ডেস্ক রির্পোট:- পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন এমনিতেই নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ওপর একটি বড় ‘বোঝা’। সেই ‘বোঝার ওপর শাকের আঁটি’ বা বাড়তি চাপ হয়ে দেখা দিয়েছে বিশ্বের নানা প্রান্তে থাকা প্রবাসী এবং দেশের অভ্যন্তরে আইনি হেফাজতে থাকা কারাবন্দি ভোটাররা। এসব ভোটারের ভোটাধিকার নিশ্চিতে কাজ করছে কমিশন। দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে বিষয়টিকে তারা ‘মহাযজ্ঞ’ হিসেবে দেখছে। অন্যদিকে, বিষয়টিকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, প্রবাসী এবং কারাবন্দিদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত, আইনগত ও বাস্তবায়নগত দিক থেকে অনেক জটিলতা রয়েছে। ইসিকে এসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে।
ইসি সূত্র বলছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা অন্তত ৫০ লাখ প্রবাসীকে ভোটে আনতে চায় কমিশন। দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটদানের এ সুযোগ দিতে ইসি একাধিক পদ্ধতির সমন্বয়ে একটি ‘হাইব্রিড ব্যবস্থা’ নিয়ে কাজ করছে। এতে ভোটারপ্রতি ৭০০ টাকা ব্যয় ধরে ৪০০ কোটি খরচ করার কথা ভাবছে সংস্থাটি। তবে সম্ভাব্য ব্যয় নির্ধারণ করা হলেও তা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা ভবিষ্যতের ওপরই নির্ভর করবে বলে মনে করছেন ইসি কর্মকর্তারা। তারা আশা করছেন, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) আছে, এমন বিপুলসংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি এবার নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। এরই মধ্যে তাদের জন্য অনলাইনভিত্তিক নিবন্ধনের সুবিধা দিতে ইসি একটি ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন এবং অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ তৈরির কাজ শুরু করেছে। এনআইডিধারী প্রবাসীরা পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে নিবন্ধন করে ভোট দিতে পারবেন।
কোন দেশে কত ভোটার: প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, জনশক্তি ব্যুরো, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসহ (বায়রা) বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে ইসি। এতে দেখা গেছে, অন্তত ৪০টি দেশে বাংলাদেশি প্রবাসীদের আধিক্য রয়েছে। এসব দেশে ১ কোটি ৪০ লাখ ৪৬ হাজার ৫৩৪ জন প্রবাসী রয়েছেন। দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে—সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতার, বাহরাইন, লেবানন, জর্ডান, লিবিয়া, সুদান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাজ্য, ইতালি, হংকং, মিশর, ব্রুনাই, মরিশাস, ইরাক, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, গ্রিস, স্পেন, জার্মানি, দক্ষিণ আফ্রিকা, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, ব্রাজিল, চীন, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ, নিউজিল্যান্ড, রাশিয়া, তুরস্ক ও সাইপ্রাস। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪০ লাখ ৪৯ হাজার ৫৮৮ প্রবাসী রয়েছেন সৌদি আরবে। আর সবচেয়ে কম রয়েছেন নিউজিল্যান্ডে, ২ হাজার ৫০০ জন। এসব প্রবাসীর মধ্যে ৭০ শতাংশের মতো ভোটারের এনআইডি আছে বলে ধারণা করছে ইসি। যাদের মধ্যে নির্বাচনে ৫০ শতাংশ ভোটারের সাড়া পাবেন বলে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেছেন, বিভিন্ন দেশে ঠিক কত সংখ্যক প্রবাসী রয়েছে তার সঠিক হিসাব নেই। প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থাগুলোর সঙ্গে আমরা কথা বলে জেনেছি, সেই সংখ্যা ১ কোটি ৩০ লাখ বা এর কিছু বেশি হবে। এদের মধ্যে অন্তত ৭০ শতাংশ বাংলাদেশির এনআইডি আছে। সেই হিসাবে ৫০ লাখের মতো ভোটারকে পাব বলে আশা করছি। যদিও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নির্বাচনে প্রবাসী ভোটের হার ২০ থেকে ২২ শতাংশের মতো হয়।
কীভাবে, কখন ভোট দেবেন প্রবাসীরা: ইসি জানায়, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রাথমিকভাবে তথ্যপ্রযুক্তি-সহায়ক পোস্টাল ভোটিং এবং অনলাইন (ইন্টারনেট) ভোটিংয়ের প্রস্তাব করেছিল। ইসি এ দুটি পদ্ধতির পাশাপাশি ‘প্রক্সি ভোটিং’ পদ্ধতিও আলোচনায় এনেছে। তবে প্রবাসীদের বিস্তৃতি, সংশ্লিষ্ট দেশের বাস্তবতা এবং ডিজিটাল সাক্ষরতার বিষয়গুলো বিবেচনা করে শেষ পর্যন্ত আইটি-সহায়ক পোস্টাল ব্যালটে ভোটের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। অনলাইনে নিবন্ধনের মাধ্যমে প্রবাসীরা কীভাবে ভোট দেবেন, সে পদ্ধতি সম্পর্কে তুলে ধরে গত সোমবার দুটি নির্দেশিকা প্রকাশ করে ইসি।
নির্দেশিকা অনুযায়ী, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোটের দিন ধরে তার আগে নভেম্বরেই প্রবাসীদের ভোট দেওয়ার জন্য অনলাইন নিবন্ধনের অ্যাপটি তৈরি করে ফেলবে ইসি। এরপরই প্রবাসীদের নিবন্ধনের জন্য প্রচার চালানো হবে। এক্ষেত্রে তারা ওই অ্যাপের মাধ্যমে নিজের এনআইডি নম্বর, বর্তমান ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর দিয়ে নিবন্ধন সম্পন্ন করবেন। নিবন্ধনের জন্য প্রবাসীকে গুগল ‘প্লে স্টোর’ অথবা আইফোনের অ্যাপ স্টোর থেকে ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ অ্যাপটি ডাউনলোড করতে হবে। এরপর লগইন করে অ্যাকাউন্ট তৈরি করতে হবে। মোবাইল নম্বর প্রবেশ করালে ওটিপি (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) আসবে, তা দিয়ে মোবাইল নম্বর নিশ্চিত করবেন। এরপর এনআইডি হাতে নিয়ে সেলফি তুলতে হবে। পরবর্তী সময়ে দিতে হবে এনআইডির ছবিও। এরপর পাসপোর্ট থাকলে তার ছবি দিতে হবে। সর্বশেষে বিদেশে অবস্থানরত বর্তমান ঠিকানার তথ্য দিলেই কাজ শেষ। সিস্টেম থেকে সব তথ্য যাচাই করে সত্যতা মিললে ‘আপনি এখন নিবন্ধিত’ এমন লেখা প্রদর্শিত হবে অ্যাপে। এরপর অপেক্ষা কেবল ব্যালট পেপারের জন্য।
এভাবে যারা নিবন্ধন করবেন তাদের জন্য সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকায় প্রবাসীদের পৃথক ভোটার তালিকা করা হবে। তপশিল ঘোষণার পর সেই তালিকা অনুযায়ী পোস্টাল ব্যালট ছাপানো হবে। যে ব্যালটে শুধু দলগুলোর প্রতীক থাকবে। কোনো প্রার্থীর নাম থাকবে না। কারণ প্রার্থিতা চূড়ান্ত হওয়ার আগে কারও নাম ব্যালটে ছাপানো যায় না। আর প্রার্থিতা চূড়ান্ত হওয়ার পর ব্যালট পাঠানোর সময়ও থাকবে না। আবার আদালতের রায়ে কেউ প্রার্থিতা পেলে নতুন করে ব্যালট ছাপাতে হবে। তাই আগেই প্রার্থীর নাম ছাড়া ব্যালট ছাপানো হবে। সেই ব্যালট প্রবাসীর দেওয়া ঠিকানায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে ডাক বিভাগের মাধ্যমে।
