শিরোনাম

ম্যালেরিয়া নির্মূলে বড় বাধা পার্বত্য জেলার সীমান্তবর্তী ১০ উপজেলা

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪
  • ৮৯ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে দেশ থেকে ম্যালেরিয়া নির্মূল করতে চায়। এর জন্য ২০০৮ সাল থেকে নেওয়া কর্মসূচির বিভিন্ন সূচকে আশাব্যঞ্জক ফলও এসেছে। ম্যালেরিয়াপ্রবণ ১৩ জেলার মধ্যে ১০ জেলা ম্যালেরিয়াশূন্য বলা চলে। কিন্তু এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তিন পার্বত্য জেলার সীমান্তবর্তী ১০ উপজেলা। সীমান্তবর্তী এসব এলাকায় দুই দেশের মানুষের মেলামেশা, ব্যবসাবাণিজ্য ও জুমচাষের কারণে কোনোভাবেই ম্যালেরিয়া কমানো যাচ্ছে না। উল্টো রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের মোট রোগীর ৯১ শতাংশই এ তিন জেলায়। এর মধ্যে বান্দরবানে মোট রোগীর ৬০ দশমিক ৩৭ শতাংশ, রাঙ্গামাটিতে ২৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ ও খাগড়াছড়িতে ২ দশমিক ৫২ শতাংশ।

এমনকি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের গবেষণায় ঢাকায় ম্যালেরিয়ার বাহক অ্যানোফিলিস মশা পাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্য দিয়ে দেশের শহরাঞ্চলেও ম্যালেরিয়ার সংক্রমণের আশঙ্কা করছেন গবেষকরা।

এসব বিষয়কে দেশ থেকে ম্যালেরিয়া নির্মূলে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিস ট্রান্সমিটেড ডিজিজেস (এটিডিএস) নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. শ্যামল কুমার দাস। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখন আমাদের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে তিনটি পার্বত্য অঞ্চল খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি। এ তিন জেলার মূল চ্যালেঞ্জ সেখানকার কিছু সীমান্তবর্তী এলাকা। এসব সীমান্তবর্তী এলাকায় অন্য জায়গার মানুষের সঙ্গে আমাদের মানুষের টুকটাক ব্যবসায়িক কারণে মেলামেশা হয়। সীমান্তবর্তী এলাকায় কিছু আত্মীয়স্বজন থাকে। সে কারণে আমরা নিয়ন্ত্রণে রাখার পরও এ মেলামেশার কারণে সংক্রমণ বেড়ে যায়।’

তবে ২০০৮ বা ২০১০ সালের সঙ্গে তুলনা টেনে তিনি বলেন, ‘ম্যালেরিয়া নির্মূলে লক্ষ্যমাত্রা এখনো ঠিক আছে, অনেক ভালো অবস্থানে আছে।’

এমন অবস্থায় আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস। দিবসটি উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ন্যায়সংগত বিশ্বের জন্য ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই আরও গতিশীল করতে হবে।

ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্তবর্তী ১০ এলাকা : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে ম্যালেরিয়া দেখা দেওয়া ১৩ জেলার মধ্যে ১২ জেলা ভারত সীমান্তবর্তী এলাকায় এবং একটি জেলা কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলা মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায়। এর মধ্যে তিন পার্বত্য জেলার সীমান্তবর্তী ১০টি উপজেলা ম্যালেরিয়া নির্মূলে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছে অধিদপ্তর। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো হলো খাগড়াছড়ির রামঘর, মাটিরাঙা, পানছড়ি ও দীঘিনালা, বান্দরবানের থানচি ও আলীকদম এবং রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি, বরকোল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি উপজেলা।

এ ব্যাপারে ডা. শ্যামল কুমার দাস বলেন, ‘বাইরে থেকে যে সব নন-ইনডিজেনাস কেস আসে, সেগুলো আমাদের একটা চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া এখানকার জুমচাষিরাও চ্যালেঞ্জ। এসব জুমচাষি দুই সপ্তাহের জন্য পাহাড়ি এলাকায় চলে যাচ্ছে। সেখানে কাজ করতে গিয়ে সেখান থেকে তারা আক্রান্ত হয়ে আসে। এসব জুমচাষির জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া আছে।’

এ কর্মকর্তা বলেন, ‘সব পাহাড়ি সীমান্তবর্তী এলাকায় রোগটি নির্মূলে চলমান কর্মসূচির পাশাপাশি গবেষণাধর্মী কিছু বিশেষ কর্মসূচিও নেওয়া হয়েছে। এসব গবেষণার ফল পাওয়া গেলে লক্ষ্যপূরণ করা সম্ভব হবে।’

