ডাকসু-জাকসুতে শিবিরের জয়: জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে?

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় শনিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
  • ২০১ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- সদ্য সমাপ্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ইসলামী ছাত্র শিবির সমর্থিত প্যানেলের জয়ে জামায়াতের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে বলে মনে করেন রাজনীতিবিদরা। তবে এতে জাতীয় নির্বাচনে খুব প্রভাব পড়বে না বলে তাদের ধারণা। কারণ জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থীর যোগ্যতা ও দলীয় অবস্থানই প্রাধান্য পায়।

নির্বাচনের এক সপ্তাহ পার হলেও এ নিয়ে এখনও চলছে নানা বিশ্লেষণ। একপক্ষ বলছেন, ছাত্র সংসদের নির্বাচন হচ্ছে শিক্ষার্থীদের অধিকারভিত্তিক। তাই অনেক সময় মতাদর্শের বাইরেও যোগ্য প্রার্থীদের বেছে নেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে সবাই নিজেদের দলকেই ভোট দেবে। অপরদিকে কেউ কেউ মনে করেন, এই নির্বাচনের বার্তা ইতোমধ্যে গ্রামে-গঞ্জে পৌঁছে গেছে। এতে আগামী জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতকে কিছুটা এগিয়ে রাখতে পারে। এ নিয়ে নিজস্ব মূল্যায়ন ব্যক্ত করেছেন রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা।

সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের সমর্থন বাড়াবে?
ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের অপ্রত্যাশিত জয়ে সারা দেশে জামায়াতের নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের উচ্ছ্বাস বিরাজ করছে। সভা সমাবেশসহ যেকোনও কর্মসূচিতেই এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের উদাহরণ টেনে আনেন নেতারা। তারা মনে করছেন, এটি আগামী নির্বাচনে তাদেরকে এগিয়ে দেবে।

অপরদিকে রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা মনে করেন, ছাত্র সংসদ ও জাতীয় নির্বাচনে বিস্তর ফারাক রয়েছে। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে একটি সীমিত পরিসর। সেখানে যাদের কাছ থেকে সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাদেরকেই বেছে নেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু সংসদ নির্বাচনে এলাকার উন্নয়ন, সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তির প্রভাব কাজ করে। সেসব দিক বিবেচনা করেই মানুষ ভোট দিয়ে থাকে।

এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘আমার জানামতে, শিবির নিজস্ব নামে প্যানেল দেয়নি। তারপরও বলতে হবে তারা জিতেছে। কিন্তু এই নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচনে জামায়াত বিশেষ সুবিধা পাবে কিনা, এ প্রশ্ন অবান্তর।’’ তিনি মনে করেন, জাতীয় নির্বাচন দলীয় অবস্থান ও প্রার্থীর যোগ্যতাকেই প্রাধান্য দেবে।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড. এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ‘‘আমরা মনে করি, ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের কাছে ইতিবাচক বার্তা পৌঁছে গেছে। এতে মানুষ জামায়াতসহ কল্যাণমুখী রাজনীতিকে বেছে নেবে। কারণ, ১৯৯০ সালের ডাকসু নির্বাচনের ফলাফলের প্রভাব ৯১-এর জাতীয় নির্বাচনে পরেছিল।’’

এ প্রসঙ্গ জানতে চাইলে বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘‘ডাকসু ও জাকসুতে শিবিরের বড় জয় রাজনৈতিক অঙ্গনে গুরুত্ব দিয়েই আলোচিত হচ্ছে। নিশ্চয়ই তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের মন জয় করতে পেরেছে। এর মাধ্যমে জামায়াতের আত্মাবিশ্বাস হয়তো কিছুটা বেড়েছে। তাই বলে জাতীয় নির্বাচনে তারা এগিয়ে থাকবে বলে মনে হয় না। কারণ, জাতীয় রাজনীতি আর ছাত্র রাজনীতি সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। জাতীয় নির্বাচনে কে কতটুকু প্রার্থী দিতে পারে, তার ওপরই ফলাফল নির্ভর করে।’’

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মাসুদ কামাল বলেন, ‘দুইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে শিবিরের জয়ে জামায়াত কিছুটা চাঙা হয়েছে। তাদের বডি লাঙ্গুয়েজ ও কথাবার্তায় এমনটি বুঝা যাচ্ছে। তবে জাতীয় নির্বাচনে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের কোনও প্রভাব পরবে বলে মনে করি না। কারণ, এলাকার মানুষ তাদের দলীয় আদর্শের বিপরীতে যেতে চায় না। তারা চিন্তা করে— কার মাধ্যমে উন্নয়ন হবে, বা কে পাস করবে। সেই নিরিখে জামায়াত তৃণমূলে নিজেদের অবস্থান কতটুকু শক্তিশালী করতে পেরেছে, সেটিই বিবেচ্য হবে।’’

আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘‘ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে শিবিরের সাফল্য অবশ্যই জামায়াতকে সুবিধা এনে দিতে পারে। কারণ, এর মাধ্যমে তাদের মনোবল বাড়বে। নিজেদের ইতিবাচক ভাবমূর্তি জনগণের কাছে তুলে ধরার সুযোগ পাবে।’’

ডাকসু ও জাকসুতে চমক
গত ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও একদিন পর ১১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (জাকসু) নির্বাচন। বিচ্ছিন্ন কিছু অভিযোগ থাকলেও দু’টি ছাত্র সংসদ নির্বাচনই মোটামুটি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ হয়েছে বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা। নির্বাচনি ফলাফলে ডাকসুতে ২৮টি পদের মধ্যে ভিপি, জিএস ও এজিএসসহ ২৩টিতে জয় পেয়েছে শিবিরে প্যানেল ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট।

অপরদিকে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদেও (জাকসু)- সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে শিবির। সেখানে তাদের প্যানেল সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট জিএস ও দুই এজিএস (নারী-পুরুষ)-সহ ২৫টি পদের মধ্যে ২০টিতে জয় পেয়েছে। আর ভিপি পদে ৩ হাজার ৩৩৪ ভোট পেয়ে জয় পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুর রশিদ জিতু। অবশ্য নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আরিফুল্লাহ পেয়েছেন ৩ হাজার ৩৯২ ভোট। ডাকসু ও জাকসুর হল সংসদেও শিবির সমর্থিতদের জয়জয়কার।

দুই বিশ্ববিদ্যালয়েই শিবির ছিল নিষিদ্ধ, উত্থান যেভাবে
মূলত ১৯৮৯ সালের ২৫ আগস্ট জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল-শিবিরের সংঘর্ষে নিহত হন ছাত্রদল নেতা হাবিবুর রহমান কবির। এ ঘটনার জন্য শিবিরকে দায়ী করা হয়। এ নিয়ে দেশব্যাপী শিবিরবিরোধী আন্দোলন হয়। সে সময় প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়।

এছাড়াও ৯০’র এর দশকে চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। এরই প্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ পরিষদেও শিবিরকে রাজনীতি করতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তবে এটি প্রশাসনিক কোনও সিদ্ধান্ত নয় বলে জানা গেছে। শুধু শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তে হয়েছে।

এরপর থেকেই এ দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা প্রকাশ্যে কার্যক্রম চালাতে পারেনি। বিশেষ করে শিবির প্রশ্নে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল ও বাম সংগঠনগুলো একাট্টা ছিল।

এর মধ্যে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা একাধিকবার প্রকাশ্যে কর্মসূচি চালাতে গিয়েও বাধার সম্মুখীন হয়। এতে আবারও তাদের রাজনীতি অপ্রকাশ্য হয়ে যায়। পরবর্তীকালে তারা বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রকাশ্যে আসা শুরু করেন সংগঠনটির নেতারা। আত্মপ্রকাশের পর শিবিরের সভাপতি সাদিক কায়েম ও সেক্রেটারি হিসেবে নাম আসে এস এম ফরহাদের। এতে দেখা যায়, তারা এতদিন কেউ ছাত্রলীগ, কেউবা বিতর্ক পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠনে কাজ করে আসছিলেন। তবে গত একবছর ধরে ছাত্রশিবির বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম চালিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করে।

আবাসিক হলগুলোতেও কৌশলে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। আর ডাকসুতেও প্যানেল দিয়েছে পরিচিত মুখদের। নিজেদের রক্ষণশীলতার বিপরীতে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও ভিন্ন মতের লোকজনকেও মনোনয়ন দিয়েছে সংগঠনটি। অপরদিকে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়েও তারা একই কৌশল অবলম্বন করেছে। রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা মনে করেন, এসব কারণে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে বড় জয় পেয়েছে শিবির।

সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল বলেন, ‘‘৯০-এর দশকের আগেই চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের বিরুদ্ধে ভিন্ন মতাবলম্বীদের নির্যাতন ও রগ কেটে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। তখন তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধের ব্যাপারে বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সোচ্চার আন্দোলন হয়। এরই প্রেক্ষিতে ৯০-এর দশকে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে শিবিরের কার্যক্রম করতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।’’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষিদ্ধের ব্যাপারেও একই কারণের পাশাপাশি ছাত্রদল কর্মী কবির হত্যার বিষয়টি কাজ করতে পারে বলেও তিনি জানান।

তিনি বলেন, ‘‘ডাকসু ও জাকসুতে শিক্ষার্থীদের কল্যাণে বিভিন্ন কাজ করেছে শিবির। ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে মিশে গেছেন শিবিরের নেতাকর্মীরা। কোনও না কোনোভাবে তারা হলে থাকতে পেরেছেন। যে কৌশল ছাত্রদল ও অন্য সংগঠনগুলো হয়তো প্রয়োগ করতে পারেনি। তাই ছাত্র সংসদ নির্বাচনে শিবির জিতেছে।’’বাংলা ট্রিবিউন

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions