রাঙ্গামাটি:- এশিয়ার বৃহত্তম কাপ্তাই হ্রদের মাছের উৎপাদনে রেকর্ড ছাড়ালেও বিশাল এই কাপ্তাই হ্রদে কার্প জাতীয় মাছের উৎপাদন দিন দিন শূন্যের কোটায় নেমে যাচ্ছে। হ্রদের এই মাছ উৎপাদনে অনেক কর্মকর্তা বাহবা নিলেও কার্প জাতীয় মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে কোন ধরনের উদ্যোগ নেই। কাপ্তাই হ্রদ থেকে হারিয়ে গেছে প্রায় ১০ থেকে ১২ প্রজাতির মাছ। যে কাপ্তাই হ্রদ দুই প্রজাতির চিংড়িসহ মোট ৭৫ প্রজাতির মাছের আবাসস্থল। এর মধ্যে ৬৭টি প্রজাতির মাছ দেশীয় এবং ৮ প্রজাতির মাছ বিদেশি থাকলেও বর্তমানে কাপ্তাই হ্রদে মাছের উৎপাদনে রযেছে বেশীর ভাগ কাচকি চাপিলাসহ কয়েকটি মাছের উৎপাদন। তবে এবছর কাপ্তাই হ্রদে কার্প জাতীয় মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি না পেলেও কেচিক চাপিলা ও হ্রদের প্রাকৃতিক ভাবে উৎপাদিত মাছ থেকে গত ২৫ এপ্রিল ২০২৪ মধ্যরাত পর্যন্ত মোট ১৫ কোটি ৫৬ লক্ষ ৫৬ হাজার ৯১৭ টাকা শুল্ক আদায় করতে সক্ষম হয়েছে বিএফডিসির এই কেন্দ্র।
জেলে ও ব্যবসায়ীদের মতে, কাপ্তাই হ্রদের পাঁচটি চ্যানেলে মাছ উৎপাদন হলেও বর্তমানে লংগদুর কাট্টলী-মাইনি চ্যানেলে মাছের উৎপাদন হচ্ছে। তবে অন্য চারটি চ্যানেলে মাছের উৎপাদন তুলনামূলকভাবে কম। যার মধ্যে বর্তমানে চেঙ্গী নদী আর রাইংখ্যং নদীর চ্যানেলে প্রজনন ক্ষেত্রগুলো প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে। এই প্রাকৃতিক ভাবে মা মাছ ডিম ছাড়ার চ্যানেল গুলো ফিরিয়ে আনা গেলে কার্প জাতীয় মাছের উৎপাদন আরো বৃদ্ধি পেতো। বিএফডিসি কেচিক চাপিলার রাজস্ব আয় বাড়ালেও কার্প জাতীয় মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং কাপ্তাই হ্রদ উন্নয়নের জন্য কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি এতো বছরেও।
এশিয়ার বৃহত্তম এই কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টি হয় ১৯৬০ সালে। খরস্রোতা কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে গড়ে তোলা হয় বিশাল কাপ্তাইয়ের কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎকেন্দ্র। যার ফলে বিশাল এলাকাজুড়ে সৃষ্টি হয় ৩৫৬ বর্গমাইল আয়তনের সুবিশাল কৃত্রিম কাপ্তাই হ্রদ। নবসৃষ্ট কাপ্তাই হ্রদে মাছ চাষ শুরু করে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি)।
কাপ্তাই হ্রদে এক সময় পাওয়া যেতো রুই, কাতলা, সরপুঁটি, ঘাউরা, বাঘাইড়, মহাশোল, মধু পাবদা, পোয়া, ফাইস্যা মাছের মতো দেশী-বিদেশী বড় মাছ পাওয়া যেত। কালের বিবর্তনে ক্রমশ জৌলুস হারিয়েছে কাপ্তাই হ্রদের মাছ। বস্তুত হ্রদে মৎস্য উৎপাদন বাড়লেও কমেছে রুই জাতীয় মাছ। বিলুপ্ত হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতি। প্রতি বছর নিয়ম করে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ মেট্রিক টন কাপ্তাই হ্রদে রুই জাতীয় মাছের পোনা ছাড়ে বিএফডিসি। যে মাছ গুলো হ্রদের ফেলার সাথে সাথে চলে আসে জেলেদের জালে। অধিকাশ মাছ মরে ভেসে উঠে। তবে বিলুপ্ত মাছের প্রজাতিগুলো হ্রদে ফিরিয়ে আনার কোন উদ্যোগ গ্রহণ করছে না বিএফডিসি কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে হ্রদের মাছের গবেষণার দায়িত্বে থাকা বিএফআরআই, বিলুপ্তপ্রায় মাছের প্রজাতিগুলো ফের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা কথা জানিয়েছে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, কাপ্তাই হ্রদ দুই প্রজাতির চিংড়িসহ মোট ৭৫ প্রজাতির মাছের আবাসস্থল। এর মধ্যে ৬৭টি প্রজাতির মাছ দেশীয় এবং ৮ প্রজাতির মাছ বিদেশি।
তবে বিএফআরআইয়ের হিসেবে ৭৫ প্রজাতির মাছ থাকলেও বিএফডিসির কাছে প্রায় ৪২ প্রজাতির মাছের বিপণন হিসেব পাওয়া গেছে। তন্মধ্যে বেশ কিছু প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত। কোন কোন প্রজাতির মাছের বাৎসরিক অবতরণ হিসেবও নেই, এর মধ্যে সাদা ঘনিয়া, মহাশোল, সরপুটি, মাগুর, কার্পিও, পোয়া, ফাইস্যা, কাকিলা মাছ অন্যতম।
তবে ছোট মাছের মধ্যে বিশেষ করে কেচকি, চাপিলা ও মলা মাছের আধিক্যই সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে কাপ্তাই হ্রদে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়, কেচকি, চাপিলা, কাঁটা মইল্যা, দেশী মলা, তেলাপিয়া, কালিবাউস আইড়, বাটা ও ফলি মাছ। এর মধ্যে কেচকি, চাপিলা, কাঁটা মইল্যা, দেশী মলা এই চার প্রজাতির মাছ ছোট মাছ।
