প্রান্ত রনি:- রাঙ্গামাটির ‘রাঙ্গা পাহাড় আর হ্রদের যেমন সৌন্দর্য রয়েছে; তেমনি হ্রদ আর পাহাড়কে বুকে নিয়ে ‘বৃদ্ধ শহর’ রাঙ্গামাটির রয়েছে বুক ভরা কষ্ট আর অসীম দুঃখও। সৌন্দর্য আর দুঃখ যদি মাপা যেতো হয়তো হতো দুটোই সমানে-সমান; কিংবা দুঃখের পাল্লাই কিঞ্চিত ভারী।
ঠাণ্ডাছড়ির বুক ছিঁড়ে চলা মহাসড়ক হয়ে রাঙ্গামাটিতে আসা মানুষের হৃদয় আরও কোমল হয়ে উঠে ঘাগড়া-মানিকছড়ি পেরিয়ে শহরের উপকন্ঠ আরশিনগরের মুখেই। কিন্তু ভেদভেদীর অদূরের বেতারের ভবনের নিচের পাহাড়ে শহর রাঙ্গামাটির মানুষের ফেলা বর্জ্য থেকে উৎপন্ন উষ্ণ ঘ্রাণে যেন সৌন্দর্যের শহরেও বুক ফেটে বমি আসে। হয়তো কারও কারও আসেও বমি। আমাদের হয়তো অনিয়মিত যাতায়াতে শরীরে-অন্তরে এখন সয়ে গেছে। কিন্তু খানিক বেড়াতে আসা মানুষ যে শুরুতেই আক্রান্ত হচ্ছে। বেদনাহত হচ্ছেন। এটাই হলো রাঙ্গামাটির রাঙা মানুষদের বর্জ্য পৌরসভার ব্যবস্থাপনার গল্প।
দেশের কোনো কোনো শহরে এমনও ঘটনা আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে রাঙ্গামাটি শহরের এমন সব ঘটনা আছে, যা অনেকের শহরেরই নেই। এই শহরের রাস্তাঘাট কেবল কুকুর বিড়ালের অভয়াশ্রম নয়, এখানে চরে গরু-ছাগলও। শহরজুড়ে গরু-ছাগল তথা গবাদিপশুর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গোবর বা মলে প্রতিনিয়ত পবিত্র হচ্ছে শহর। সম্প্রতি তো নতুন আনন্দের খবর এল, এবার শহরে যোগ হয়েছে ঘোড়াও। যেখানে মানুষকে চিড়িয়াখানায় গিয়ে ঘোড়া দেখতে অর্থব্যয় করতে হয়, সেখানে এ শহরে রাস্তার চরে ঘোড়া।
আরও সুখবর হলো এই শহরে দুটি বাসস্ট্যান্ড আছে, একটা নতুন বাসস্ট্যান্ড, আরেকটা পুরাতন স্ট্যান্ড। কিন্তু বাসে চড়ার জন্য আপনাকে বাসস্ট্যান্ডে যেতে হবে না। খালী রাস্তার পাশে দাঁড়ালেই হবে। বাস আপনাকে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে তুলে নেবে। এটা এমন একটা শহর যেখানে বাস টার্মিনালে বাস, ট্রাক টার্নিনালে ট্রাক রাখতে হয় না। কারণ এখানে বাস-ট্রাক থাকে রাস্তার পাশেই।
রাঙ্গামাটি শহরের প্রধান তিনটি বাজার বনরূপা, রিজার্ভবাজার আর তবলছড়ি। তবলছড়ির মানুষের একটা অভিযোগ, রিজার্ভবাজারের মানুষ নাকি রাস্তার উপর দিয়ে হাঁটে, ওই এলাকায় চলাচলে বিপত্তি। বাস্তবতা হলো তবলছড়ির দশাও একই। সেখানেও মানুষ রাস্তার উপরে হাঁটে। কিন্তু আসলে রিজার্ভ বাজার, তবলছড়ির মানুষ রাস্তার উপর দিয়ে হাঁটার কারণ হলো কোনো এলাকাতেই নেই ফুটপাত।