রাঙ্গামাটি:- পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃতি, রূপ, বৈচিত্র্যে যত সুন্দর হউক না কেন; পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে এখানে গভীর যড়যন্ত্র লেগেই থাকে। থাকে সংঘাত, সংঘর্ষ, আগুনের লেলিহান শিখা। খুন, গুম, অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি নিত্যদিনের সঙ্গী। তেমনি এক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এখানকার ভূমি ব্যবস্থাপনা জটিল আকার করানোর গভীর ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।
হঠাৎ করে রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কৃষিবিদ কাজল তালুকদার আদালতের রায় অগ্রাহ্য করে চলতি বছরের ২৯ জুলাই একটি চিঠিতে হেডম্যান প্রতিবেদনকে বাধ্যতামূলক করার পক্ষে মত দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একটি পত্র প্রেরণ করেন।
পত্রে উল্লেখ করা হয়- ‘‘উপর্যুক্ত বিষয়ে সদয় দৃষ্টি আকর্ষণপূর্বক জানানো যাচ্ছে যে, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, রাঙ্গামাটি হতে বিবিধ মামলা (আদালত) রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের পূর্বানুমোদনের জন্য বিভিন্ন স্মারকে প্রস্তাব পাওয়া যায়। জমিগুলো পূর্বানুমোদন প্রদানের ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা উদ্ভত হওয়ায় আপনার সদয় অবগতির জন্য বর্ণিত বিবিধ মামলার বিষয়ে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের নিম্নরূপ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হলোঃ
১। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ২২/১০/২০০৬ খ্রি. তারিখের পাচবিম (প-১)-বা-বান/বিবিধ/১২/৯৯/০৩ মূলে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদকে (ক) জমি বিক্রেতার আবেদন, (খ) হেডম্যানের প্রতিবেদন, (গ) কানুনগো/সার্ভেয়ারের প্রতিবেদন, (ঘ) জমাবন্দি (খতিয়ান) এবং (৪) জমির সংক্রান্ত ক্যাচম্যাপ রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার জেলা প্রশাসকের কার্যালয় হতে সুপারিশসহ কাগজপত্রাদির অনুলিপি পাওয়ার প্রাপ্তির পর মিউটেশন কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারেন বলে মর্মে মন্ত্রণালয় পত্র প্রদান করেন।
২। বর্তমানে সিভিল স্যুট মামলা করে হেডম্যানের নিকট হতে কোন প্রত্যায়ন বা প্রতিবেদন গ্রহণ না করেই বিজ্ঞ আদালত কর্তৃক প্রদত্ত রায়মূলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় হতে বিবিধ (আদালত) মামলা সৃজন পূর্বক রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের পূর্বানুমোদন প্রদানের নিমিত্ত প্রচুর বিবিধ মামলা আসছে, হেডম্যানের প্রতিবেদন ব্যতীত উক্ত বিবিধ মামলাগুলো পূর্বানুমোদন প্রদান করা হলে ভূমি সংক্রান্ত জটিলতা তৈরি হতে পারে বিধায়, এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের মতামত/নির্দেশনা প্রয়োজন।
উপযুক্ত অবস্থার প্রেক্ষিতে বর্ণিত বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মতামত/নির্দেশনার জন্য ০৩ (তিন) টি বিবিধ মামলার কাগজপত্রাদিসহ এতৎসঙ্গে প্রেরণ করা হলো।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অংশ, যেখানে রাষ্ট্রের সংবিধান ও প্রচলিত ভূমি আইন সমানভাবে প্রযোজ্য হওয়ার কথা। কিন্তু এখানে দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রথাগত ও ঔপনিবেশিক যুগের হেডম্যান প্রথা ভূমি ব্যবস্থাপনায় বৈষম্যমূলক ভূমিকা রেখে চলেছে। বাঙালির মালিকানাধীন ভূমি ক্রেতা-বিক্রেতাদের জন্য এই প্রথা একটি প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসনবিধি অনুযায়ী হেডম্যান নিয়োগ করেন জেলা প্রশাসক। বেশির ভাগ হ্যাডম্যান পাহাড়ি জনগোষ্ঠী থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেখানে বাঙালী নামে মাত্র এক-দু’জন থাকে। এই হেডম্যানরা সমতলের তহশিলদারের মতো ভূমি ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। —খাজনা উত্তোলন, জমি ক্রয়-বিক্রয়ের সুপারিশ, প্রত্যয়ন, বাসিন্দার স্থানীয়তা যাচাই ইত্যাদি।
কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, অনেক পাহাড়ি হেডম্যান বাঙালি আবেদনকারীর ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃতভাবে প্রতিবেদন দিতে গড়িমসি করেন বা অযৌক্তিকভাবে নেতিবাচক প্রতিবেদন দেন, যেখানে পাহাড়িদের জন্য একই প্রক্রিয়া অনেক দ্রতি করা হয়।
এসব হেডম্যানদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তারা স্থানীয় জায়গার মালিক বাঙালী গোষ্ঠী থেকে খাজনা গ্রহণ করে না। যে কারণে অনেক বাঙালি জমি-বেচাকেনা করতে পারছেন না। সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিক সমান অধিকার ভোগ করবে।
ভূমি মালিকানা ও ক্রয়-বিক্রয় আদালতের স্বীকৃত রায় যথেষ্ট। সেখানে দেশের আইনের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হেডম্যান প্রতিবেদনের মতো প্রথাগত বৈষম্যমূলক শর্ত সংযোজন করা আদালতের রায়কে অবমাননা করার শামিল। ইতিমধ্যেই উচ্চ আদালত বিভিন্ন সময়ে ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির কিছু ধারা ‘মৃত আইন’ বলে মন্তব্য করেছে, যা বর্তমান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
বাঙালি আইনজীবী ও বাসিন্দারা বলছেন, জেলা প্রশাসক আদালতের রায় বাস্তবায়নে বরাবরই অনিহা দেখাচ্ছেন সাংবিধানিক চেয়ারে বসে অসাংবিধানিক পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির অজুহাত দেখিয়ে আদালতের রায় বাস্তবায়ন করছেন না।
এছাড়াও জেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে রয়েছে অনেক অভিযোগ, একই জায়গা একাধিকবার বেচা-কেনা এবং অফিস থেকে বাঙালিদের জায়গার নথিপত্র গায়েব, ডিসির বাসিন্দা সনদ নিয়ে হয়রানিসহ এসব বিষয়ে বাঙালিদের মধ্যে দিনদিন ক্ষোভ বাড়ছে বলে জানা গেছে।
বলে রাখা ভাল; দেশের প্রচলিত আইন অমান্য করে এমন ঔপনেবেশিক যুগের হেডম্যান প্রথা চালু করলে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি ব্যবস্থাপনায় জটিলতা সৃষ্টি হবে এবং বাঙালীরা ভূমির অধিকার হারাবেন।
দেশের প্রচলিত আইনে ভূমি বেচাকেনায় সাধারণত বাদী-বিবাদীর মধ্যে চুক্তি সম্পাদিত হয়। অনেক সময় এই চুক্তি কোর্ট এফিডেভিট বা হলফনামার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। যদি কোনো পক্ষ চুক্তি অমান্য করে, তবে বাদী-বিবাদী সিভিল স্যুট দায়ের করতে পারেন। আদালত এসব মামলায় ক্রেতা-বিক্রেতার চুক্তি বাস্তবায়ন এবং মালিকানা প্রদান সংক্রান্ত রায় দিয়ে থাকেন।
ভূমি ব্যবস্থাপনায় দেশের প্রচলিত আইন অমান্য করে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান উদ্দেশ্যে প্রণোদিত হয়ে এহেন কর্মকান্ড গভীর যন্ত্রযন্ত্র বলে মনে করছে পাহাড়ের সচেতন বাসিন্দারা।
রাঙ্গামাটি জেলা জজ আদালতের সিনিয়র আইনজীবী কামাল হোসেন সুজন বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে যে সকল সমস্যা বিদ্যমান তার মধ্য অন্যতম হচ্ছে ভূমির মালিকানা বিষয়। ভূমির বিরোধ, ভূমি বন্দোবস্তী এবং এতদঞ্চলে বসবাসরত সকল নাগরিকের ভূমির অধিকার নিশ্চিত করা। পার্বত্য চট্টগ্রামে যে সকল জনগোষ্ঠী বৈধভাবে ভূমির মালিকানা লাভ করেছেন ভূমি হস্তান্তর এর বিষয়টাও তাদের জন্য একটা মৌলিক বিষয়।
এই ভূমি হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীর অন্যতম গলার কাঁটা হেডম্যান প্রতিবেদন। হেডম্যান প্রথা কোন আইনগত বিষয় নয়, তারপরেও এখানকার স্থানীয় প্রশাসন ভূমি ব্যবস্থাপনায় হেডম্যান প্রথাকে বেআইনিভাবে সাংবিধানিক আইনের উপর গুরুত্ব আরোপ করে। এই অসাংবিধানিক কার্যকলাপের ফলে এখানে নাগরিক অধিকার এবং মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে।
যেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রামে আইনত রেজিস্ট্রি কার্যক্রমে সাব রেজিস্ট্রি অফিসের হাতে নেই সেহেতু সরকারের বিশেষ নির্দেশনায় ভূমি রেজিস্ট্রেশন এর কাজ করে থাকেন স্থানীয় জেলা প্রশাসন। ক্রেতা বিক্রেতার চুক্তির ফলে বা কোন ব্যক্তির বৈধ দখল স্বত্বের ফলে যদি বিজ্ঞ আদালতের দ্বারস্থ হতে হয় তখন বিজ্ঞ আদালতে দেওয়ানী কার্যবিধি ১৯০৮ এ আদালত যোগে রেজিস্ট্রি মামলা বা বৈরী দখল স্বত্বের মামলা করা হয়।