এছাড়া হ্রদে মজুদকৃত মাছের মধ্যে রয়েছে, গ্রাস কার্প, সিলভার কার্প, কার্পিও, রাজপুঁটি, তেলাপিয়া, মোজাম্বিকা তেলাপিয়া, গিফট তেলাপিয়া, মহাশোল, আফ্রিকান মাগুর, বিগহেড কার্প ও থাই পাঙ্গাস। এর মধ্যে আট প্রজাতির মাছ বিদেশি প্রজাতির মাছ।
কাপ্তাই হ্রদের সাথে যাদের জীবনযাপন তারা বলেন, ‘আগেকারদিনে কাপ্তাই হ্রদে যে সব প্রজাতির বড় বড় পেতাম, সেগুলো এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না। চিতল, মহাশোল, বাঘাইড়, সিলভার কার্পসহ এসব মাছ এখন নেই বলতেই চলে। লেক এখন কেচকি-চাপিলার অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। ছোট প্রজাতির মাছই এখন বেশি ধরা পড়ছে’।
রাঙ্গামাটি মৎস্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি হারুনুর রশীদ জানালেন, ‘দেশের বাজারে ছোট মাছের চেয়ে বড় মাছের চাহিদা প্রচুর। অথচ কাপ্তাই হ্রদে এখন বড় মাছ তেমন একটা পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে হ্রদের তলদেশ ভরাটের কারণে গভীর জলাশয়ের অভাবে বড় মাছ বা গভীর জলের মাছের সংখ্যা কমছে। এছাড়া শুষ্ক মৌসুমে হ্রদে পোনা ছাড়লে হ্রদের পানি স্বল্পতার কারণে জেলেদের কেচকি জালে রুই জাতীয় মাছের পোনা ধরা পড়ে যায়। এসব কারণে কাপ্তাই হ্রদে কার্প জাতীয় মাছের উৎপাদন কমছে’।
কাপ্তাই হ্রদে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিলুপ্তি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) রাঙ্গামাটি নদী-উপকেন্দ্রের উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জানান, বিএফআরআইয়ের সর্বশেষ সরকারি হিসেবে ৭৫ প্রজাতির মাছের কথা বলা হলেও সব প্রজাতির মাছ এখন আর কাপ্তাই হ্রদে পাওয়া যায় না। দেশী মহাশোল, মধু পাবদা, পোয়া, ফাইস্যা, তেলে গুলসা ও সাদা ঘনিয়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। রুই, কাতল, মৃগেল, বাঁচা, পাতি পাবদা ও বড় চিতল এই প্রজাতিগুলো ক্রমহ্রাসমান প্রজাতির মধ্যে রয়েছে।
বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) রাঙ্গামাটি বিপণনকেন্দ্রের ব্যবস্থাপক মোঃ আশরাফুল আলম ভূইয়া বলেন, এ বছর রেকর্ড পরিমাণ শুল্ক আদায়ের মাধ্যমে ২০২৩-২৪ মৎস্য অবতরণ মৌসুম সমাপ্ত করেছে কাপ্তাই হ্রদ মৎস্য উন্নয়ন ও বিপণন কেন্দ্র রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা। গত ২৫ এপ্রিল ২০২৪ মধ্যরাত পর্যন্ত মোট ১৫ কোটি ৫৬ লক্ষ ৫৬ হাজার ৯১৭ টাকা শুল্ক আদায় করতে সক্ষম হয়েছে বিএফডিসির এই কেন্দ্র। বিগত বছর সমূহের তুলনায় ৪৫ দিন সময় কম পেলেও শুল্ক আদায় এ অর্জন অনন্য। কাপ্তাই হ্রদের মাছের অনুকূল প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের গতি প্রকৃতি বিবেচনা করে মৎস্য অবতরণের সময়সীমা নির্ধারণ, শুল্ক আদায়ের পদ্ধতিতে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতকল্পে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণসহ নানা ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আনয়ন ও সর্বোপরি এই কেন্দ্রের সকল স্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীদের ক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে অর্জন সম্ভব হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৯-২০২০ অবতরণ মৌসুমে ০৯ মাসে বিএফডিসি রাঙ্গামাটি কেন্দ্র এ যাবতকালে সর্বোচ্চ ১৫ কোটি ৩৬ লক্ষ টাকা আয় করতে সক্ষম হয়েছিল।
তিনি বলেন, বিভিন্ন উপকেন্দ্রসমূহে ২০২৩-২৪ অবতরণ মৌসুমে অবতরণকৃত মাছের প্রজাতিভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে যে, কাপ্তাই হ্রদে চাপিলা, কাচঁকি, কাজুরী, মইল্যা, বাতাসি, শোল, কই, বোয়াল মাছ সমূহের অবতরণ উল্লেখযোগ্য পরিমানে বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও চিতল, তেলাপিয়া, কালো টেংরা, গুলশা, বড় আইড়, গজার, ছোট আইড় এর অবতরণ এর পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি রুই, কাতলা, মৃগেল, বাটা, কালিবাউস, পাবদা, বাইম মাছের উৎপাদন কিছুটা কমেছে। এ সকল কমে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধান করা হচ্ছে এবং অনুসন্ধানের ফলাফল অনুযায়ী এদের উৎপাদন বৃদ্ধির যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।