ভারতের নির্বাচনের প্রাক্কালে বাংলাদেশে মন্দিরে হামলা! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তর্ক-বিতর্ক

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় রবিবার, ২১ এপ্রিল, ২০২৪
  • ৯৫ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- ‘সাম্যবাদী’ কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব ব্যবধান/ যেখানে মিশেছে হিন্দু বৌদ্ধ মুসলিম খ্রিষ্টান’। কবি সৈয়দ শামসুল হক ‘আমার পরিচয়’ কবিতায় লিখেছেন ‘একসাথে আছি, একসাথে বাঁচি, আজো একসাথে থাকবোই, সব বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে সাম্যের ছবি আঁকবোই।’ এমনকি গীতিকার গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার গেয়েছেন, ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিষ্টান, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি’। সত্যিই তাই। বাংলাদেশে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান- এ চার ধর্মের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন শত শত বছর ধরে চলে আসছে। বাংলাদেশে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান সৌহাদ্য -সম্প্রীতিতে বসবাস করছে। বাংলাদেশ বার আউলিয়ার দেশ, সুফিদের দেশ, এ দেশ অধ্যাত্মবাদী মুনি-ঠাকুরের দেশ। মসজিদের পাশে মন্দির, ঈদ এবং পূজা উদযাপন হয় একই সঙ্গে এবং আজানের ধ্বনির পাশাপাশি মন্দিরে বাজে বাঁশরির সুর। সেই দেশে মাঝে মাঝে বেসুরো দ্বন্দ্ব সংঘাত হয় কেন?

ভারতের চলছে লোকসভা নির্বাচন। লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের তৃর্ণমূল কংগ্রেস ও সিপিআইএম প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারণায় বিজেপির বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে বিরোধ বাঁধানের অভিযোগ তুলেছেন। এ সময় হঠাৎ করে বাংলাদেশের ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়নের পঞ্চপল্লী গ্রামের বারোয়ারী মন্দিরে আগুন কে দিল? মন্দিরে অগ্নি সংযোগের অভিযোগ তুলে বিক্ষুব্ধ স্থানীয় হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা সন্দেহবশত হামলা চালায় পাশের স্কুলে কর্মরত কয়েকজন নির্মাণ শ্রমিকদের ওপর। পিটুনিতে ঘটনাস্থলে নিহত হন মো. আশরাফুল খান ও মো. আরশাদুল খান নামের দু’জন নির্মাণ শ্রমিক। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হন আরো ৫ শ্রমিক। উত্তপ্ত মধুখালী। এ উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে গোটা ফরিদপুরে। টানটান উত্তেজনা সর্বত্র। মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশ ও বিজিবি। ঘটনা তদন্তে গঠন করা হয়েছে দু’টি তদন্ত কমিটি। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নেট দুনিয়ায় তোলপাড় চলছে। ভারতের নির্বাচনের সময় বাংলাদেশে হঠাৎ মন্দিরে কে আগুন লাগালো? হিন্দু ধর্মাবলম্বী বিক্ষুব্ধ জনতা কেন দু’জন মুসলিম ধর্মাবলম্বী শ্রমিককে পৈচাসিক ভাবে পিটিয়ে হত্যা করলো? রহস্য কি?

মাশুকুর রহমান নামের একজন লিখেছেন, ‘পশ্চিম বঙ্গে নির্বাচনের আগে আগে একটা ঘটনা ঘটেছিল মনে আছে…. সামনেই ওদের লোকসভা নির্বাচন….. যা বুঝার বুঝে নেন… মোদীকে হিন্দু মুসলিম বিরোধ সুবিধা দিতেই হয়তো ফরিদপুরের মধুখালিতে মন্দিরে আগুন ও দুজন শ্রমিককে পিটিয়ে মারার মতো ঘটনা ঘটানো হয়’। মোহাম্মদ আলী রিফাই লিখেছেন, ‘বর্বর নিকৃষ্ট। মন্দিরে কে বা কারা আগুন দিলো তা যাচাই না করেই এ কেমন নৃশংসতা ?’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন লিখেছেন, ‘ক্ষুব্ধ জনতা? নাকি উগ্র হিন্দু জনতা? লেখনি ঠিক করেন আপনারা। পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন সামনে। নাটক সাজিয়ে সাধারণ মুসলিম মেরে ফায়দা নেওয়া। জনগণ এতটা বেকুব নাই এখন আর।’ প্রসুদ নামের একজন লিখেছেন, মন্দিরে আগুন দেওয়ার কারণে কোন রকম সাক্ষ্য প্রমাণ ব্যতিরেকে নিরীহ শ্রমিকদের নৃশংসভাবে পিটিয়ে মারা হয়েছে যা চরম দুর্ভাগ্যজনক। অবিলম্বে তদন্ত পুর্বক দোষীদের বিরুদ্ধে কঠিন শাস্ত্রীমূলক ব্যবস্থা ব্গ্রহণ করা উচিত।’ ইবরাহীম মাহমুদ খান নামের একজন লিখেছেন, ‘৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ভারত সরকার আওয়ামী লীগের পাশে থেকেছিল বলে আওয়ামী লীগ ফের ক্ষমতায় এসেছে। ওবায়দুল কাদের ও হাছান মাহমুদ এ কথা স্বীকার করেছেন। এখন ভারতের লোকসভা নির্বাচনের হিন্দু-মুসলিম বিরোধ কার্ড হিন্দুত্ববাদী নরেন্দ্র মোদীর হাতে তুলে দিতে মধুখালির মন্দিরে আগুন এবং দুজনকে হত্যার ঘটনা ঘটানো হয়েছে কিনা কে জানে? ভারতে মুসলিম বিদ্বেষ জিগির তোলা ছাড়া মোদীর নির্বাচনে জেতার সুযোগ নেই’। এ ছাড়াও অনেকেই লিখেছেন, পরিকল্পিতভাবে মধুখালিতে ঘটনা ঘটানো হয়েছে বিজেপিকে পশ্চিমবঙ্গে জেতানোর লক্ষ্যে।

দেশের আইনজীবী ও রাজনীতিকরাও এ নিয়ে উদ্বেগ ও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। মধুখালির ঘটনা নিয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ডামি প্রার্থীর নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা জুলুমবাজ সরকার ব্যর্থতা আড়াল করতে এবং মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে নিতে বিভিন্ন সময় নানান অমানবিক ও অন্তর্ঘাতমূলক ঘটনা ও ইস্যু সৃষ্টি করে থাকে। এটা তারই চক্রান্ত কিনা কে জানে। এডভোকেট আসাদুজ্জামান বলেন, ফরিদপুরের মধুখালীতে মন্দিরে আগুন দেওয়ার গুজব ছড়িয়ে যে হত্যাকান্ড ঘটনার পিছনে রাজনৈতিক কোন উদ্দেশ্য আছে কিনা সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখা উচিত। প্রতিবেশি দেশে নির্বাচন চলছে। তারা এদেশে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ লাগিয়ে নির্বাচনে ফায়দা নিতে চায় কি না সেটাও ভেবে দেখতে হবে। এডভোকেট সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ফরিদপুরের মধূখালীতে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন উত্তেজিত হয়ে নির্মাণ শ্রমিক দুই ভাইকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। এ ঘটনার পিছনে রাজনৈতিক কোন উদ্দেশ্য আছে কিনা সেটা অবশ্যই ভাবতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই বলছেন, পার্শবর্তী দেশ ভারতের নির্বাচনে মোদি সরকারকে ফায়দা দেওয়ার জন্য এখানে পরিকল্পিতভাবে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা লাগানোর এই অপচেষ্টা হচ্ছে। এ বিষয়টিকে অবশ্যই গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সহকারী মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ সভাপতি মাওলানা মুহাম্মদ ইমতিয়াজ আলম বলেন, ফরিদপুরের নির্মম এ হত্যাযজ্ঞের পর সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা রহস্যজনক। পঞ্চপল্লীর উগ্র ও সন্ত্রাসী হিন্দু কর্তৃক প্রায় ৬ ঘন্টারও বেশি সময় পুলিশ প্রশাসনকে অবরুদ্ধ করে রাখার পরও সরকার কেন দ্রুত ব্যবস্থা নেয়নি এ প্রশ্ন পুরো দেশবাসির। খেটে খাওয়া দিনমজুর নিরপরাধ ২ সহোদর হত্যা পুরো দেশবাসির বিবেক নাড়া দিলেও সরকার ও প্রশাসনের ভূমিকা রহস্যজনক ও প্রশ্নবিদ্ধ।