এ বছর ১৩ জেলার মধ্যে ৮ জেলায় রোগী : এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত দেশের ম্যালেরিয়াপ্রবণ ১৩ জেলার মধ্যে আট জেলায় ১ হাজার ১৫৮ জন রোগী পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ রোগী পাওয়া গেছে রাঙ্গামাটিতে ৫০৩ জন। এরপর বান্দরবানে ৪৬০ ও কক্সবাজারে ১৩৮ জন। এরপর খাগড়াছড়িতে ৪০, চট্টগ্রামে ১৩, হবিগঞ্জে ২ এবং সিলেট ও নেত্রকোনায় ১ জন করে রোগী পাওয়া গেছে।

পাঁচ জেলায় কোনো রোগী পাওয়া যায়নি। জেলাগুলো হলো শেরপুর, ময়মনসিংহ, কুড়িগ্রাম, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার। এ সময় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে একজন করে মারা গেছে।

গত বছর রোগী ছিল ১০ জেলায় : গত বছর দেশে ম্যালেরিয়াপ্রবণ ১৩ জেলার ১০ জেলায় ১৬ হাজার ৫৬৫ জন রোগী পাওয়া যায়। মারা যায় ছয়জন। সর্বোচ্চ রোগী ছিল বান্দরবানে ১০ হাজার ১ জন। এরপর রাঙ্গামাটিতে ৪ হাজার ৭১৩ ও কক্সবাজারে ১ হাজার ২৬০ জন। এরপর খাগড়াছড়িতে ৪১৭ ও চট্টগ্রামে ১৪৮ জন রোগী পাওয়া গেছে। এ ছাড়া মৌলভীবাজার ৯, সিলেটে ৮, নেত্রকোনায় ৫, হবিগঞ্জে ৩ ও কুড়িগ্রামে ১ জন রোগী পাওয়া গেছে।

এ বছর শেরপুর, ময়মনসিংহ ও সুনামগঞ্জে কোনো রোগী পাওয়া যায়নি। বান্দরবান ও চট্টগ্রামে দুজন করে এবং খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজারে একজন করে মারা গেছে।

সর্বোচ্চ রোগী ও মৃত্যু ২০১৪ সালে : গত ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ম্যালেরিয়া রোগী ছিল ২০১৪ সালে ৫৭ হাজার ৪৮০ এবং সে বছর মারা যায় সর্বোচ্চ ৪৫ জন। এর পরের বছর থেকেই আশাব্যঞ্জক হারে রোগী ও মৃত্যু কমতে থাকে। পরের বছর ২০১৫ সালে ২৭ হাজার ৭৩৭ রোগী শনাক্ত হয় এবং মারা যায় ৯ জন। পরের বছর ২০১৬ সালে মৃত্যু বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ ও রোগী কমে হয় ২৭ হাজার ৭৩৭ জন। এরপর পরের বছর ২০১৭ সালে আবার রোগী বেড়ে হয় ২৯ হাজার ২৪৭ ও মৃত্যু কমে হয় ১৩ জন।

এই ১১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন রোগী ছিল ২০২০ সালে ৬ হাজার ১৩০ ও সবচেয়ে কম মারা যায় গত বছর ৬ জন।

গত দুই বছর ধরে রোগী ও মৃত্যু আগের দুই বছরের তুলনায় কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী। ২০২২ সালে ১৮ হাজার ১৯৫ জন রোগী শনাক্ত হয়, যা আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি এবং মারা যায় ১৪ জন, যা আগের বছরের মৃত্যুর দেড়গুণের বেশি। এরপরের বছর অর্থাৎ গত বছর রোগী কিছুটা কমে ১৬ হাজার ৫৬৭ জন হয় ও দ্বিগুণেরও বেশি মৃত্যু কমে হয় ছয়জন।

মোট রোগীর ৬০% বান্দরবানে, ২৯% রাঙ্গামাটিতে : গত চার বছরের ম্যালেরিয়ার রোগীর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চার জেলায় রোগী আশানুরূপ হারে কমছে না। জেলাগুলো হলো বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজার।