বিজ্ঞ আদালত বিচারিক কার্যক্রম শেষে যে রায় ও ডিক্রি প্রদান করেন তার প্রেক্ষিতে বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশে জেলা প্রশাককের কার্যালয় রেজিস্ট্রি এবং নামজারীর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। এক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় হতে রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত ফাইলগুলো জেলা পরিষদ আইনের ৬৪ ধারায় জেলা পরিষদের পূর্ব অনুমোদনের জন্য জেলা পরিষদে প্রেরণ করা হয়। পার্বত্য জেলা পরিষদ জেলা প্রশাসকের প্রেরিত ফাইলে কোনরূপ শর্ত ছাড়াই বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশিত হয়ে পূর্ব অনুমোদন প্রদান করেন।
বৈরী দখল স্বত্বের যে সকল মামলা ১৯০৮ সালের তামাদি আইনের ২৬ ধারায় ১৪২ অনুচ্ছেদে বিজ্ঞ আদালত যে রায় প্রদান করেন সে সকল রায় কোন ধরনের প্রশ্ন ব্যতীত জেলা প্রশাসককে প্রতিপালন করতে হয় এবং এই প্রক্রিয়া যথারীতি চলছিল। বর্তমান রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়াররম্যান কৃষিবিদ কাজল তালুকদার বিজ্ঞ দেওয়ানী আদালতের রায় এবং
ডিগ্রীকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে স্থানীয় অবৈধ বেআইনি হেডম্যানের সুপারিশের কথা বলে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় মতামত চেয়ে গত ২৯ জুলাই ২০২৫ ইং তারিখের চিঠি লিখেন। উক্ত চিঠি জনসম্মুক্ষে প্রকাশ হওয়ার পর থেকে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার সাধারণ জনগোষ্ঠী চরম ভাবে ক্ষােভে ফেটে পড়ে এবং এই অনির্বাচিত পরিষদ এবং অযোগ্য চেয়ারম্যানের প্রতি সম্পূর্ণ আস্তাহীন হয়ে পড়ে।
জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের এরূপ চিঠি বহাল থাকলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি ব্যবস্থাপনার স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হবে এবং চরম জনরোষ তৈরি হবে। অচিরেই রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কাজল তালুকদারকে এরূপ বেআইনি চিঠি প্রত্যাহার করে ভূমি ব্যবস্থাপনার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার অনুরোধ করছি। নতুবা ভূমি হস্তান্তরের সুবিধা অসুবিধাভোগী সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে আসবে,
তার সাথে সাথে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় দেওয়ানী আদালতের রায় ডিক্রি বাস্তবায়নে যে সকল ঘরিমসি করছে এসব বেআইনি কার্যকলাপ থেকে সরে এসে আদালতের নির্দেশ মোতাবেক ভূমি ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়া স্বাভাবিক রাখার জন্য রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক মহোদয়কে অনুরোধ করছি নতুবা জেলা প্রশাসন ও রাঙ্গামাটি জেলার সাধারণ মানুষের ক্ষোভের কারণে পরিণত হবে।
স্থানীয় বাঙালিরা দাবি করেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি-সংক্রান্ত সমতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে প্রথাগত হেডম্যান প্রতিবেদনের বাধ্যবাধকতা তুলে দিয়ে আদালতের রায় ও প্রচলিত ভূমি আইনকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিতে হবে। রাঙামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের ২৯ জুলাইয়ের চিঠি সংবিধান ও বিচার বিভাগের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে এক প্রকার প্রশাসনিক বিদ্রোহের সমান, যা তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাহার করা প্রয়োজন।
রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কৃষিবিদ কাজল তালুকদার বলেন, এখানে আদালতের বিষয় নয়; পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মেনে আমিও জানতে চেয়েছি জায়গা ক্রয়-বিক্রয়ে হেডম্যানের প্রতিবেদন লাগবে কি না। আমি মনে করি হেডম্যানের তদন্ত প্রতিবেদন জরুরী।