ডেস্ক রির্পোট:- ২০০৬-০৭ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন রাশেদ ইকবাল খান। প্রথম বর্ষ থেকেই সক্রিয় ছিলেন ছাত্রদলের রাজনীতিতে। ভর্তির পর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতে পেরেছেন মাত্র তিন বছর। ২০০৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রাত থেকেই হলছাড়া হয়েছেন। ২০১০ সালের ১৮ জানুয়ারি ছাত্রদল সভাপতি সুলতান সালাহউদ্দিন টুকুর ওপর ছাত্রলীগের হামলার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত তিনি। এরপর একটি দিনও তার নিশ্চিন্তে যায়নি, কেটেছে মেসে, সাবলেটে গাদাগাদি-ঠাসাঠাসি করে থেকে। অংশ নিতে পারেননি, ক্লাস কিংবা অন্য কোনো একাডেমিক কার্যক্রমে। পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়েছে লুকিয়ে, ছাত্রলীগের চোখে পড়লে শিকার হতে হয়েছে হামলার। সীমাহীন কষ্ট, হামলা-মামলা, নির্যাতন-নিপীড়নের পরও ছাত্রদলের রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাননি একদিনের জন্যও, বিচ্যুত হননি জাতীয়তাবাদী আদর্শ থেকে কিংবা আশ্রয় নেননি কোনো গোপন-গুপ্ত রাজনীতির কৌশল; বরং মাথা উঁচু করেই পরিচয় দিয়েছেন ছাত্রদল হিসেবে। রাশেদ ইকবাল প্রথম কিছুদিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে থাকতে পারলেও পরবর্তীতে নাছিরউদ্দিন নাছির, আমানউল্লাহ আমান, হাসান আল আরিফ, মোস্তাফিজুর রহমান, শাফি ইসলাম, নাহিদুজ্জামান শিপন, রাজু আহমেদ, নাছির উদ্দিন শাওন, আবিদ আল ইসলাম, তানভীর বারী হামিম, তানভীর আল হাদী মায়েদ, শামীম শুভদের মতো হাজার হাজার শিক্ষার্থী যারা ছাত্রদলের রাজনীতি শুরু করেছেন তাদের সেই সুযোগও হয়নি। ছাত্রদল করার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ ক্যাম্পাস তাদের জন্য নিষিদ্ধ এলাকায় পরিণত হয়েছিল। ছাত্রত্ব শেষ করতে পারেননি এক দশকেও। পরিবারের কাছে অপমানিত হতে হয়েছে, দিন কেটেছে অর্থাভাবে, খেয়ে-না খেয়ে।
Advertisement
এই চিত্র শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েট, রুয়েট, চুয়েট, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জগন্নাথ, শাহজালাল, ময়নমসিংহ কৃষি, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে দেশের প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই রাশেদ, আমান, শাওন, রাজু, শুভদের মতো ছাত্রদল নেতাকর্মীরা যখন নির্যাতন-নিপীড়ন উপেক্ষা করে বুক ফুলিয়ে রাজপথে হাসিনাবিরোধী দুঃশাসনের প্রতিবাদ জানিয়েছেন, মিছিল-সভা-সমাবেশে অংশ নিয়েছেন, গ্রেফতার হয়ে কারাগারে গেছেন, মুক্ত হয়ে আবারো দাঁড়িয়েছেন রাজপথে, হামলার শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, সুস্থ হয়ে ফের অবস্থান নিয়েছেন রাজপথে।
ঠিক একই সময়ে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে ও হলে হলে নিজেদের পরিচয় গোপন করে ছাত্রলীগের রূপ ধারণ করে একদিকে যেমন ছাত্রদলসহ আওয়ামীবিরোধী ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী এবং সাধারণ ছাত্রদের ওপর হামলা-নির্যাতন চালিয়েছে, অন্যদিকে গুপ্ত পরিচয়ে ভেতরে ভেতরে সক্রিয় রাজনীতি চালিয়ে গেছে শিবির। স্লেøাগান দিয়েছেন ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’, প্রচারণা চালিয়েছেন নৌকার পক্ষে। ছাত্রদল যখন প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে হামলার শিকার, গ্রেফতার হয়েছেন তখন ছাত্রশিবির ছাত্রলীগের ভেতরে থেকে চালিয়ে গেছে সংগঠনটির কাজ, গঠিত হয়েছে নিয়মিত কমিটিও। আর আওয়ামী শাসনামল তো বটেই, ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়েও অনেক হলে ছাত্রদল তাদের পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার মতো লোকবল খুঁজে পায়নি।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগের শাসনামলে যখন ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে একক আধিপত্য বিস্তার করেছিল, তখন ছাত্রশিবির সরাসরি তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি, তবে ছাত্রশিবিরের কর্মীরা ছাত্রলীগের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় অনুপ্রবেশ করে, ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে নিজেদের কার্যক্রম চালিয়ে গেছে। তারা ছাত্রলীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছে এবং ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করেছে। এই কৌশল তাদের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য পূরণে সহায়ক হয়েছিল। ৫ আগস্টের পর এই ছদ্মবেশী কর্মীরা দ্রুত নিজেদের আসল পরিচয় নিয়ে আবির্ভূত হতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে, ছাত্রদল এই পুরো ১৬-১৭ বছরই নিজেদের কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি, এমন কী অনেকে সে সময় ক্যাম্পাসেই ঢুকতে পারেনি, যা ছাত্রশিবিরের প্রার্থীদের তুলনায় তাদেরকে পিছিয়ে রেখেছিল।