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাঙ্গামাটি শহরে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে অনিয়ন্ত্রিত সিএনজিচালিত অটোরিকশা। সরকারি সংশ্লিষ্ট দফতর বিআরটিএ’র তথ্য অনুযায়ী, পুরো জেলায় ১৪শ এর কিছু সংখ্যক বেশি নিবন্ধিত সিএনজিঅটোরিকশা থাকলে বাস্তবতা হলো শহরজুড়ে কয়েক হাজার সিএনজি অটোরিকশার ব্যাপক ছড়াছড়ি। প্রকৃত হালনাগাদ তথ্য না থাকলেও এই শহরের রাস্তার দুই হাজারের অধিক সিএনজিঅটোরিকশা চলাচল করে বলে জনমত রয়েছে। ৫ বছর আগে ভিন্ন চিত্র থাকলেও এখনকার চিত্রগুলো শহরের সবচেয়ে বড় বাজার বা শহরের প্রাণকেন্দ্র বনরূপা এখন বিশাল সিএনজিঅটোরিকশার স্ট্যান্ডে পরিণত হয়েছে। আগে বনরূপার মুখে কিছু সিএনজি অটোরিকশা স্ট্যান্ডে থামলেও এখন একেবারে কাটাপাহাড় গলির মুখ থেকে হ্যাপির মোড়ের কাছাকাছি পর্যন্ত টানা সিএনজিঅটোরিকশার দীর্ঘ সারি।
বিগত দিনে কুতুকছড়ি-ঘিলাছড়িগামী কিছু সংখ্যক সিএনজি বনরূপা পেট্রোল পাম্পে থাকলেও এখন বনরূপা পুলিশ বক্স থেকে হ্যাপির মোড়ের আগ পর্যন্ত সিএনজিঅটোরিকশার বিরতিকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এতে সড়কের একটা অংশ যানবাহনের দখলে থাকার কারণ ব্যস্ততম বনরূপায় ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এছাড়া হ্যাপির মোড়ের গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে কুরিয়ার সার্ভিস কার্যালয়ের বিশাল ফিটনেসের কাভার্ডভ্যান প্রতিনিয়ত পার্কিংয়ে থাকায় ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। কাঁঠালতলীতেও কুরিয়ার সার্ভিসের গাড়ি পার্কিংয়ে একই জটিলতা।
গতকাল রোববার (২৪ আগস্ট) সকালের চিরচেনা ট্রাক টার্নিনালের পাশের ব্যস্ততম সড়কের দুই পাশের চিত্র দুপুর গড়িয়ে বিকেলে পাল্টে গেছে। প্রতিদিনের মতো সকালেও রাস্তার দুইপাশে ছোট বড় ট্রাক রাখা হলেও বিকালে সেগুলো উধাও। এর কারণ হলো দুপুরে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় রাঙ্গামাটি জেলা বিএনপির নেতা তবলছড়ির বাসিন্দা জহির আহমেদের একমাত্র পুত্র সন্তান খোরশেদুল আলম জনির মৃত্যু হয়েছে। এরপরই সরে গেল সব ট্রাক, অথচ এতদিনে সরেনি। তবে কি শহরের বনরূপায় অপ্রত্যাশিত কিছুর ‘প্রত্যাশায়’ অবৈধ ফুটপাত দখলমুক্ত হচ্ছে না। সিএনজিঅটোরিকশার অবৈধ স্ট্যান্ড সরছে না। শহরের হর্তাকর্তা-বিধাতারাও কি চুপসে আছেন তেমন কিছুর প্রত্যাশায়। নাকি এর আগে করণীয় নির্ধারণের সুযোগ নেই?
