ডেস্ক রির্পোট:- প্রায় এক বছরের আলোচনা ও চেষ্টার পর সই হলো জুলাই জাতীয় সনদ। গতকাল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে সনদে সই করেন রাজনৈতিক দলের নেতারা। একইসঙ্গে প্রফেসর ইউনূসসহ কমিশনের সদস্যরাও এই সনদে সই করেন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় অংশ নেয়া ৩০টি দলের মধ্যে ২৪টি দল সনদে সই করেছে। গণফোরাম অনুষ্ঠানে অংশ নিলেও সনদে পরে সই করবে বলে জানিয়েছে। এর বাইরে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি এবং চারটি বাম দল জুলাই জাতীয় সনদের স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অংশ নেয়নি। সনদ সইয়ের অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, বিশিষ্ট ব্যক্তি, বিদেশি দূতাবাসের প্রতিনিধি, বিভিন্ন বাহিনী প্রধানরা উপস্থিত ছিলেন।
সনদে সই করার পর প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, রাজনৈতিক দল ও ঐকমত্য কমিশন ‘অসম্ভবকে সম্ভব’ করেছে। সারা বিশ্বের কাছে এটি ‘উদাহরণ হয়ে থাকবে’।
শুক্রবার বিকাল ৫টায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ স্বাক্ষরের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। বিকাল ৪টায় অনুষ্ঠান শুরুর কথা থাকলেও বৃষ্টির কারণে আধা ঘণ্টার বেশি দেরিতে অনুষ্ঠান শুরু হয়। এই অনুষ্ঠানকে ঘিরে সকাল থেকে অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি তৈরি হয়। তিন দাবিতে জুলাই যোদ্ধারা অনুষ্ঠানস্থলে অবস্থান নিলে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়। পরে লাঠিচার্জ করে সেখান থেকে তাদের সরিয়ে দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জুলাই সনদ সইয়ের অনুষ্ঠান চলার সময়েও সংসদ ভবন এলাকার পাশে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন এসব জুলাইযোদ্ধা।
বিকাল সাড়ে ৪টায় ব্যান্ডদলের বাদ্যের তালে মঞ্চে উপস্থিত হন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। তাকে স্বাগত জানান- ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ। বিকাল ৪টা ৩৭ মিনিটে জাতীয় সংগীতের মধ্যদিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়।
প্রফেসর ইউনূসের সঙ্গে মঞ্চে ছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের. সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি ও আবুল হাসান রুবেল, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের হাসনাত কাইয়ুমসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা ছাড়াও আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, শিক্ষা উপদেষ্টা সিআর আবরার, খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার, পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম, জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান এবং বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খানও অনুষ্ঠানের অতিথি সারিতে ছিলেন। সনদ স্বাক্ষরের আনুষ্ঠানিকতার পর সাত মিনিটের একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়। পরে প্রধান উপদেষ্টা ও ঐকমত্য কমিশন সদস্যরা রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে ফটোসেশনে অংশ নেন।
সনদে সই করেছে যেসব দল: বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি, খেলাফত মজলিস, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, আমার বাংলাদেশ পাটি (এবি পার্টি), নাগরিক ঐক্য, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, গণসংহতি আন্দোলন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, গণঅধিকার পরিষদ (জিওপি), বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২ দলীয় জোট, জাকের পার্টি, জাতীয় গণফ্রন্ট, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, ভাসানী জনশক্তি পার্টি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, আমজনতার দল।
স্বাক্ষর অনুষ্ঠান শেষে বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, সমস্ত রাজনৈতিক দল, সংস্কার কমিশনে যারা কাজ করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং সংস্কার কমিশনে যারা দীর্ঘদিন ধরে দিনের পর দিন কাজ করে আজকে সবার সামনে রেখেছেন, সেজন্য আমি আমাদের দলের সালাহউদ্দিন আহমেদ এবং সমস্ত রাজনৈতিক দলকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সামনে আমাদের অনেক কাজ। কেবল যাত্রা শুরু। সবাই জুলাই সনদ স্বাক্ষর করেছে, যারা দু’-একজন স্বাক্ষর করেন নাই, আশা করি তারাও সামনে স্বাক্ষর করবেন।
জামায়াতের নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, আজকের স্বাক্ষরের মাধ্যমে আমরা সনদে একমত হয়েছি, তবে এর আইনি ভিত্তি এখনো বাকি রয়েছে। সরকারের উচিত তা দ্রুত নিশ্চিত করা। সনদে স্বাক্ষর করা হলেও আইনগত স্বীকৃতি না থাকায় এর কার্যকরী প্রয়োগ এখনো সম্পন্ন হয়নি।
উপস্থিত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা হলেন: বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ; বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের, সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার; গণঅধিকার পরিষদের (জিওপি) সভাপতি নুরুল হক নুর, সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খান; বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, রাজনৈতিক পরিষদ সদস্য বহ্নিশিখা জামালী; লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি’র মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. নেয়ামূল বশির; ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান; খেলাফত মজলিসের আমীর মাওলানা আব্দুল বাছিত আজাদ, মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের; রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম, মিডিয়া সমন্বয়ক সৈয়দ হাসিবউদ্দীন হোসেন; আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মজিবুর রহমান ভূঁইয়া মঞ্জু, সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ; নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার; জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ, মহাসচিব মোমিনুল আমিন; বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সিনিয়র নায়েবে আমীর মাওলানা ইউসুফ আশরাফ, মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ; গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল; জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি’র সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, সিনিয়র সহ-সভাপতি মিসেস তানিয়া রব; জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপি চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ; জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপা’র সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার লুৎফর রহমান; ১২ দলীয় জোটের প্রধান ও চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টি মোস্তফা জামাল হায়দার, মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপি’র চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম; গণফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা সুব্রত চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক ডা. মো. মিজানুর রহমান; জাকের পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান শহীদুল ইসলাম ভূঁইয়া, গাজীপুর জেলা ছাত্রফ্রন্টের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জহিরুল হাসান শেখ; জাতীয় গণফ্রন্টের কেন্দ্রীয় কমিটির সমন্বয়ক আমিনুল হক টিপু বিশ্বাস, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মঞ্জুরুল আরেফিন লিটু বিশ্বাস; বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির সিনিয়র নায়েবে আমীর মাওলানা আবদুল মাজেদ আতহারী, মহাসচিব মাওলানা মুসা বিন ইযহার; বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব খন্দকার মিরাজুল ইসলাম; ভাসানী জনশক্তি পার্টির চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ রফিকুল ইসলাম (বাবলু), মহাসচিব ড. মোহাম্মদ আবু ইউসুফ (সেলিম); জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ-এর সহ-সভাপতি মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী, মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী; ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আব্দুল কাদের, মহাসচিব মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজী; আমজনতার দলের সভাপতি কর্নেল (অব.) মিয়া মশিউজ্জামান, সাধারণ সম্পাদক মো. তারেক রহমান।
এছাড়াও শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধর বাবা মীর মোস্তাফিজুর রহমান এবং শহীদ তাহির জামান প্রিয়র মা শামসী আরা বেগম জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।
স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যায়নি এনসিপি ও চার বাম দল: জাতীয় জুলাই সনদে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যাননি জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও বাম ধারার চারটি রাজনৈতিক দলের নেতারা। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাসদ (মার্ক্সবাদী), বাংলাদেশ জাসদ ও এনসিপি সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অংশ নেয়নি।
এনসিপি’র মিডিয়া সেলের সম্পাদক মুশফিক উস সালেহীন জানান, এনসিপি’র কেউ জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যাননি। না যাওয়ার কারণ আগেই সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে বিজ্ঞপ্তিতে এনসিপি জানায়, আইনি ভিত্তির নিশ্চয়তা ছাড়া তারা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে না। জুলাই জাতীয় সনদের স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের আগে সংশোধিত খসড়া না পেলে সনদে স্বাক্ষর করবে না বলে আগেই জানিয়েছিল বাম ধারার চারটি দল।
সনদের অঙ্গীকারনামায় যা আছে: ‘গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জনগণের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়া’ এ ঘোষণার মধ্যদিয়ে অঙ্গীকারনামা শুরু হয়েছে।
প্রথম অঙ্গীকার হিসেবে বলা হয়েছে, জনগণের অধিকার ফিরে পাওয়া এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য যে দীর্ঘ সংগ্রাম চলেছে, ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান সেই লড়াইয়ের ঐতিহাসিক মোড়। হাজারো মানুষের জীবনদান ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত সুযোগে প্রণীত জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা হবে।
দ্বিতীয় দফায় বলা হয়েছে, জনগণ যেহেতু রাষ্ট্রের মালিক, তাদের অভিপ্রায়ই সর্বোচ্চ আইন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে এই সনদ গ্রহণ করছে। তাই সনদটি সংবিধানে তফসিল হিসেবে বা উপযুক্তভাবে সংযুক্ত করার ঘোষণা দেয়া হচ্ছে।
তৃতীয় দফায় বলা হয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদের বৈধতা বা প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা হবে না। বরং এর প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে।
