সাজেদুল হক:- মানুষটার বয়স ঠাওরের চেষ্টা করি। মুখে হাল্কা দাড়ি। ২০-২১? বিহঙ্গ বাসে পাশের সিটে বসা। চাকরি হারিয়েছেন ক’দিন আগে। চেষ্টা করছেন একটি ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার। আবেদন করেছেন। চুক্তি করে দালালকে টাকাও দিয়েছেন। কিন্তু লাইসেন্স পাচ্ছেন না। দেরি হচ্ছে। বিআরটিএতে গিয়েছিলেন জট খুলতে।
বুঝলেন, দালাল টালবাহানা করছে। ফোনে তাগাদা দিচ্ছেন কোনো এক পাওনাদার। বললেন, ভাই তোর টাকাটা দিয়ে দেবো। মোবাইলটা বেচার চেষ্টা করছি।
দুই
ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা। প্রাণবন্ত এক তরুণী। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী। স্বপ্ন ছিল বিচারক হবেন। সরব ছিলেন আত্মহত্যার বিরুদ্ধে। কিন্তু নিজেই বেছে নিলেন সে পথ। দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল তার জীবন। মৃত্যুর জন্য দায়ী করে যান সহপাঠী আর এক শিক্ষককে। এই ঘটনার পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইট-পাথরে চাপা পড়ে থাকা নানা ঘটনা সামনে আসছে।
তিন
ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় বেশি দিনের নয়। সদ্য সাবেক আমলা। মাঝে মধ্যে কথা হয়। সেদিন লিফটের গোড়ায় দেখা। রাজনীতির খবর কী? তার প্রশ্নে চমকে উঠলাম। এমন নয় যে, এ প্রশ্ন প্রথম শুনলাম। সংবাদ নিয়ে কাজ-কারবার। প্রায়ই কারও না কারও কাছে এমন শুনতে হয়। কিন্তু ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনের পর অদ্ভুত নীরবতা। কাউকে আসলে আর এ প্রশ্ন করতে শুনি না।
এথেন্স টু ঢাকা। বছরের পর বছর। ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে অনেক। কবিরাজরাও কম যান না। তারা বলেন, বিজ্ঞানীরা কি জানে? আমরা কি কম বুঝি! হরেক রকমের গণতন্ত্র আবিষ্কার করেন তারা। স্বদেশি মডেল। যেন নিজ ভূমে তৈরি করা ‘সালসা’। আদতে যা ‘আমি তন্ত্র’। আমি যা বলি সেটাই গণতন্ত্র। এর বাইরে কিছু নেই। এই তো সেদিন ভøাদিমির পুতিন যথারীতি ৮৭ ভাগের বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হলেন। সেটা বিস্ময়কর নয়। কারণ তার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। যেটা এখন দেশে দেশে হচ্ছে। কিন্তু পুতিন যখন দাবি করেন, পশ্চিমের অনেক দেশের চেয়ে তার দেশে গণতন্ত্র স্বচ্ছ তখন কিছুটা ধাক্কা লাগে বটে। বুকে চাপ পড়ে! রাষ্ট্র কেন গড়ে তুলেছিল আদম সন্তান। নানা কারণ। নিরাপত্তাই সর্বাগ্রে। নিয়তির নির্মম পরিহাস, সে নিরাপত্তার নামেই রাষ্ট্র আজ মানুষের টুঁটি চেপে ধরে। কেড়ে নেয় মৌলিক অধিকার। এমনকি বেঁচে থাকার অধিকার। মৌলিক অধিকার এতটাই মৌলিক যেকোনো আইন দ্বারা তা খর্ব করা যায় না-বিচারপতি কায়ানীর কথাটা যেন এখন কৌতুক শোনায়। নগর রাষ্ট্রে জন্ম নেয়া প্রাচীন গণতন্ত্রে মানুষের অংশগ্রহণ ছিল সরাসরি। অনেকটা হাত তোলা কিংবা ‘হ্যাঁ’, ‘না’ এর মতো। মানুষ বেড়েছে। বিস্তৃত হয়েছে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা। যদিও আদি কথাটা এখনো অক্ষয়-‘জনগণের সম্মতি’। এটিই গণতন্ত্রের প্রথম কথা। যেটা মানুষ সাধারণত প্রয়োগ করে থাকে ব্যালটের মাধ্যমে। গণতন্ত্র এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। আইনের শাসন, স্বচ্ছতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা পরিণত হয়েছে গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান স্তম্ভে। উপরে উল্লিখিত প্রতিটি ঘটনার সঙ্গেই যে কারণে জড়িয়ে আছে গণতন্ত্রের প্রশ্ন। পূর্ণাঙ্গ আইনের শাসন আর স্বচ্ছতা থাকলে হয়তো অবন্তিকাকে এভাবে জীবন দিতে হতো না, দেশের রাজনীতি নিয়ে এত প্রশ্ন উঠতো না, গাড়ির লাইসেন্সের জন্য ঘুষ হাতে নিয়ে ঘুরতে হতো না।