রাঙ্গামাটি শহরে এই সময়ের সবচেয়ে বিশৃঙ্খলা হলো শহরের অভ্যন্তরীণ যানবাহন সিএনজিঅটোরিকশা। একদিকে একমাত্র বাহন হিসেবে যেমন রয়েছে প্রয়োজনীয়তা, তেমননি মাত্রাতিরিক্ত গাড়ির চাপে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা। শহরের রিজার্ভবাজার থেকে তবলছড়ি-ভেদভেদী পর্যন্ত; আবার ভেদাভেদী থেকে রিজার্ভবাজার-তবলছড়ি পর্যন্ত, অনুরূপ তবলছড়ি থেকে রিজার্ভ বাজার-ভেদভেদী লাইনভিত্তিক লোকাল গণপরিবহন হিসেবে সিএনজিঅটোরিকশা চলাচল করে। আবার তবলছড়ি বাজার থেকে আসামবস্তি বাজার পর্যন্ত লাইনভিত্তিক সিএনজি চলাচল করে। কিন্তু আসামবস্তি থেকে ভেদভেদী পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সড়কে লাইনভিত্তিক গাড়ি চলাচল করে না। তবলছড়ি থেকে যদি ভেদভেদী পর্যন্ত সরাসরি লাইনভিত্তিক সিএনজি অটোরিকশা চলাচল করতো সেক্ষেত্রে কিছুটা হলেও শহরের প্রাণকেন্দ্রে মানুষের চাপ কমতো। ভোগান্তিও কমে আসতো। এখন তবলছড়ির মানুষ ভেদভেদি আসেন বনরূপা পাড়ি দিয়েই। তখন হয়তো সেই চাপ কমে আসবে।
আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো- যত্রতত্র সিএনজিঅটোরিকশা পার্কিং ও যাত্রী উঠানামা করানো। দুই লেনের সরু সড়ক হওয়ায় রাস্তার মধ্যেই গাড়ি থামিয়ে যাত্রী উঠানামা করানোর ফলে প্রায়শই ঘটছে বিপত্তি। এরমধ্যে সিগন্যাল ব্যতিত হঠাৎ ব্রেক, ইউটার্ণের মতো ঘটনা বড় ঝুঁকির কারণ। বনরূপায় সড়ক বিভাগের পক্ষ থেকে ‘এখানে পার্কিং নিষেধ’ রোডসাইন দেয়া থাকলেও সেখানে রাখা হয় সিএনজিঅটোরিকশা, মোটরসাইকেল। অথচ এর পাশেই আবার দায়িত্ব পালন করেন ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা।
আশান্বিত খবর হলো রাঙ্গামাটি পৌরসভার মাঠ গাছে ফুলে ভরে উঠেছে। প্রথম শ্রেণীর পৌরসভা বলে কথা। কিন্তু আক্ষেপের আলাপ হলো রাঙ্গামাটির অধিকাংশ সড়কের বেশিরভাগই সড়ক বাতি চলে না। গুরুত্বপূর্ণ ফিসারিবাধে নেই আলো। রাঙ্গামাটি শহরের অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোর বেহাল দশা। এর মধ্যে নতুন যোগ হয়েছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সড়ক খোড়াখুড়ি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, দেশের সামগ্রিক শহরাঞ্চলের তুলনায় রাঙ্গামাটি শহরে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেড়েই চলছে। ২০১১ সালে যে শহরে জনসংখ্যার ঘনত্ব ছিল প্রায় ৩৭ শতাংশ; সেখানে ২০২২ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৪৭ শতাংশে। যেখানে দেশের সার্বিক শহরাঞ্চলে এ হার ৩১ শতাংশ ছিল। বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে জনসংখ্যার ঘনত্ব অলিগলি তস্য গলির শহরের মতো ক্রমাগত বাড়লেও নাগরিক সুবিধা আশাজনকভাবে বাড়েনি। উল্টো সংকুচিত হয়েছে চলাচল ও বিনোদনের স্থান। শহরের একমাত্র উন্মুক্ত ডিসি বাংলো পার্কটিও এখন বাণিজ্যিকীকরণ হলো। শহর রাঙামাটির কি কোনো বাবা-মা নেই, সত্যিই কি এতিম? লেখক: প্রান্ত রনি, সাংবাদিক ও প্রকৃতিবিষয়ক গবেষক।