এর মধ্যে ২০২০ সালে মোট রোগীর ৬৮ শতাংশ ছিল বান্দরবানে। পরের বছর ২০২১ সালে মোট রোগীর ৭২ শতাংশ, ২০২২ সালে ৭৬ শতাংশ ও গত বছর ৬০ শতাংশ রোগী ছিল এ জেলায়। ২০২০ সালে মোট রোগীর ২৩ শতাংশ ছিল রাঙ্গামাটিতে। পরের বছর রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ২১ শতাংশ, ২০২২ সালে ১৮ শতাংশ ও গত বছর ২৯ শতাংশ।

গত চার বছরের মধ্যে এক বছর, অর্থাৎ ২০২২ সালে খাগড়াছড়িতে রোগী কমে শূন্য দশমিক ৯ শতাংশে নামে। বাকি তিন বছরের মধ্যে ২০২০ সালে মোট রোগীর ২ শতাংশ, পরের বছর ২০২১ সালে ১ শতাংশ ও গত বছর ৩ শতাংশ ছিল এই জেলায়।

কক্সবাজারেও ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব ঊর্ধ্বমুখী। গত চার বছরের মধ্যে প্রথম বছর, অর্থাৎ ২০২০ সালে মোট রোগীর ৬ শতাংশ, ২০২১ সালে ৫ শতাংশ, ২০২২ সালে ৫ শতাংশ ও গত বছর ৮ শতাংশ ছিল এই জেলায়।

চার প্রজাতি মূল বাহক : ডা. শ্যামল কুমার দাস জানান, দেশে ম্যালেরিয়ার বাহক অ্যানোফিলিস মশার প্রাথমিক চারটি বাহক বা চার প্রজাতির অ্যানোফিলিস মশা পাওয়া গেছে। সেগুলো হলো অ্যান ফিলিপিনেসিস, অ্যান মিনিমাস, অ্যান সানডাইকাস ও অ্যান বাইমাই (এন ডিরাস)। এ ছাড়া তিনটি সেকেন্ডারি ভেক্টর রয়েছে অ্যান ভেগাস, অ্যান অ্যানুলারিস ও অ্যান অ্যাকোনিটাস। এ প্রজাতির অ্যানোফিলিস মশা স্থানীয়ভাবে বিশেষ পরিস্থিতিতে ম্যালেরিয়া সংক্রমণে ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া অ্যান ম্যাকুলেটাস ও অ্যান উইলমরি নামে আরও দুটি প্রজাতি সন্দেহজনক ভেক্টর হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

শহরে ম্যালেরিয়ার আশঙ্কা : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘আমরা ঢাকায় ম্যালেরিয়ার বাহকের উপস্থিতি পেয়েছি। এটা খুবই উদ্বেগজনক। গবেষণায় ঢাকায় ছয়টি অ্যানোফিলিস মশার প্রজাতি শনাক্ত হয়েছে। প্রজাতিগুলো হলো অ্যানোফিলিস ভেগাস, সাবপিকটাস, আমব্রোসাস, বারবিরোস্ট্রিস, এনুলারিস ও মিনিমাস। ঢাকা ও ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকায় আমাদের গবেষণায় ম্যালেরিয়ার প্রধান বাহক অ্যানোফিলিস মিনিমাস এবং সম্ভাব্য মহামারী বাহক অ্যানোফিলিস এনুলারিস ও অ্যানোফিলিস ভেগাস পেয়েছি। ঢাকায় যেহেতু ম্যালেরিয়া বাহকের উপস্থিতি রয়েছে তাই যেকোনো সময়ে তারা যদি প্লাজমোডিয়াম প্রাপ্ত হয় তাহলে ম্যালেরিয়া সংক্রমণ ঘটাতে পারে। ম্যালেরিয়াপ্রবণ জেলা থেকে রোগী ঢাকায় এলে তার মাধ্যমে শহরে ম্যালেরিয়া সংক্রমণ ঘটার বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’

তবে শহরে ম্যালেরিয়া দেখা দিতে পারে, দেখা দিচ্ছে বা আশঙ্কা আছে, এমন কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে নেই বলে জানান ডা. শ্যামল কুমার দাস। এ কর্মকর্তা বলেন, ‘ম্যালেরিয়ার অনেক প্রজাতি আছে। সব প্রজাতি ম্যালেরিয়ার ভেক্টর বা বাহক নয়। ম্যালেরিয়ার ভেক্টর এমন যেসব প্রজাতি পাওয়া গেছে, আমাদের জানা তথ্যমতে এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণায় ঢাকা শহরে বা দেশের কোনো শহরাঞ্চলে সেই ভেক্টর প্রজাতি পাওয়া যায়নি। এটা আমাদের জন্য একটি স্বস্তির বিষয়।দেশ রূপান্তর

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions