রাঙ্গামাটি:- এমন নিরুত্তাপ প্রাণহীন ভোট শেষ কবে দেখেছে রাঙ্গামাটিবাসি কে জানে ! সর্বশেষ দুই জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও স্থানীয় নির্বাচনগুলো নিয়ে যত বিতর্কই থাকুক না কেনো,অন্তত ভোটের দিন ভেতরে যাই হোক না কেনো, কেন্দ্রের বাহিরে ক্ষমতাসীন দল ও তার সহযোগি সংগঠনের নেতাকর্মীদের যে চিরচেনা জটলাও নেই এবারকার ভোটে। অজানা অচেনা কারণে কর্মীদের অনুপস্থিতির সাথে পাল্লা দিয়েই যেনো বাড়লে ভোটারদের গরহাজিরা! ফলে নজিরবিহীন কম ভোটের রাঙ্গামাটি সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত কি হয় বোঝা মুশকিলই ছিলো !
রাঙ্গামাটি শহরের জনবর্ধিঞ্চু রিজার্ভবাজার,তবলছড়ি,বনরূপার মতো কেন্দ্রগুলোতে ভোট শুরুর পর প্রথম চারঘন্টায় ১০ শতাংশেরও কম ভোট সংগৃহীত হতে দেখা গেছে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে ভোটার উপস্থিতি বাড়ার যে আশাবাদ ভোটসংশ্লিষ্টরা করছিলেন,তাও শেষ পর্যন্ত অতটা আশা ছড়ায়নি। দিনান্তে ভোটের হার এসে ঠেকেছে ৩১.৫৭ শতাংশে, যদিও তা ইউনিয়নগুলোর বাড়তি ভোটের গড় যোগফলের পরের হিসাব। বাস্তবতা হচ্ছে শহরের প্রায় সব কেন্দ্রে ভোটের হার এতটাই কম ছিলো যে, কোন কোন কেন্দ্রে তা মাত্র ১৩ শতাংশ ছুঁয়েছে অনেক কষ্টে।
সকাল ৯ টা থেকে বিকাল চারটি অবধি রাঙ্গামাটির অন্তত ১১ টি কেন্দ্র ঘুরে ভোটের যে চিত্র ও ভোটারের যে উপস্থিতি দেখা গেছে তা ছিলো ভীষণ হতাশাজনক। তবে সব কেন্দ্রেই যে ভোটার উপস্থিতি একইরকম ছিলো তাও কিন্তু নয়। পাহাড়ী ভোটারের আধিক্য আছে এমন কেন্দ্রগুলোতে দেখা গেছে ভোটারদের উপস্থিতি বেশ ভালোই। কিন্তু বাঙালি নির্ভর কেন্দ্রগুলোতেই ভোটারের জন্য হাহাকার ছিলো তীব্র।
ভোটার উপস্থিতি যাই হোক না, প্রতিদ্বন্দ্বি পাঁচ প্রার্থীর কেউই তেমন গুরুতর কোন অভিযোগ তোলেননি পরষ্পরের বিরুদ্ধে।
ভোটের ফলাফল বিশ্লেষন করে দেখা গেছে,অন্ন সাধন বিজয়ী হয়েছেন মূলত ইউনিয়নগুলোর ভোটেই। সেখানকার কেন্দ্রগুলোর ভোটারদের ব্যাপক উপস্থিতিই তার জয়ে ভূমিকা রেখেছে। বিপরীতে যেসব কেন্দ্রের ভোটে এগিয়ে যেতে পারতেন বিপ্লব চাকমা,সেইসব কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি এতটাই কম ছিলো তা বিপ্লবের জয়ের জন্য যথেষ্ট ছিলো না। ৪১ টি কেন্দ্রের মধ্যে শহরের ৪ টি কেন্দ্রে বিজয়ী হন শাহজাহান,তিনটিতে বিজয়ী হন অন্ন সাধন। শহরের বাকি ১৫ কেন্দ্রের সবগুলোতেই বিজয়ী হন বিপ্লব। তবে তার এই ১৫ কেন্দ্রে বিজয়ী হলেও ভোটারের নাজুক উপস্থিতির কারণে কোন কেনো কেন্দ্রে তা ১৩ বা ১৫ শতাংশে নেমেছে। আবার সবচে বেশি যেখানে ভোট পড়েছে তাও পেরোয়নি ৩০ শতাংশের মাত্রা। এমনকি বিপ্লবের নিজের এলাকা মাঝেরবস্তির একমাত্র কেন্দ্র শাহ উচ্চ বিদ্যালয়ে মোট ২৩৮০ জন ভোটারের মধ্যে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন মাত্র ৮৪০ জন,যা মোট ভোটের ৩৫.৮৪ শতাংশ ! এমনকি রাঙ্গামাটি শিশু নিকেতন,স্বর্ণটিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়,কাঠালতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বা গোধূলী আমানত বাগের মতো কেন্দ্রেও ভোট পড়েছে ১৩ থেকে ১৫ শতাংশ ! বিপ্লব শহরের যেসব কেন্দ্রে বিজয়ী হয়েছেন তার মধ্যে সর্বোচ্চ ভোট পড়েছে শাহ উচ্চ বিদ্যালয় ও ওয়াপদা রেস্ট হাউজ কেন্দ্রে যথাক্রমে ৬৫১ ও ৪৪৫। অথচ এই দুই কেন্দ্রে মোট ভোটার যথাক্রমে ২৩৮০ ও ২৫৭২ !
বিপরীতে অন্ন সাধন চাকমা যে ২২ কেন্দ্রে বিজয়ী হয়েছেন তার কোন কোনটিতে ভোটারের উপস্থিত ছিলো ৮০ শতাংশেরও বেশি। গড়ে সব কেন্দ্রে ভোটার ছিলো ৪০ থেকে ৫০ শতাংশের উপরে। বিপ্লবের সাথে সবচে বেশি পার্থক্য তৈরি করা বরাদম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট পড়েছে ৬১.১৪ শতাংশ,লালমোহন কার্বারি পাড়া সরকার প্রাথমকি বিদ্যারয়ে ভোট পড়েছে ৮০.৫৯ শতাংশ,নোয়াদম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট পড়েছে ৪৬.৭৭ শতাংশ,দক্ষিন কুতুকছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট পড়েছে ৫৬.২৬ শতাংশ। কিচিং আদাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট পড়েছে ৪৭.৪২ শতাংশ। ইউনিয়নের কেন্দ্রের বাহিরে শহরের যে তিনটি কেন্দ্রে অন্ন সাধন বিজয়ী হয়েছেন তার মধ্যে যোগেন্দ্র দেওয়ান পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট পড়েছে ৫৯.৭৯ শতাংশ,অর্থাৎ ২৭৬৫ ভোটের মধ্যে বৈধ ভোট পড়েছে ১৩৮৭টি,যার মধ্যে ৯৮৯ টিই পেয়েছেন অন্ন সাধন। এর বাহিরে রাণী দয়াময়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের যে দুটি কেন্দ্রে তিনি বিজয়ী হয়েছেন তাতে পার্থক্য খুব সামান্যই,কারণ এখানেও ছিলোনা ভোটারের উপস্থিতি। এই স্কুলের দুটি কেন্দ্রে ভোট পড়েছে মাত্র ২২.৪১ শতাংশ ও ২৮.৯০ শতাংশ।
সদর উপজেলার চেয়ারম্যানদের কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল : সৌজন্যে : দৈনিক পার্বত্য চট্টগ্রাম
ভোটের চিত্রেই স্পষ্ট,ইউনিয়নগুলোতে ভোটারদের ব্যাপক উপস্থিতি এবং শহরের কেন্দ্রগুলোতে ভোটারদের ব্যাপক অনিহাই ভোটের চিত্র পাল্টে দিয়েছে। ফলে অন্ন সাধনের জয় কিংবা বিপ্লবের পরাজয়ের কারণ খুবই স্পষ্ট। কিন্তু কেনো ভোটারটা আগ্রহী হলেন না কেন্দ্রে যেতে ? এই প্রশ্নের জবাবে উঠে এসেছে নানা জবাব।
নির্বাচনী কাজে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানালেন, আসলে ভোটের উপর মানুষের আস্থা একেবারেই উঠে গেছে। তার উপর অনেকদিন পর মার্কাহীন নির্বাচন। ফলে ঠিক কি হবে বা হতে পারে সেই সম্পর্কে ভোটারদের ভাবনা পরিষ্কার ছিলো না,প্রচুর দ্বিধা ছিলো। এটা কাটানোর জন্য প্রার্থীদের পক্ষ থেকেও বড় ধরণের কোন উদ্যোগ ছিলোনা।
একজন বেসরকারি চাকুরিজীবি,বেলাল হোসেন বলছেন, এই যে অন্ন সাধন চেয়ারম্যান হলেন,তাকে তো আমরা চিনিই না। অবাককান্ড হলো, তিনি বাঙালী এলাকাগুলোতে ভোটও চাইতে আসেন নি। বিষয়টি তখন আমার কাছে বিস্ময়কর ঠেকলেও এখন বুঝতে পারছি,তিনি কেনো আসেননি। আসলে তিনি নির্ভর ছিলেন ইউনিয়ন ও পাহাড়ী ভোটের উপর,সেই কারণেই হয়ত শহরের ভোটারদের সেভাবে পাত্তা দেননি। আবার অন্য যারা প্রার্থী হয়েছেন তারা প্রচারের যে জোয়ার তোলা উচিত,সেটা করেননি তা পারেননি।
দুপ্রক এর রাঙ্গামাটি জেলা সভাপতি ওমর ফারুক বলছেন, এই নির্বাচনে যেহেতু আওয়ামীলীগের একাধিক নেতা প্রার্থী হয়েছেন সঙ্গত কারণেই তাদের ভোটও ভাগ হয়ে গেছে। অন্যদিকে জেএসএস এর একজনই প্রার্থী থাকায় এবং শহরের নিয়ন্ত্রন না থাকলেও ইউনিয়নগুলোর ভোটারদের উপর তাদের এক নিয়ন্ত্রনের কারণে সেখানে তারা একচেটিয়া ভোট পেয়েছে। ফলে স্পষ্টতই আওয়ামীলীগের প্রার্থীরা পিছিয়ে গেছেন। তার উপর বিএনপির ভোটবর্জনহ সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোর নেতিবাচক উদাহরণের কারণে শহরের সাধারন ভোটাররা ভোট বিমুখ ছিলেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই জেএসএস এগিয়ে গেছে এবং তাদের প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন।’
