ডেস্ক রির্পোট:- তীব্র তাপদাহের ফলে পানির সংকট দেখা দিয়েছে পুরো পাহাড় জুড়ে। পার্বত্য জেলা বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ে বসবাসকারীদের পানির প্রধান উৎস নদী ও ঝিরি-ঝর্ণা। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে ঝিরি-ঝর্ণার পানি শুকিয়ে যাওয়ায় দুর্গম এলাকায় বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
পাহাড়ি অঞ্চল হওয়ায় ও ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে নামার ফলে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। দুর্গম পাহাড়ে সুপেয় পানি থেকে শুরু করে নিত্য ব্যবহার্য পানিও মিলছে না। তাছাড়া সেসব দূষিত পানি আছে তা পান করে ইতোমধ্যে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন ওই সমস্ত এলাকার বাসিন্দারা। দূর-দূরান্ত থেকে অনেক কষ্টে পানি সংগ্রহ করে এনে খাওয়াসহ রান্নার কাজে ব্যবহার করতে হচ্ছে সেখানকার মানুষদের। ফলে পাহাড়ে বসবাসরত মানুষের কষ্ট বহু গুণ বেড়েছে।
বান্দরবান জেলায় অন্তর্গত চিম্বুক, ম্রোলং পাড়া, টংকাবতী, মাঝের পাড়া, রেইছা, টিএন্ডটি পাড়া ও সদরসহ সাতটি উপজেলায় দুর্গম এলাকাগুলোতে এখন পানির সংকট। পাহাড়ে পানি প্রধান উৎস ঝিড়ি-ঝর্ণা কিংবা কুয়া। তবে ছড়াগুলো শুকিয়ে পানির স্তর কমে যাওয়ায় পানি উঠছে না। তাছাড়া প্রকৃতির সবুজ ঘেরা বনাঞ্চল উজাড় করে দেয়ায় ঝিরিগুলোতে পানির দেখা মিলছেনা। যার ফলে সুপেয় পানি থেকে নিত্য ব্যবহার্য পানিও এখন চরম সংকটে। তবে এই পানি সংকট নিয়ে বিভিন্ন প্রিন্ট ও মাল্টিমিডিয়াতে বারবার সংবাদ প্রকাশিত হলেও মেলেনি কোন সুফল। বরং দিনের পর দিন আরো তীব্র আকার ধারণ করেই চলেছে পানির সংকট।
বান্দরবান সদর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে টংকাবতী ইউনিয়ন। সেখানে কয়েকটি গ্রামের বিভিন্ন দুর্গম এলাকায় বসবাস করে আসছেন ম্রো সম্প্রদায়। তাদের মূলত সমস্যা কারণ খাবার পানি। সকাল থেকে কলসিসহ খালি বোতল নিয়ে এসে পানির জন্য অপেক্ষা করতে হয় কয়েক ঘণ্টা। এমনকি ঝিরি ও ছড়ায় পাথরের ফাঁকে অল্প অল্প করে পানি আসে তা নারীরা মধ্যরাত থেকে পালা করে ভোর পর্যন্ত দুর্গম পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে কোনোমতে পরিবারের খাবার পানি সংগ্রহ করে আনেন।
টংকাবতী ইউনিয়নের বাট্টা পাড়া গ্রামের ম্রো নারীরা একসঙ্গে পাঁচ-ছয় জন দলবেঁধে ঝিরি থেকে পানি সংগ্রহ করতে এসেছেন ভোর বেলায়। ঝিরিটি একটু স্যাঁতস্যাঁতে ও ভেজা। পাথরের মাঝখান দিয়ে খুব অল্প করে পানি বের হয়। পানি জমতে একটু সময় লাগে। দুই-তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর কপালে জুটে ময়লা যুক্ত পানি। পর্যায়ক্রমে দুই-তিনজন করে পানি নিতে আসেন অন্য নারীরাও। সকালে অন্য কাউকে পানি নেওয়ার সুযোগ দিয়ে ঘরে অন্যান্য কাজ সেরে একটু দেরি করে পানি সংগ্রহ করতে যান তারা। সেখান থেকে প্রথমে মগে পানি তোলা হয়, তারপর ছেঁকে কলসিতে সংগ্রহ করা হয়। পরপর দুই মগ পানি নেওয়ার পর অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। এক লিটার, দুই লিটারের বোতলে ঝিরির পানি ভরে থুরুংয়ে (ঝুড়ি) করে উঁচু-নিচু পাহাড় বেয়ে ঘরে ফেরেন নারীরা। তবুও এসব ঝিরি-ঝর্ণা ওপর ভরসা করে চলছে জীবনের সংগ্রাম।
বন ও প্রকৃতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পাহাড়েও বৃষ্টির পরিমাণ প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। অবাধে ধ্বংস করা হচ্ছে বন। এসব কারণে পাহাড়ের পানির প্রাকৃতিক জলাধার ও উৎস মুখ দিনে দিনে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে পাহাড়ি নৃ-গোষ্ঠীর জনস্বাস্থ্যের উপর।
দুর্গম এলাকার বসবাসকারীরা বলছেন, তীব্র পানি সংকট যেন দিনের পর দিন বাড়ছে। প্রকৃতির ধ্বংসের কারণের পাহাড়ের বৈচিত্র্য এখন হুমকির মুখে। বন উজাড়, পাহাড় কর্তন, পাথর উত্তোলনের কারণে পাহাড় এখন মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। তাছাড়া এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে প্রভাবশালীরা। যদি সেসব কাজ বন্ধ করা না যায়, তাহলে পানির জন্য হাহাকার হয়ে মৃত্যু মিছিল হবে। তাদের অভিযোগ- আগের মতো বড় বড় গাছ না থাকায় ও বন উজাড়ের ফলে এই পানি সংকট তীব্র আকারে ধারণ করছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলনের বান্দরবান শাখার সভাপতি জুয়ামলিয়ান আমলাই বলেন, এক সময় ঘন জঙ্গল ও পাথরে ভরা ছিল এই বান্দরবান। উন্নয়নের জন্য অবাদে পাথর উত্তোলন, ব্যবসায়িক স্বার্থে জোত পারমিটের নামে নির্বিচারে গাছকাটা, বান্দরবানের পরিবেশকে ক্ষতবিক্ষত করে তুলছে। ফলে পরিবেশ উষ্ণ হয়ে কমছে পানির প্রবাহ। আগামীতে সেসব পাহাড়ের পানি থাকবে কি না সেটি বড় প্রশ্ন।
বান্দরবান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর তথ্য মতে, জেলার সাত উপজেলায় এই পর্যন্ত নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে ৫ শতাধিক। কিন্তু পানি স্তর নেমে যাওয়াই সেসব নলকূপ এখন অকেজো হয়ে পড়ে আছে। তাছাড়া পানি সংকট নিরসনের দুটি প্রকল্প হাতে নেয়া হলেও কবে নাগাদ বাস্তবায়িত হবে সেটি এখনো অনিশ্চিত।
মাঝের পাড়ার বাসিন্দা শৈউসিং মারমা বলেন, এই গরমের পুরো গ্রাম পানি জন্য হাহাকার অবস্থা। ময়লা পানিতে করতে হচ্ছে গোসল। তাছাড়া খালের চারিপাশে ময়লাস্তুপ। ভবিষ্যতে পাহাড়ের কি হবে এই চিন্তায় আছি।
হেডম্যান পাড়ার ইউপি সদস্য রেদা মং মারমা বলেন, পাথর, বন উজাড় করার ফলে পানি এখন নাই বললেই চলে। গোসল দূরের কথা খাওয়ার পানি পর্যন্ত সংকট। সন্ধায় হলে পানির জন্য লাইন পড়ে যায়। তাছাড়া এনজিও বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে নলকূপ দিলেও সেগুলো অকেজো হয়ে পড়েছে। কারণ ১০০ ফুট জায়গায় পাইপ দেয়া হয়েছে ৪৫ ফুট।
এ বিষয়ে বান্দরবান জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী অনুপম দে বলেন, বান্দরবানে দুর্গম পাহাড়ের সুপেয় পানির সংকট নিরসনে জন্য এডিবির অর্থায়নে দুটি প্রকল্পের কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদন পেলে পানি সংকট নিরসনের জন্য বাস্তবায়িত করা হবে বলে আশাব্যক্ত করেন তিনি।