গণতন্ত্রের শরীর কেমন? বিশ্বব্যাপীই এ প্রশ্ন উঠছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, একসময় কীভাবে বন্দুকের নল সকল ক্ষমতার উৎসে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু এখন খেলা ঘুরে গেছে। দেশে দেশে উত্থান হচ্ছে একনায়কতন্ত্র আর গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রের। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী র্যারি ডায়মন্ড যেটাকে বলেছেন গণতন্ত্রের মন্দা। তিনি আশঙ্কা করছেন, গণতন্ত্রের মৃত্যু হতে পারে বা এটি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। ডেভিড রাঞ্চিমান অবশ্য মনে করেন, গণতন্ত্র মারা যাচ্ছে না। তবে এটি মধ্যবয়সের সংকটে রয়েছে। মূলত লোকরঞ্জনবাদীদের বিস্ময়কর উত্থানের প্রেক্ষাপটে তারা এসব মন্তব্য করেছেন। আমরা কী দেখছি? ডনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকায় এখনো আগের মতোই জনপ্রিয়। তার হোয়াইট হাউসে ফেরার সম্ভাবনা ক্রমশ বাড়ছে। ভারতে নরেন্দ্র মোদিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন এমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু আমরা পুতিনের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি। পশ্চিমের গণতন্ত্র অবশ্যই এখনো অনেক জীবন্ত, প্রাণবন্ত। তাহলে এর মূল সংকট কোথায়? কখনো কখনো পশ্চিমারা গণতন্ত্রের নামে ‘হিপোক্রেসির’ আশ্রয় নিয়েছেন, নিচ্ছেন। ক’দিন আগের কথাই ধরা যাক। পাকিস্তানে সেনাবাহিনী ভোটের সময় ইমরান খানকে কীভাবে কোণঠাসা করে রাখে তা ছিল স্পষ্ট। কিন্তু আমেরিকা বা পশ্চিমা দেশগুলো এ নিয়ে কোনো ‘রা’ করেনি। জ্যঁ পল সার্ত্রতো আর এমনি এমনি বলেননি, রাষ্ট্র বা ব্যক্তি একই। প্রত্যেকেই স্বার্থপর।
সরল কথায় বললে, সারা দুনিয়াতেই গণতন্ত্র এখন সংকটে। কেউ বলেন, আইসিইউতে কেউবা বলেন লাইফ সাপোর্টে। সব র্যাংকিংয়েই গণতন্ত্রের অবনমন। এর বেঁচে থাকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তবে বাংলাদেশের মতো অনেক দেশের সংকট আলাদা। এসব দেশে কান পাতলেই ব্যালটের কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। যদিও বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের নেপথ্যে ব্যালটের ভূমিকা ঐতিহাসিক। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থনের মাধ্যমে এ অঞ্চলের মানুষ মূলত পাকিস্তান রাষ্ট্রের মৃত্যু ঘোষণা করে। গণতন্ত্রের আকাক্সক্ষায় এদেশের মানুষ অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করেছে। যদিও গণতন্ত্র এখানে সরল রেখায় চলেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছ নির্বাচন হলেও এ ব্যবস্থাকে বেঁচে থাকতে দেয়া হয়নি। এখন এদেশে খেলা চলে গেছে অন্যদের হাতে। জনগণ মূলত দর্শক। গ্যালারিতে বসে বসে খেলা দেখছেন। যেন তাদের কিছুই করার নেই।
গণতন্ত্র কি মারা যাচ্ছে?