চতুর্থ অঙ্গীকার হলো, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের জন্য জনগণের ১৬ বছরের সংগ্রাম এবং বিশেষত ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করা হবে।
অঙ্গীকারনামার পঞ্চম দফায় বলা হয়েছে, গণ-অভ্যুত্থানপূর্ব ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানকালে সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও শহীদ পরিবারগুলোকে যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করবো।
(স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের আগে জুলাই যোদ্ধাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এ দফা সংশোধন করা হয়। এতে নতুন করে লেখা হয়, ‘শহীদ পরিবারকে এবং জুলাই আহতদের রাষ্ট্রীয় বীর, আহত জুলাই বীর যোদ্ধাদের যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান যেমন মাসিক ভাতা, সুচিকিৎসা, পুনর্বাসন ব্যবস্থা এবং শহীদ পরিবার ও আহত বীরযোদ্ধাদের আইনগত দায়মুক্তি, মৌলিক অধিকার সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবো’)।
ষষ্ঠ দফায় সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ কাঠামো ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থার সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। এসব বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় আইন, বিধি ও প্রবিধি সংশোধন বা নতুনভাবে প্রণয়ন করার অঙ্গীকার করা হয়েছে।
শেষ দফায় উল্লেখ করা হয়, জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত যেসব সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেগুলো দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়ন করবে কোনো প্রকার বিলম্ব ছাড়াই।
জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর ভিত্তি হলো ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান, যা দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে বিবেচিত। ওই সময়ে হাজার হাজার নাগরিক স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দুঃশাসন, রাষ্ট্রীয় দমন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও সামাজিক অন্যায়-বঞ্চনার প্রতিবাদে সড়কে নেমেছিলেন। সেই আন্দোলনে সহস্রাধিক মানুষ নিহত হন এবং ২০ হাজারের অধিক মানুষ আহত ও পঙ্গুত্ববরণ করেন। একপর্যায়ে ২০২৪-এর ৫ই আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করে পালিয়ে যান এবং ভারতে আশ্রয় নেন।
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাদ যাচ্ছে না: বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিসহ (সিপিবি) চারটি বামপন্থি দলের আপত্তির পর জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫ এ পরিবর্তন আনা হয়েছে। এর ফলে সংবিধান থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাদ পড়ছে না।
প্রায় আট মাস ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে জুলাই সনদ চূড়ান্ত করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। গত মঙ্গলবার (১৪ই অক্টোবর) সনদের অনুলিপি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠিয়েছিল ঐকমত্য কমিশন। সেখানে বলা হয়েছিল, বিদ্যমান সংবিধানের ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলি-সংক্রান্ত ১৫০ (২) অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত হবে এবং এ সংশ্লিষ্ট পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম তফসিল সংবিধানে রাখা হবে না। এই সিদ্ধান্তে ৯টি দল একমত ছিল না।
এরপর গত বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে না আসার ঘোষণা দেন সিপিবি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদের নেতারা। সনদে কেন স্বাক্ষর করবেন না, তার যে কারণগুলো তারা বলেছিলেন, তার মধ্যে একটি ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা বাদ দেয়ার সুপারিশের বিষয়টি। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সংবিধানের ১৫০ (২) অনুচ্ছেদে ক্রান্তিকালীন বিধানে ৬ষ্ঠ তফসিলে থাকা স্বাধীনতার ঘোষণা ‘ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্স’ এবং ৭ম তফসিলে থাকা ‘প্রক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স’ বাদ দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে, যা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি, তা বাদ দিলে বাংলাদেশের অস্তিত্বই থাকে না।
এরপর জুলাই সনদের এই জায়গায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। চূড়ান্ত সনদে বলা হয়েছে, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫০(২) সংশোধন করা হবে এবং এ সংশ্লিষ্ট পঞ্চম ও ষষ্ঠ তফসিল সংবিধানে রাখা হবে না।
সংবিধানের পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম তফসিল যুক্ত করা হয়েছিল ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। পঞ্চম তফসিলে আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষণ। ষষ্ঠ তফসিলে আছে ১৯৭১ সালের ‘২৫শে মার্চ মধ্যরাত শেষে অর্থাৎ ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে’ বঙ্গবন্ধুর দেয়া স্বাধীনতার ঘোষণা। আর সপ্তম তফসিলে আছে ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের জারি করা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র।
অর্থাৎ জুলাই সনদ অনুসারে সংবিধানে সংস্কার হলে তাতে সংবিধানের তফসিলে ৭ই মার্চের ভাষণ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা থাকবে না। তবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সংবিধানের তফসিলে থাকবে।মানবজমিন