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রফেসর ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, ছাত্রদলের পরাজয়ের মূল কারণ তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা। তারা বহু বছর ক্যাম্পাসে সক্রিয় ছিল না, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগও ছিল না; বরং তারা ভেবেছিল, ক্ষমতার পালাবদলের গতি তাদের স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিজয়ের দিকে নিয়ে যাবে। রাজনীতিতে এমন ভ্রান্ত ধারণা মারাত্মক। অন্যদিকে শিবির কৌশলী হয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় ব্যস্ত ছিল আওয়ামী শাসনামলেও। সেটার ফলই তারা পেয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দীর্ঘ দেড় দশক ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের থেকে দূরে থাকা, ছাত্রদলে শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ কমে যাওয়া, ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে ছাত্রদলের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ অপপ্রচার ছড়ানোর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলোতে। যেখানে ছাত্রশিবিরের কাছে লজ্জাজনকভাবে পরাজিত হতে হয়েছে ছাত্রদলকে। এই নির্বাচনগুলোতে (ডাকসু-জাকসু) কিছু অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রদলের দূরত্ব স্পষ্ট হয়েছে প্রকটভাবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিগত জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের চিন্তার জগতে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। তারা প্রথাগত রাজনীতিকে লালকার্ড দেখিয়ে দিয়েছেন। ফলে ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে বিএনপির বেশকিছু বিতর্কিত কর্মকা- ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সঙ্গে ছাত্রদলকে তুলনা করে অপপ্রচার চালানোতে প্রভাবিত ও বিশ্বাস করেছে শিক্ষার্থীরা। এর বিপরীতে বিএনপি কিংবা ছাত্রদল শিক্ষার্থীদের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি, তাদের বিরুদ্ধে চালানো অপপ্রচারের জবাবও দিতে পারেনি তারা। পারেনি শিবিরের মতো শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনানুযায়ী পাশে দাঁড়াতে, কাছে টানতে। আবার নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় শিবির যখন শিক্ষার্থীদের যাদের যা প্রয়োজন সেটি পূরণে ব্যস্ত তখন অর্থ সংকটে ভুগেছেন ছাত্রদল প্রার্থীরা।
একটি সূত্রে জানা যায়, জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে ছাত্রদল মনোনীত ভিপি প্রার্থীকে বিএনপির পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে দিনে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। অন্যদিকে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা তখন ছড়াচ্ছেন প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রার্থীরা প্রচার-প্রচারণা চালাতে আর্থিক সংকটের কথা বারবার বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতৃত্বকে জানিয়েছে কিন্তু কোনো কাজ হয়নি বলে অভিযোগ ছাত্রদল নেতাদের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও ফ্যাক্টচেকার কদরুদ্দীন শিশির বলেন, ছাত্র সংসদগুলোতে ছাত্রদলের না জেতার একটি দীর্ঘমেয়াদি পজিটিভ ইম্পেক্ট পড়ার সম্ভাবনা আছে বিএনপির রাজনীতিতে। ঢাকায় বা বড় শহরগুলোর ক্ষমতাসীন দলের নেতারা মূলত রাজনীতিতে তাদের মাসল শো করেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে, তাদের সম্মতিতে বা অসম্মতিতে। আর এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতারা মূল ক্রীড়নকের ভূমিকায় থাকেন।
তিনি বলেন, এবার ডাকসুতে (হল সংসদসহ) ছাত্রদলের বিরোধীরা একচেটিয়া জেতায় এবং অন্যান্য ছাত্র সংসদগুলোতে একই রকম অবস্থা হওয়ার শঙ্কা থাকায় আপাতত কিছু সমস্যা হবে বিএনপির জন্য। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটা দলটির জন্য ইতিবাচক হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ছাত্রদের কাছে টানতে হলে রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে বিএনপি নিজেদের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের দিকে যেতে বাধ্য হবে। আর বাংলাদেশর সারভাইবালের জন্যই বিএনপিসহ বাংলাদেশপন্থী অন্য দলগুলোর রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন খুবই জরুরি।
ছাত্রদলের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাশেদ ইকবাল খান ছাত্রদলের পরাজয়ের কারণ হিসেবে বলেন, দীর্ঘ সময় হল ও ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণে অনুপস্থিতি, অনভ্যস্ততা, জামায়াতের দলকানা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে চেক দিতে না পারা, অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে নিউট্রাল না করতে পারায় কিছুটা সাংগঠনিক স্থবিরতা ছিল। এছাড়া অনলাইনে সংগঠিত, পরিকল্পিত প্রচারণা করতে না পারা, প্রোপাগান্ডা একেবারেই না পারা এবং ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে হাইপ নিজেদের পক্ষে আনতে না পারা অন্যতম কারণ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর জোবাইদা নাসরীন মনে করেন, ছাত্রদলের হারের পেছনে কাজ করেছে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই চাঁদাবাজি, দুর্নীতি বা বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ ওঠেছে। তরুণ প্রজন্মের ভোটারদের বিবেচনায় এ বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে। ৫ আগস্টের পরবর্তী গত এক বছরে সরকারের ওপর কোন দলের নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাব বেশি, কে দেশ চালাচ্ছে এমন বিষয়ও ডাকসু ও হল সংসদের ভোটাররা মাথায় রেখেছেন বলে মনে করেন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক। কারা সরকারের ওপর অদৃশ্য প্রভাব রাখছে, সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করছে এসব বিষয় মাথায় রেখেছেন ভোটাররা। ইনকিলাব