
গণভোট ও জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে জটিলতা সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ থাকলে সরকারের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন, তাই দলগুলোকে বিরোধ মেটাতে আমরা অনুরোধ করব : ড. আসিফ নজরুল জাতির বৃহত্তর স্বার্থে আমরা সবসময় আলোচনার জন্য প্রস্তুত : সালাহউদ্দিন আহমদ সরকারের পক্ষ থেকে উপদেষ্টারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সমঝোতার প্রস্তাব দিয়েছেন : অ্যাডভোকেট হামিদুর রহমান আযাদ সরকারের সমঝোতার উদ্যোগ অবশ্যই ভালো, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন হলেই আমরা খুশি : নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী
ডেস্ক রির্পোট:- গণভোটের দিন-ক্ষণ এবং জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতানৈক্য অন্তর্বর্তী সরকারকে বেশ চাপে ফেলে দিয়েছে। এর ফলে আগামী ফেব্রুয়ারিতে একটি অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে সরকার সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। তাই গণভোট ইস্যুতে যে মতানৈক্য দেখা দিয়েছে তা নিরসনে সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যকার সৃষ্ট বিরোধ দূর করতে সরকারের তরফ থেকে পর্দার আড়ালে সমঝোতার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। তবে গতকাল পর্যন্ত দলগুলোর অনড় অবস্থানের প্রকাশ্যে কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যায়নি। সরকারের সঙ্গে পুনঃরায় এ নিয়ে আলোচনা হবে কি-না সেটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে প্রধান উপদেষ্টা এ বিষয়টি দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে একটি সুন্দর সমাধানে পৌঁছাতে চান। এ জন্য তিনি আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের নেতৃত্বে তিন উপদেষ্টাকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার দায়িত্ব দিয়েছেন। উপদেষ্টারা একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি নেতাদের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। আগামী দু-এক দিনের মধ্যে একটি সমাধান সূত্র বেরিয়ে আসবে এমন ইঙ্গিত সরকার ও দলগুলোর একাধিক ঘনিষ্ঠ সূত্রে পাওয়া গেছে।
গত ২৮ অক্টোবর জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে সুপারিশ জমা দেয়ার পরপরই রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরবিরোধী অবস্থান প্রকাশ্যে আসে। এক দল অন্য দলের বিরুদ্ধে ক্রমাগত বক্তব্য দিচ্ছে। গণভোট ও জুলাই সনদ ইস্যুতে দলগুলোর মধ্যে এরকম মুখোমুখি অবস্থানে সরকার বিব্রত। এ কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বিরোধ মেটাতে পর্দার আড়ালে সমঝোতার চেষ্টা চলছে। গত ৩০ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকেও এ ব্যাপারে আলোচনা হয়। বিষয়টি সমাধানে আইন উপদেষ্টার নেতৃত্বে যাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তারা ইতোমধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ ও জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহেরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। এ বিষয়ে এনসিপি নেতারা বলছেন, যেকোনো মূল্যে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন হোক তা তারা নিশ্চিত করতে চান। এ ক্ষেত্রে সরকার কোনো পদক্ষেপের কারণে দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা হলে তাদের কোনো আপত্তি থাকবে না। আপাতত তারা বলকে সরকারের কোর্টেই দেখছেন। এখন সরকার কী সিদ্ধান্ত নেয় তা দেখার অপেক্ষায়।
সরকারের একটি সূত্র জানায়, বিএনপি ১৫টি সংস্কারে নোট অব ডিসেন্ট দিলেও দলটিকে পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন পদ্ধতিতে আপত্তি তুলে নিতে অনুরোধ করা হয়েছে। জামায়াতকে নির্বাচনের আগে গণভোট এবং নিম্মকক্ষে পিআর দাবি ছাড়তে অনুরোধ করা হয়েছে। বিএনপির দিক থেকে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে, উচ্চকক্ষে পিআরের বিষয়টি তারা পর্যালোচনা করবে। তবে জামায়াতকে নির্বাচনের আগে গণভোট এবং নিম্মকক্ষে পিআর দাবি প্রকাশ্যে ত্যাগ করতে হবে। জামায়াতের দিক থেকে জানানো হয়েছে, বিএনপি সনদ অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন এবং আসন্ন সংসদ নির্বাচনে পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন মেনে নিলে তারা সমঝোতায় রাজি আছে। সরকার এ বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছানোর বিষয়ে আশাবাদী। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে সরকারের পক্ষ থেকে লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলারও উদ্যোগ নেয়া হবে। এ ছাড়া জামায়াতের আমিরে সাথেও সরকার কথা বলবে।
সমঝোতার পর জুলাই সনদ বাস্তবায়ন-সংক্রান্ত আদেশ জারি হতে পারে। সমঝোতার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কয়েকটি বিষয় নিয়ে চিন্তা করছে। প্রথমত, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক না করে আগামী সংসদের সংবিধান সংস্কার পরিষদের ওপর ছেড়ে দেয়া। দ্বিতীয়ত, অধিকাংশ উপদেষ্টা জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট এক দিনে আয়োজনের পক্ষে। তৃতীয়ত, জুলাই সনদে প্রধান উপদেষ্টার পরিবর্তে প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষরে আদেশ জারি করা। তবে এখন পর্যন্ত এসব বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার মনে করে, ঢাকায় বিএনপির যে নেতৃত্ব রয়েছে, তারা বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। এ জন্য লন্ডন থেকে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সম্মতি লাগবে। তাই প্রধান উপদেষ্টাকে তারেক রহমানের সঙ্গে কথা বলার অনুরোধ করা হয়েছে। সমঝোতার সর্বশেষ উপায় হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা নিজেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও জামায়াত আমিরের সাথে কথা বলবেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
গত ৩০ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেন, সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ থাকলে সরকারের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন। তাই দলগুলোকে বিরোধ মেটাতে আমরা অনুরোধ করব।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জাতির মধ্যে অনৈক্য তৈরি করেছে। তারা পুরো জাতির সঙ্গে প্রতারণা করেছে। তাই এটি সমাধানের জন্য সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। সরকার যদি আবার আলোচনার উদ্যোগ গ্রহণ করে তাহলে আমরা তা অবশ্যই ভেবে দেখব। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে আমরা সবসময় আলোচনার জন্য প্রস্তুত।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে উপদেষ্টারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তারা যোগাযোগ করে সমঝোতার চেষ্টা করবেন, এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের দলীয় অবস্থান হলোÑ আগে গণভোট হতে হবে। না হলে সংস্কার উদ্যোগ বৃথা যাবে। একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট হলে জটিল পরিস্থিতি তৈরি হবে। সুতরাং আগে গণভোট হতে হবে।
চলমান সংকট প্রসঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে সরকার সমঝোতার চেষ্টা করছে। এটি অবশ্যই একটি ভালো উদ্যোগ। বিএনপি ও জামায়াত এক জায়গায় চলে এলে অবশ্যই তা ভালো। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন হলেই আমরা খুশি।
উল্লেখ্য, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাষ্ট্র সংস্কারে জুলাই সনদে ৮৪টি প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬১টি প্রস্তাবেই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) রয়েছে। সংবিধান সংশোধনে রয়েছে ৪৮টি প্রস্তাব। আর এ পর্যন্ত বিএনপি, জামায়াতসহ ২৫টি রাজনৈতিক দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছে। এরপর গত ২৮ অক্টোবর সনদ বাস্তবায়নে প্রধান উপদেষ্টার কাছে সুপারিশ করেছে ঐকমত্য কমিশন। সুপারিশগুলো তিন ভাগে বাস্তবায়ন হবে। ৯টি নির্বাহী আদেশে, ২৭টি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে এবং সংবিধান সংশোধন-সংক্রান্ত ৪৮টি প্রস্তাব গণভোটের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হবে। এছাড়াও পরবর্তী সংসদ দুটি দায়িত্ব পালন করবে। প্রথমত, সংবিধান সংস্কার পরিষদ। দ্বিতীয়ত, নিয়মিত আইনসভা। সুপারিশে আরো বলা হয়, আগামী সংসদে নির্বাচিত সদস্যরা প্রথম অধিবেশন শুরুর ২৭০ দিনের মধ্যে জুলাই সনদ অনুসারে সংবিধান সংশোধন করবেন। এ সময়ের মধ্যে তারা সংবিধান সংশোধনে ব্যর্থ হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জুলাই সনদের প্রস্তাবগুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে। এরপর ৪৫ দিনের মধ্যে পিআর পদ্ধতিতে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠিত হবে। এক্ষেত্রে কোনো দলের নোট অব ডিসেন্ট আমলে নেয়া হয়নি। সুপারিশে আরো বলা হয়, সনদ বাস্তবায়নে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে ভিত্তি ধরে সরকার একটি আদেশ জারি করবে। আদেশের নাম হবে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫’। সনদের চূড়ান্ত আইনি ভিত্তি দিতে হবে গণভোট। তবে গণভোটের সময় সরকার নির্ধারণ করবে।ইনকিলাব