বিপ্লবের ভোটের মাঠে কারিশমা ছিলো তার সহযোদ্ধা সাবেক ও বর্তমান রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠরা,নিজের পাড়ার,শহরের ও ব্যাচের বন্ধুরা,আত্মীয়স্বজন শুভাকাংখী ও পেশার সহকর্মীরা। সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক সমর্থন ছাড়াই ভোটের মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিবেশ তৈরি করেও ভোটারদের কেন্দ্রে বেশি পরিমাণে আনতে না পারার কারণে সুযোগ হাতছাড়া হলো তার। অন্যদিকে অন্ন সাধন এর কার্বারী ও জোত মালিক হিসেবে নিজস্ব কমিউনিটিতে পরিচিতির পাশাপাশি, জনসংহতি সমিতির মত শক্তিশালী রাজনৈতিক প্লাটফর্মের সমর্থন, এমনকি আরেক প্রভাবশালী আঞ্চলিক দল ইউপিডিএফ এর সমর্থন তাকে ভোটের মাঠে জয়ের বৈতরনি পাড় করিয়ে দিয়েছে, এটাই বাস্তবতা। ফলে ভোটের প্রচারে তিনি কতটা ছিলেন,কোথায় গেছেন বা যান নি, তারচে বেশি প্রভাব ফেলেছে জনসংহতি সমিতির নেতাকর্মীদের আন্তরিক প্রয়াস ও পরিশ্রম। পাশাপাশি নিজেদের নিয়ন্ত্রিক সাপছড়ি,কুতুকছড়িতে অন্নসাধনকে ভোটের মাঠ ছেড়ে দিয়ে এবং সাংগঠনিক সমর্থন দিয়ে সহায়তা করেছে ইউপিডিএফও।
পাহাড়ের নির্বাচন কাছ থেকে দেখেন এমন একজন ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছেন, আসলে জনসংহতি সমিতির শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তির বিপক্ষে নির্বাচন করতে হলে যে শক্তিশালী সাংগঠনিক সমর্থন পেছনে থাকা প্রয়োজন,যেটি রাঙ্গামাটি সদরের বাকি দুই প্রধান প্রার্থীর ছিলোনা। যদি আওয়ামীলীগের একক প্রার্থী থাকত,তবে নেতাকর্মীরা সমন্বিতভাবে মাঠে নামত এবং প্রার্থীর পক্ষে কাজ করত। এখন যা হয়েছে কর্মীরা কিছু অংশ বিভক্ত হয়ে তিন প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছে,বেশিরভাগই নিজেকে এই জটিলতা থেকে এড়াতে দূরেই থেকেছে,কোন প্রার্থীর পক্ষেই মাঠে নামেনি। দল থেকেও কোন নির্দেশনা ছিলো না। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। ভোটের আগেরদিন দলের একজন শীর্ষ নেতা একটা দায়সারা লাঞ্চ পার্টি করলেও সেটি প্রভাব যে ফেলতে পারেনি,ভোটের মাঠে তা তো স্পষ্টই !
তবে এই নির্বাচনের সম্ভবত সবচে বড় চমক একেবারেই আলোচনার বাহিরে থেকে এসে ভোটের মাঠ কাঁপিয়ে দেয়া বিপ্লব চাকমা। আওয়ামীলীগ যখন পাহাড়ী জনগোষ্ঠির নেতাদের মধ্যে দীপংকর তালুকদার ছাড়া আর কাউকেই সুযোগ দেয়না বা দেয়ার জন্য কাউকে পায়না,তখন ভোটের মাঠে প্রথমবার এসেই সবাই চমকে দেয়া ফলাফল করা বিপ্লব হয়ত আওয়ামীলীগের আগামীর রাজনীতির জন্য বড় সম্পদে পরিণত হতে পারে। তবে পুরোটাই নির্ভর করছে,দল কতটা পরিচর্চা করতে পারে তার,কত সুযোগ দেয় কিংবা বৃত্তের বাহিরে গিয়ে ভাবতে পারে,তার উপরই। পাশাপাশি, আওয়ামীলীগের দাদাকেন্দ্রিক রাজনীতি, নতুন কোন দাদা তৈরির সম্ভাবনাকে কতটা ছাড় দেয়,তার উপরও নির্ভর করছে বহুকিছুই। আসছে দিনে হয়ত এইসব
ভাবনার উত্তর মিললেও মিলতে পারে! পাহাড় টোয়েন্টিফোর