গণতন্ত্র কি মৃত্যু ঝুঁকিতে রয়েছে। গেল বেশ কয়েক বছর ধরে পশ্চিমে এ প্রশ্ন উঠছে। পণ্ডিতরা এর জবাব খুঁজছেন। ডেভিড রাঞ্চিমান তেমনি একজন। এ নিয়ে বিবিসি’র একটি রিপোর্টের একাংশ আমাদের পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি। এতে বলা হয়েছে, গণতন্ত্র মারা যাচ্ছে না, কিন্তু এখন এটি একটি অনিশ্চিত মধ্যবয়সের সংকটে পড়েছে। এটাই মনে করছেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ডেভিড রাঞ্চিম্যান। যিনি ট্রাম্প আমল, সামাজিক মাধ্যম আর অর্থনৈতিক নানা বিভেদ মিলিয়ে পশ্চিমা গণতন্ত্রকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। ‘কীভাবে গণতন্ত্রের বিনাশ হবে’ নামের বইতে অধ্যাপক রাঞ্চিম্যান যেসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন, তার মধ্যে রয়েছে আমাদের এখনকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কি ভেঙে পড়তে শুরু করেছে? তিনি বলেছেন, বেশির ভাগ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং হতাশার শুরু হয়েছে ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকট থেকে। ‘রাজনৈতিক ব্যর্থতার শুরুটা হয়েছিল সেই বিশেষ সময় থেকে’ তিনি বলছেন। অধ্যাপক রাঞ্চিম্যান মনে করেন, গণতন্ত্র এখন একটি মধ্যবয়সের সংকটে ভুগছে। যেখানে ভোটাররা নিজেদের একটি প্রথার মধ্যে আটকে রয়েছেন বলে মনে করেন এবং বড় ধরনের পরিবর্তন চান। অথচ তারা আবার এটাও আশা করেন না যে, মৌলিক ব্যাপারগুলো পাল্টে যাক। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, সামনে হয়তো আরও ‘অদ্ভুত’ এবং ‘অদ্ভুত’ মানুষ নির্বাচিত হয়ে আসতে পারেন। তবে এর কারণ হচ্ছে যে, মানুষ মনে করে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এতটাই শক্ত যে, এসব তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
২০১৮ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টিভেন লেভিটস্কি ও ড্যানিয়েল জিবলাট লিখেন ‘হাউ ডেমোক্রেসিস ডাই।’ গণতন্ত্র কীভাবে মারা যায়? ধীরে ধীরে এমনকি উন্নত দুনিয়াতেও। তারা দেখিয়েছেন আমেরিকার মতো গণতান্ত্রিক দেশেও গণতন্ত্র মারা যেতে পারে। ডনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকায় যেভাবে ঘৃণা বা বিভাজনের রাজনীতি ছড়িয়েছেন তার প্রেক্ষাপটেই এ বই লেখা হয়েছে। তাদের ভাষ্য হচ্ছে আমেরিকার রাজনীতিবিদরা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের এখন শত্রু বলে বিবেচনা করেন। আমাদের এখানে পরিস্থিতি কি তা বলাই বাহুল্য। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিরা শত্রু এবং তাদের বিনাশই প্রধান কর্তব্য বিবেচনা করেন অনেক রাজনীতিবিদ।
একটা সময় সামরিক শাসন ছিল অনেকটা নিয়মিত ঘটনা। এখনো যে তা ঘটছে না তা নয়। এমনকি কোথাও কোথাও আমরা পশ্চিমের দেশগুলোকেও এধরনের সরকারকে সমর্থন দিতে দেখেছি। ‘ইসলামী দুনিয়া’ এমনিতেই গণতন্ত্র ভালোবাসে না। রাজতন্ত্রের প্রতি তাদের যত আবেগ। আরব বসন্ত রাজশাসকদের ভিতে কম্পন তৈরি করেছিল। কিন্তু পরে তা ব্যর্থ হয়। পলিটিক্যাল ইসলামের উত্থান ঘটে কি-না সে বিষয়টিও সম্ভবত বিবেচনায় ছিল। এখন মেকানিক্যাল গণতন্ত্রের জয়জয়কার। ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানগুলোকে কুক্ষিগত করা হয়। বিচারালয় বা দুর্নীতি দমনের মতো সংস্থাকে নেয়া হয় নিজেদের কব্জায়। দুর্নীতির মতো নানা অভিযোগকে ব্যবহার করা হয় বিরোধীদের দমনে। কখনো তাদের নিক্ষেপ করা হয় কারাগারে। ক্রমশ তাদের করা হয় দুর্বল। একসময় তারা নিজেরা চলার শক্তি হারিয়ে ফেলে। জনগণকে করা হয় বিভক্ত। কখনো কখনো ব্যবহার করা হয় ধর্মীয় কার্ড। তৈরি করা হয় ভয়ের সংস্কৃতি। নাগরিক সমাজ ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। কেউবা নাম লেখান শাসকদের পূজারী হিসেবে। যারা সক্রিয় থাকেন তাদের কণ্ঠও হয়ে যায় ক্ষীণ।
সমালোচকের নিরাপত্তা
আমার এক শিক্ষক প্রায়ই কথাটি বলতেন। ‘গণতন্ত্র হচ্ছে এমন এক ব্যবস্থা যেখানে সরকারকে তার সমালোচকের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হয়।’ আইনের শাসন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছাড়া আসলে গণতন্ত্র বাঁচে না। মানুষের অধিকার রক্ষার কবচ হিসেবে গণতান্ত্রিক দুনিয়ায় বিচারালয় ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে থাকে। জনগণ জানে, সরকারই শেষ কথা নয়। বরং শেষ কথা বলার জন্য তাদের আদালত রয়েছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্যও আদালতের ভূমিকা অপরিহার্য।
বাংলাদেশে মিডিয়ার সংখ্যা এখন বিপুল। তবে বিপুল সংখ্যাই স্বাধীন সাংবাদিকতার নিশ্চয়তা দেয় না। ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের একটি লেখা থেকে কিছু অংশ পুনরুল্লেখ করতে চাই, ‘‘অসংখ্য পত্রিকার অস্তিত্ব মানে অনেক পাঠক, সংবাদের জন্য অনেক সূত্র এবং নিজ নিজ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শ্রেণির প্রেক্ষাপটে অনেক মানুষের তথ্যের অবাধ প্রবাহে অংশগ্রহণ। এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। চেয়ারম্যান মাও সেতুংয়ের ভাষায়, আসলেই কি ‘হাজার ফুল’ ফুটেছিল, নাকি বিষয়টা এরকম, অনেকগুলো গাছ থেকে একই অথবা একই ধরনের ‘ফুল’ ফুটেছে, সেটা অনুধাবন করতে হবে। এই রূপকের মাঝেই লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের আজকের গণমাধ্যমের প্রকৃত অবস্থা।’’
বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে বারবার বাক বদল হয়েছে। এরশাদ জমানায় ‘দুর্নীতপরায়ণদর উল্লাসের নৃত্য’ লিখে বিপাকে পড়েছিলেন মতিউর রহমান চৌধুরী। বন্ধ হয়ে যায় খবরের কাগজ। তবে মুক্তি মিলে উচ্চ আদালতে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পথ খোলে। প্রয়াত প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান থাকার সময় বাতিল করে দেন স্বাধীন সাংবাদিকতা বিরোধী কালাকানুন। ১৯৯১-২০০৬ একটি ধারা। যা অনেকটাই স্বাধীন। তারপর নতুন যুগ। সেটি এখন অনেক বিস্তৃত। গণতন্ত্র যেমন, সাংবাদিকতাও তেমন, সেটি কি অস্বীকার করার জো আছে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ইতিহাস বুঝতে মতিউর রহমান চৌধুরীর লেখা ‘দুর্নীতিপরায়ণদের উল্লাসের নৃত্য’ লেখাটি মাঝে মধ্যেই পড়ি। বিস্মিত হই। শ্রদ্ধা জানাই প্রয়াত সম্পাদক কাজী শাহেদ আহমেদকেও।
আগ্রহী পাঠকরা সেই লেখাটি পড়ে দেখতে পারেন-
এমন একদিন আসবে যেদিন মূর্খরা উদ্ভট আদেশ জারি করে দেশ শাসন করবে। নির্বোধরা তাদের নির্বুদ্ধিতার জন্য গর্ব অনুভব করবে। পণ্ডিতরা তাদের পাণ্ডিত্যের জন্য অনুশোচনা বোধ করবেন। দুর্নীতিপরায়ণরা তাদের দুর্নীতির জন্য উল্লাসে নৃত্য করবে। সাধক শেখ সাদী এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তিনি অবশ্য সময় বলে যাননি কখন এমন ঘটনা ঘটবে। আমরা প্রতিদিনই এমন ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছি। অনেক মিলও খুঁজে পাচ্ছি। তাহলে কি শেখ সাদীর বর্ণিত সেদিন এসে গেছে। রাষ্ট্র পরিচালনা করছে কারা? দেশে দেশে কিছু উদ্ভট আদেশ জারির মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার খবর আমরা পাচ্ছি। তাদের মূর্খ বলা ঠিক হবে কিনা জানি না। তবে জনগণকে নিয়ে তারা তামাশা করে চলেছে। এমন আদেশ জারি করছে যা না মেনে কোনো উপায় নেই জনতার। এরা জনগণকে ভয় পায় না। জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায় না। মাঝে মধ্যে জনগণের সঙ্গে অভিনয় করে। বলেÑজনগণই আমার শক্তি। আসলে জনগণের পক্ষে তারা কথা বলে না। এরা নিজেদের সবজান্তা মনে করে। জনগণকে বলে দেয়, আমি যা বলবো তাই মেনে চলতে হবে। জনগণের সেবক নয়, তারা চায় জনগণ তাদের সেবা করুক। এরা আইন মানে না। সংবিধান মানে না। তাদের ইচ্ছার ওপর দেশ চলে। দেশে দেশে এমন অবস্থা চলছে। যার রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা থাকার কথা নয় বা রাষ্ট্র পরিচালনা তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না অথচ তারা বলপূর্বক ক্ষমতা দখল করে বলেÑএভাবে দেশ চলতে পারে না। আজ থেকে আমি যেভাবে বলবো সেভাবে দেশ চলবে। রাষ্ট্র বিজ্ঞানীরা মাঝেমধ্যে তাদের উন্মাদ বলে আখ্যায়িত করেন। তাতে কি যায় আসে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা কিছুই জানেন না বলে তারা প্রকাশ্যে মন্তব্য করেন। রাজনীতিবিদরা দেশ চালানোর কোনো যোগ্যতা রাখে না বলে ফরমান জারি করে দেয়। বলে- রাজনীতিবিদরা দেশের সব অনিষ্টের মূল। এদের সমাজ থেকে নির্মূল করে দিতে হবে। ক’দিন পর যখন দেখে রাজনীতিবিদ ছাড়া চলে না তখন আবার রাজনীতিবিদদের ডেকে নিয়ে উজির বানায়। অর্থনীতিবিদদের ভর্ৎসনা করে স্পষ্ট বলে দেয়Ñএরা অর্থনীতির কি বুঝে? আমি সবই বুঝি। আমি লেফট রাইট করেও সব জেনেছি। বড় বড় বই পড়ার কোনো দরকার নেই। আমি কূটনীতিও বুঝি। সমালোচকরা বলে, আমি নাকি জেনারেল ডিপ্লোম্যাসিতে বিশ্বাস করি। এটা সর্বৈব মিথ্যা। আমি সব কূটনীতিতেই ওস্তাদ। সিদ্ধান্ত নিয়ে পাল্টানোর মধ্যে মজা আছে। পৃথিবীতে ক’জন পারে সিদ্ধান্ত পাল্টাতে। আমি কারও সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেই না। আমি মনে করি, আমার চাইতে অন্যরা বেশি জানতেই পারে না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য সিদ্ধান্ত নেই। সেভাবে কাজ করি। অন্যরা কে কি ভাবলো বা মনে করলো তা নিয়ে মোটেও চিন্তা করি না। আমার কাছে রাষ্ট্র বা জনগণ হচ্ছে পণ্য। সময় বুঝে নিলামে তুলি। অন্য রাষ্ট্রপ্রধান টেলিফোন করলে দাঁড়িয়ে কুর্নিশ জানাতে থাকি। হার্ভার্ডে পড়ালেখা করা লোককে বলি সে ইংরেজি জানে না। আমার ইংরেজি শুনে বৃটিশরাও বলে কি করে এত সুন্দর ইংলিশ শিখলাম।
আমি মনে করি, আমি ছাড়া সবাই নির্বোধ। তাই আমি বছরের পর বছর তাদের নির্বোধ হিসেবেই বিবেচনা করি। তারা আমার কথা হেরফের করে না। বরং গর্ব অনুভব করে। বলে-আমরা গর্বিত এমন এক সন্তানকে পেয়ে; যিনি না হলে রাষ্ট্র চলতোই না। পল্লীর বন্ধু হিসেবেও স্বীকৃতি দিয়ে বসে। আমি শহরে থাকি। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসা। মাঝেমধ্যে হেলিকপ্টারে উড়ে পল্লীতে যাই। কান্নাকাটি করি তাদের সুখ-দুঃখে। ফিরে এসে বলি এই ব্যাটাদের জন্য শান্তিতে থাকা গেল না। একটা না একটা সমস্যার মধ্যে ওরা থাকেই। কখনো পানিতে, কখনো রোগে-শোকে আবার কখনো অনাহারে। বলেন তো আর কাহাতক পারা যায়। আমি আর পারি না। আমারও তো আরাম-আয়েশের কথা চিন্তা করতে হয়। লোকে আমার সম্পর্কে অযথাই সমালোচনা করে। আমি শত ব্যস্ততার মধ্যেও কিছু সময় আমোদ-ফুর্তিতে ডুবে থাকি তাও অনেকের সহ্য হয় না। তারা কানাঘুষা করে। অবশ্য জনসমক্ষে কিছু বলে না। তাদের আমি নির্বোধ বলি। জানেন তো আমার রাজ্যে পণ্ডিত বলে তো কেউ নেই। কারণ আমার জ্ঞানের চেয়ে তাদের জ্ঞান বেশি নয়। আমি তাদের বলেই দিয়েছি পাণ্ডিত্য যেন না দেখায়। আমি বৈঠক ডাকি। আলোচনা করতে বলি তাদের মধ্যে। ঘুরে এসে বলি আপনারা এবার বাড়ি যান। সিদ্ধান্ত আমি নিয়ে ফেলেছি। তারা কোনো প্রশ্ন করে না। জানে, আমার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। কতিপয় লোক ছিল শুধু শুধু আমার সমালোচনা করতো। বলতো আমার নাকি রাষ্ট্র পরিচালনার কোনো অধিকার নেই। এখন তারা ক্লান্ত। নিজেরাই বলছে, কেন রাজনীতি করলাম, কেন দেশ স্বাধীন করলাম। এত লেখাপড়া করলাম কেন? তারা নিজেদের পাণ্ডিত্যের জন্য অনুশোচনা করে বলছেÑআমি যোগ্য ব্যক্তি। আমার মতো পণ্ডিত লোক হয় না।