বাংলাদেশ মুসলিম লীগের মহাসচিব কাজী আবুল খায়ের বলেন, ধর্মীয় উত্তেজনা ও উন্মাদনা সৃষ্টি করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার জন্য অতি রহস্যজনক এই ঘটনার সাথে বিশেষ কোন মহলের সম্পৃক্ততা ছিল কিনা তা প্রশাসনকে গুরুত্বের সাথে খতিয়ে দেখতে হবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির রোল মডেল বাংলাদেশকে বিশৃঙ্খল করার উদ্দেশ্যে বিশেষ কোন মহলের দূরভিসন্ধি দেশের শান্তিকামী জনগণ যে কোন মূল্যে রুখে দেবে।

বাংলাদেশের সব ধর্মের মানুষ ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় পালন করে থাকে তাদের স্ব-স্ব ধর্মীয় উৎসব। একের উৎসবে যোগ দেয় ভিন্ন ধর্মের অনুসারীরাও আর এভাবেই বাঙালির ধর্মীয় উৎসবগুলোও সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়। দেশে মুসলিমদের জন্য মসজিদভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু আছে, ঠিক তেমনি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্যও সরকারি অর্থায়নে মন্দিরভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠাগার চালু রয়েছে; বৌদ্ধ ধর্মগুরু জ্ঞানতাপস অতীশ দীপঙ্করের নামে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। গঠন করা হয়েছে খ্রিষ্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট আর উপজাতি অধ্যুষিত পার্বত্য অঞ্চলে রয়েছে তাদের নিজস্ব ধর্মীয় ও জাতিগত নানাবিধ কেন্দ্র। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ও ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি গড়ে তোলা হচ্ছে।

বাংলাদেশে আন্তধর্মীয় সম্প্রীতির সুদীর্ঘ ঐতিহ্য থাকলেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের চক্রান্ত ও ধর্মীয়-জাতিগত দ্বন্দ্ব-সংঘাতের চেষ্টা যে হয়নি, তা নয়। কিন্তু ভারতের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির বিরুদ্ধে তৃর্ণমূল কংগ্রেস ও সিপিআইম প্রার্থীরা সম্প্রদায়িক উষ্কানির অভিযোগ তুলেছেন; তখন বাংলাদেশে মন্দিরে আগুন এবং সংখ্যালঘু হিন্দুদের হাতে দু’জন মুসলমান ধর্মের শ্রমিককে হত্যার ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নানান সন্দেহ প্রকাশ করে বিতর্ক চলছে। একই সঙ্গে যোগসুত্র খোঁজার চেষ্টা হচ্ছে। বিষ্ময় প্রকাশ করে সাহাদাত হোসেন নামের একজন নেটিজেন লিখেছেন, ‘মধুখালির মন্দিরে কথিক আগুন এবং দু’জন মুসলমানকে হত্যার ঘন্টায় এখন পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হলো না, এখন পর্যন্ত কোন মামলা হলো না! মসজিদে হলে অনেক লোক গ্রেফতার হয়ে যেত। এ ঘটনা ভারতে মোদীর ভোট বৃদ্ধির ধান্না নয়তো? শ্রাবণ নামের একজন লিখেছেন, ‘কেবল মাত্র সন্দেহের বশে বিধর্মী কাউকে খুন করতে হবে – এটা মেনে নেয়া যায় না। সরকারের তদন্ত কমিটি গঠনের অর্থ ঘটনা ধামাচাপা দেয়া’।

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions