঘটনায় সামাজিক বিচারে নেতৃত্ব দেন চেয়ারম্যান আতোমং মারমা। তার দাবি অনুযায়ী সালিশি সভায় সিদ্ধান্ত না হওয়ায় ক্ষেপে যান চেয়ারম্যানের উপর। পরে ফিলিপ ত্রিপুরা ও সুজন ত্রিপুরা সহযোগিতায় সালিশি সভার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে চাকমা সার্কেল রাজা বাহাদুর এর কাছে বিচারের আপিল করেন। সেখানে তার আপিল খারিজ হয়ে যায়। ওখান থেকে পাড়ায় ফিরে তার মনোভাব ও চেহারা খিটখিটে হয়ে প্রকৃত মন মানসিকতা বদল হয়ে গিয়েছিল। এসব বুঝা যায় তার আচরণের মাধ্যমে। এসব তথ্য জানিয়েছেন চেয়ারম্যান স্ত্রীর বড় ভাই চিঃলামং মারমাসহ বড়থলী পাড়াবাসীরা।
এদিকে, কী পরিমান নির্যাতিত হলে নিজ জন্মস্থান ছেড়ে অচেনা-অজানা ভিন্ন দেশে পাড়ি জমাতে বাধ্য হতে হয়, এ নিয়েও স্থানীয়দের মধ্যে আলোচনা কম নয়।
অন্যদিকে নিহত ইউপি চেয়ারম্যান আতোমং মারমা বড় ভাই ক্যসিংমং মারমা বলেন, তার ভাইকে গুলি করার ঘটনায় যারা প্রত্যক্ষদর্শী ও ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানে তাদেরকে সাক্ষী রেখে একজনকে আসামি করে বিলাইছড়ি থানায় এর মধ্যে মামলা করেছেন।
তার ভাষ্যমতে অভিযুক্ত আসামিরা হলেন- ৪নং বড়থলি ইউনিয়নের সাহ্লাচিং মারমা (৪২), পিতা-সাহ্লাউ মারমা, সাং-বড়থলি মারমা পাড়া, ৫নং ওয়ার্ড, ২। গুনচন্দ্র ত্রিপুরা (৩৫), পিতা-এরাজন ত্রিপুরা, সাং-বড়থলি ত্রিপুরা পাড়া, ৪নং ওয়ার্ড, ৩। ফিলিপ ত্রিপুরা (৫৫), পিতা-বিদ্যারাম ত্রিপুরা, সাং-বড়থলি ত্রিপুরা পাড়া, ৪নং ওয়ার্ড, ৪। ওয়াইভার ত্রিপুরা (৫০), পিতা-বিদ্যারাম ত্রিপুরা, সাং-বড়থলি ত্রিপুরা পাড়া, ৪নং ওয়ার্ড, ৫। সাপ্রুচিং মারমা (৩৫), পিতা-সাহ্লাউ মারমা, সাং-বড়থলি মারমা পাড়া, ৫নং ওয়ার্ড, ৬। সাধুচন্দ্র ত্রিপুরা (৫৩), পিতা-প্রভাত ত্রিপুরা, সাং-প্রাংজা পাড়া, ৭নং ওয়ার্ড, ৭। সত্যচন্দ্র ত্রিপুরা (৪৯), পিতা-লক্ষীচন্দ্র ত্রিপুরা, সাং-পুকুর পাড়া, ৬নং ওয়ার্ড, ৮। সুজন ত্রিপুরা (৫৭), পিতা-সুগচান ত্রিপুরা, সাং-পুকুরপাড়া, ৬নং ওয়ার্ড।
রাত ৮ টার দিকে নিহত চেয়ারম্যানের বড় ভাই ক্যসিংমং মারমা (৬১) বাদী হয়ে বিলাইছড়ি থানায় মামলাটি দায়ের করেন। উক্ত বিলাইছড়ি থানার মামলা নং-০১, তাং-৩১/৫/২০২৪ ধারা-৩০২/৩৪ পেনাল কোড।
মামলার এজাহারে বলা হয়, গত ২১ মে ২০২৪ রাত আনুমানিক সাড়ে ১১টায় নিহত আতোমং মারমার স্ত্রীর ভাই চিংহ্লা অং মারমার (৫০) মাচাং ঘরে ভাত খাওয়ার সময় মাচাং এর নীচে আসামিরা অবস্থান নেয় এবং সেখান থেকে ১নং ও ২নং আসামি আতোমং মারমাকে বন্দুক দিয়ে গুলি করে।