দুর্নীতির কথা বলবেন। আমি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছি। তবে আমাকে লোকে দুর্নীতিবাজ বলে। আমি নাকি টাকা পাচার করি। জনগণের রক্ত শুষে নিচ্ছি। আমার রাজ্যে দুর্নীতিবাজরা উল্লাস করে বলে আমরা দুর্নীতিবাজ-আসুন আমরা দুর্নীতিকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেই। কেউ কেউ সমালোচনার চেষ্টা করে। সুযোগ মতো তাদের নামও খাতায় লিখিয়ে দেই। অথবা মুখ বন্ধ করে দেই চেনাপথে। আমার কাছে জাদু আছে। গভীর রাতে আমার সঙ্গে সবাই দেখা করতে আসে। যারা পল্টনে গরম গরম বক্তৃতা করে তাদের দেখাও পাবেন আমার বাড়িতে। আমি মাঝেমধ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তালিকা প্রকাশ করে বলি ওদের এবার রেহাই নেই।
জনগণের সামনে বলি, রাঘববোয়ালদের পাকড়াও করতে হবে। রাতে তাদের ডেকে বলি মনে কিছু করো না। আমাকে বলতে হয়। আমি যে রাষ্ট্র চালাই। তোমাদের কিছু হবে না। তোমরা ধরা পড়লে আমার কী হবে। তোমরাই তো আমার আসল শক্তি, বন্ধু। এ কথা শুনে দুর্নীতিবাজরা উল্লাস করে। এই উল্লাসে আমরা সবাই যোগ দেই।
লাইনচ্যুত ট্রেন
ভোট ও ভাতের অধিকারের জন্য এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে অনেক। কোটিপতির সংখ্যা, মাথা পিছু আয় বেড়েছে জ্যামেতিক হারে। যদিও লাখ লাখ মানুষ এখনো খাদ্যের সংস্থানের জন্য লড়াই করছেন। সরকারি জরিপ তাই বলছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলের মতো গর্ব করার মতো স্থাপনা হয়েছে। প্রশ্ন হলো গণতন্ত্র কোথায় দাঁড়িয়ে? মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান আকাক্সক্ষা ছিল গণতন্ত্র। স্বাধীন দেশের যাত্রার শুরুতেই সপরিবারে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন বঙ্গবন্ধু। এরপর অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান, সামরিক শাসন একটা অস্থির সময় অতিক্রম করেছে বাংলাদেশ। স্বৈরাচার বিরোধী দীর্ঘ সংগ্রাম। অবশেষে উঠে গণতন্ত্রের সূর্য। আবার আন্দোলন, রক্তপাত। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার জন্ম। ২০০১ সাল পর্যন্ত এক ধরনের ধারাবাহিকতা। মানুষ অন্তত একদিনের জন্য বাদশাহ ছিল। বিচারপতিদের বয়স বাড়ানো নিয়ে বিতর্ক। ফের আন্দোলন। জরুরি শাসন। পরে আবার অবাধ নির্বাচন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মৃত্যু। এরপর গত তিনটি নির্বাচন হয়েছে তিন মডেলে। উপেক্ষিত জনগণ। গণতন্ত্রের ট্রেন লাইনচ্যুত। কৌশলী শাসক দল। প্রতিবেশীদের উন্মুক্ত সমর্থন। বারবারই ছক্কা মারে। বিরোধীরা বুঝতেই পারেন না কোথা থেকে কী হয়ে যায়। যারা বুঝেন তারা বিক্রি হয়ে যান রাতের আঁধারে। অবুঝ কাউকে কাউকে মূল্য দিতে হয়। কোনো কোনো পণ্ডিত বলে থাকেন, ভোটই গণতন্ত্র নয়। কিন্তু ভোট ছাড়া গণতন্ত্র হয় না এটা তাদের কে বুঝাবে। মুক্ত মানুষের বিরোধ নিষ্পত্তির সবচেয়ে উত্তম মাধ্যম ব্যালট। কিন্তু এখানে ব্যালট নীরবে কাঁদে।
(মানবজমিন ঈদ সংখ্যা ২০২৪ এ প্রকাশিত)