এদিকে মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই শেষে প্রার্থিতা চূড়ান্ত হলে অনলাইনে নিবন্ধনকারীর মোবাইলে মেসেজ দিয়ে বলে দেওয়া হবে, ‘আপনি অনলাইনে গিয়ে আপনার এলাকার চূড়ান্ত প্রার্থীদের তালিকা দেখুন। পছন্দের প্রার্থীর প্রতীকে ভোট দিন।’ সেই মেসেজ পেয়ে প্রবাসী ভোটার তার ভোটটি দিয়ে ডাকযোগে পাঠাবেন। তবে নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে প্রবাসীদের ভোট দেওয়ার অ্যাপ (পোস্টাল ভোট বিডি) উদ্বোধন হলে এতে প্রবাসীরা নিবন্ধন করতে সময় পাবেন ১০ দিন।
ইসি সচিব আখতার আহমেদ বলেন, ডাক বিভাগ জানিয়েছে সবচেয়ে দূরের দেশে একটি চিঠি পাঠাতে এবং আনতে ২৮ দিন লাগে। তাই দেশের ভোটারদের আগেই প্রবাসী ভোটাররা ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন। এজন্য দেশে-বিদেশে বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচার চালানো হবে। আর যাদের এনআইডি আছে তারাই কেবল এ সুযোগ পাবেন। কারণ এনআইডি ছাড়া নিবন্ধন করার সুযোগ থাকবে না।
কয়েদি ও সরকারি চাকরিজীবীরাও পাবেন এই সুযোগ: প্রবাসীরা ছাড়াও ৭১টি জেলের কয়েদি ও সরকারি চাকরিজীবীরা (ভোটের দায়িত্বে থাকবেন যারা) ভোটদানের এ সুযোগ পাবেন। সেজন্য নির্বাচন কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং আইনি হেফাজতে বা কারাবন্দি ভোটারদের জন্য ‘ইন-কান্ট্রি পোস্টাল ব্যালট সিস্টেম’ চালু করা হবে।
প্রবাসীর ভোট কোথায় থাকবে, গণনা হবে কখন: দেশে ভোটের অন্তত ২০ দিন আগে একজন প্রবাসী ভোট দেবেন। এক্ষেত্রে ভোটার যে বর্তমান ঠিকানায় নিবন্ধন করেছেন, সে ঠিকানায় একটি খামে একটি ব্যালট পেপার এবং আরও দুটি খাম যাবে। আর ভেতরে থাকা একটি খামে আসন ও রিটার্নিং কর্মকর্তার ঠিকানা থাকবে। ভোটার কলম দিয়ে নির্ধারিত উপায়ে ব্যালট পেপারে তার ভোট দিয়ে, তা আবার রিটার্নিং কর্মকর্তার ঠিকানা লেখা খামে ভরে ডাকযোগে পাঠিয়ে দেবেন। সেই ভোট জেলা প্রশাসনের ট্রেজারিতে জমা থাকবে। ভোটের দিন সেগুলো সংশ্লিষ্ট আসনে দেশের ভোটের সঙ্গে গণনা করা হবে।
আখতার আহমেদ বলেন, প্রবাসীরা আগে ভোট দিলেও সেগুলো ট্রেজারিতে থাকবে। ভোটের দিন সংশ্লিষ্ট আসনের ভোট গ্রহণ শেষে গণনা করা হবে।
প্রবাসীরা আগে ভোট দিলেও তা কাউকে জানাতে পারবেন না: প্রবাসীরা আগে ভোট দিলেও তা কাউকে জানাতে পারবেন না—প্রবাসী ভোটের এমন শর্ত জুড়ে দিচ্ছে ইসি। ভোট কাকে দিলেন তা প্রকাশ করতে পারবেন না মর্মে অঙ্গীকার করতে হবে প্রবাসী ভোটারদের।
যেভাবে ভোটার হবেন প্রবাসীরা: ইসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রবাসী হিসেবে ভোট দেওয়ার প্রথম শর্তই হবে এনআইডি। সেজন্য বিদেশে বসে ভোটার হওয়ার জন্য অনলাইনে আবেদনপত্র পূরণ করতে হবে। মেয়াদ বা মেয়াদহীন বাংলাদেশি পাসপোর্ট বা এনআইডিধারী নাগরিকের প্রত্যয়ন, অনলাইন জন্ম নিবন্ধন ও পাসপোর্ট সাইজের রঙিন ছবি বাধ্যতামূলকভাবে সংশ্লিষ্ট নিবন্ধন কেন্দ্রে (দূতাবাসের সংশ্লিষ্ট ডেস্কে) জমা দিতে হয়।
বাধ্যতামূলক তথ্যগুলো নিবন্ধন কেন্দ্রে জমা দিতে না পারলে প্রবাসী নাগরিকরা দেশে বসবাসকারী তাদের আত্মীয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট উপজেলা কর্মকর্তার কাছে জমা দিতে পারবেন। এরপর কমিশন আবেদনকারীর ঠিকানায় সবকিছুর সত্যতা পেলে ভোটার করে নেবে।
সূত্রগুলো জানিয়েছে, এ পর্যন্ত ১০টি দেশ থেকে ভোটার হওয়ার আবেদন এসেছে ৫৫ হাজারের মতো। এদের মধ্যে ৩০ হাজারের বেশি প্রবাসী এরই মধ্যে দশ আঙুলের ছাপ দিয়ে নিবন্ধন সম্পন্ন করেছেন।
ইসির এনআইডি অনুবিভাগের মহাপরিচালক এ এস এম হুমায়ুন কবীর জানান, বর্তমানে ১০টি দেশের ১৭টি দূতাবাসে প্রবাসীদের ভোটার করে নেওয়ার কার্যক্রম চলছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও কয়েকটি দেশে এ কার্যক্রম শিগগির চালু হবে।
এ বিশাল কর্মযজ্ঞ সফলভাবে সম্পন্ন হলে দেশের নির্বাচনী ইতিহাসে এক নতুন মাইলফলক রচিত হবে মনে করছে ইসি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন আহমদ এরই মধ্যে বলেছেন, পরীক্ষামূলক বা সীমিত পরিসরে হলেও ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই তার কমিশন একটি দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে চায়। এজন্য প্রবাসীদের সংশ্লিষ্ট দেশে গিয়ে ভোটার করে নেওয়ার কার্যক্রমও ত্বরান্বিত করা হয়েছে।
প্রবাসী ভোটের চ্যালেঞ্জগুলো: যদিও ইসির এ উদ্যোগ অত্যন্ত প্রশংসনীয়, তবুও এটি বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, প্রবাসী ভোটারদের জন্য পদ্ধতিটি সহজবোধ্য, বিশ্বাসযোগ্য, সাশ্রয়ী এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পাদনযোগ্য হওয়া আবশ্যক। বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী প্রবাসীদের জন্য একক পদ্ধতি কার্যকর না-ও হতে পারে। এ ছাড়া, কারাবন্দি ভোটারদের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা বজায় রেখে ভোট গ্রহণের প্রক্রিয়াও জটিল। অর্থাৎ, এই মহাযজ্ঞ সফল করতে প্রযুক্তিগত, আইনগত ও বাস্তবায়নগত দিক থেকে অনেক জটিলতা রয়েছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী প্রবাসীদের জন্য ভোট দেওয়ার সুযোগ করে দিতে হলে সংশ্লিষ্ট দেশের নির্বাচনী আইন ও বিধিবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে হবে, যা অত্যন্ত জটিল ও সময়সাপেক্ষ। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস বা মিশনগুলোর সীমিত জনবল ও অবকাঠামো দিয়ে বিপুলসংখ্যক প্রবাসীর জন্য নিবন্ধন ও ভোটগ্রহণের মতো বড় কার্যক্রম পরিচালনা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অনেক প্রবাসী ভোটারের পর্যাপ্ত ডিজিটাল সাক্ষরতা নাও থাকতে পারে, যার ফলে অনলাইন নিবন্ধন বা প্রযুক্তিনির্ভর ভোটিং পদ্ধতি ব্যবহারে তাদের বেগ পেতে হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পুরোনো নিয়মে পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও তা সাধারণত অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে এবং এর মাধ্যমে খুব কমসংখ্যক ভোটই সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। সময়মতো ব্যালট পাঠানো ও ফেরত পাওয়ার প্রক্রিয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
প্রবাসী ভোটের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে জানতে চাইলে নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল আলীম বলেন, প্রবাসী ভোট নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। তবে এর অনেক চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এর মধ্যে মূল চ্যালেঞ্জ হবে ভোটের হার বাড়ানো। কারণ, সারা দুনিয়ায় দেখা গেছে প্রবাসী ভোটের ক্ষেত্রে উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং সাড়া একেবারেই কম। আর বাংলাদেশ যেহেতু প্রথমবার এ উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে এটা বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের বাংলাদেশিরা সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন। তাদের পুরো প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসাটা একটু কঠিন হবে। আর সময়মতো ব্যালট পৌঁছানো এবং সেগুলো সংগ্রহ করাটাও চ্যালেঞ্জের। এ ছাড়া আমাদের দেশের অনেক রাজনৈতিক দলেরই বিদেশে ঘোষিত-অঘোষিত শাখা বা নেতাকর্মী রয়েছেন। প্রবাসী ভোটকে কেন্দ্র করে তারা সেখানে নানা বিবাদে জড়িয়ে পড়তে পারেন। এরকম কিছু ঘটলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে।
কারাবন্দি ও নির্বাচন কাজে নিয়োজিতদের নিয়ে ইসির চ্যালেঞ্জ: বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কারাবন্দি ভোটারদের জন্য ‘ইন-কান্ট্রি পোস্টাল ব্যালট সিস্টেম’ বা বিশেষ অ্যাপের মাধ্যমে ভোট গ্রহণের সময় তাদের ভোটের গোপনীয়তা শতভাগ নিশ্চিত করা কঠিন চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া কারাগারে ভোট দিতে বাধ্য করার বা প্রভাব খাটানোর ঝুঁকি থাকে। দেশের বিভিন্ন কারাগারে বা আইনি হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের কাছে ব্যালট পেপার পৌঁছানো, তাদের ভোট গ্রহণ করা এবং তা আবার রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে নিরাপদে ও সময়মতো ফেরত আনা একটি বিশাল লজিস্টিক চ্যালেঞ্জ। নির্বাচনের স্বল্প সময়ের মধ্যে এত বড় সংখ্যক বিশেষ ভোটারের জন্য একটি নতুন পদ্ধতি সফলভাবে বাস্তবায়ন করা ইসির জন্য বড় একটি পরীক্ষা।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল আলীম এ বিষয়ে বলেন, মোট কথা হলো প্রবাসী এবং কারাবন্দি ভোটারদের অন্তর্ভুক্ত করার এ ‘মহাযজ্ঞ’ ইসির জন্য একটি অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী উদ্যোগ। তবে একে সফল করতে হলে প্রযুক্তি, আইন, লজিস্টিক এবং স্টেকহোল্ডারদের আস্থা অর্জন—সব ক্ষেত্রেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
কমিশনের বক্তব্য: কারাবন্দি ও সরকারি কর্মকর্তাদের ভোটে আনার কথা উল্লেখ করে সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন গতকাল এক অনুষ্ঠানে বলেন, এবারের নির্বাচন বিশেষ পরিস্থিতিতে হচ্ছে। তাই আমাদের বিশেষভাবে এটা মোকাবিলা করতে হবে। যারা বিদেশে আছেন তাদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করব। যারা জেলখানায় আছেন, যারা সরকারি কর্মকর্তা তাদের ভোটে আনার কথা ভাবছি। এই কাজগুলো নতুন। আমরা একসঙ্গে অনেক কাজ নিয়ে ফেললাম। আশা করি সবার সহযোগিতায় আমরা সফল হব।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, ‘পোস্টাল ব্যালটের ব্যাপারে অন্য চ্যালেঞ্জগুলো তো আছেই, আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে গোপনীয়তার চ্যালেঞ্জ। সবসময় জায়গা থেকে যাতে করে ইনডিভিজ্যুয়াল ভোটাররা যেন এ গোপনীয়তাটা রক্ষা করেন এবং সময়মতো ভোটটা দেন। কেউ যেন তার ভোটে তাকে ইনফ্লুয়েন্স করতে না পারে। তার ভোটটা তিনি কাকে দিয়েছেন, এটা যেন ডাইভার্স না হয় এবং এটা তার ডিক্লারেশনের মধ্যেও থাকবে। তিনিও একটা আন্ডারটেকিং দেবেন।
তিনি আরও বলেন, অ্যাপে বা অনলাইনে সেই তালিকা দেখার পর তিনি ভোট দেবেন এবং ভোট দেওয়ার পর তিনি খামটি আবার ফেরত পাঠাবেন। এবারের ভোটের জন্য আমরা প্রবাসীদের কোনো ধরনের চার্জ অ্যাপ্লাই করছি না। যদিও বা প্রতিটি ভোটের জন্য ৭০০ টাকার মতো ব্যয় হবে। আমরা মনে করি, এটি একটি যৌক্তিক ব্যয় প্রবাসীদের জন্য।কালবেলা