রাঙ্গামাটি :- রাঙ্গামাটি জেলার বরকল উপজেলায় এখনো আঞ্চলিক চাঁদাবাজ দল ইউপিডিএফ মোবাইল নেটওয়ার্ক কেটে দিয়ে যোগাযোগের বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। স্থানীয়রা বলছেন, ইউপিডিএফ (প্রসীত গ্রুপ) নামক আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর চাঁদাবাজির কারণে ১৫ জুলাই ২০২৫ খ্রি. থেকে বরকলের ৫টি ইউনিয়নে রবি ও এয়ারটেল কোম্পানির নেটওয়ার্ক টাওয়ার বন্ধ রয়েছে। এর ফলে প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে শুরু করে ছাত্রছাত্রীদের অনলাইন পড়াশোনা, চাকরিজীবীদের পেশাগত যোগাযোগ এবং সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, বরকল উপজেলার অন্তত ৮টি মোবাইল টাওয়ার পরিচালনার জন্য ইউপিডিএফ রবি কোম্পানির কাছে ৬ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেছে। পূর্বে এই গোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রতি বছর প্রায় ৭০ লক্ষ টাকা আদায় করলেও এখন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তনে এই অঙ্ক বেড়ে দাঁড়িয়েছে কয়েক গুণে, যা এখন ৫ কোটি টাকা। কোম্পানি সূত্র বলছে, নিরাপত্তাহীনতার কারণে তারা টাওয়ার সচল রাখতে পারছে না। বরং কোম্পানির নীতিগত সিদ্ধান্তে তারা বরকল এলাকা থেকে পুরোপুরি সেবা প্রত্যাহারের চিন্তা করছে।
১৫ জুলাই ২০২৫ থেকে পুরো বরকল উপজেলা কার্যত নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে। স্থানীয় অধিবাসী, রবিউল ইসলাম, শাকিল মন্ডল, বাবুল কর্মকার ও মোঃ রাজু হাসান জানায়, মোবাইল ফোনে কথা বলা তো দূরের কথা, ইন্টারনেট ব্যবহার করা, জরুরী সেবা নেওয়াও অসম্ভব হয়ে পড়েছে। জরুরি সময়ে হাসপাতালে বা থানায় যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না। ছাত্রছাত্রীরা অনলাইন ক্লাস, পরীক্ষার আবেদন কিংবা ফলাফল দেখতে পারছে না। সরকারি দপ্তরগুলোতেও ব্যাঘাত ঘটছে। এছাড়াও টানা ভারী বর্ষণে পাহাড়ি ঢল ও ভারতীয় পানি বরকল নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। যার কারণে অনেক এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। সব মিলিয়ে মানবিক বিপর্যয় চলছে বরকলে।
রাঙ্গামাটির অন্যান্য উপজেলার চিত্রও ভিন্ন নয়। বাঘাইছড়ি উপজেলার মারিশ্যা, করেঙাতলী ও জুরাছড়ি উপজেলাতেও মোবাইল নেটওয়ার্কের গতি অত্যন্ত ধীর।
খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি, গুইমারা ও লক্ষ্মীছড়িসহ ৯টি উপজেলায় প্রায় দেড়শত মোবাইল টাওয়ার রয়েছে। সেখানে কোম্পানির কর্মীরা নির্ভয়ে প্রবেশ করতে না পারায় গত ১৫-২০ দিন ধরে সেসব টাওয়ার থেকেও নেটওয়ার্ক কার্যত বন্ধ হয়ে আছে।
দিঘীনালা উপজেলার বড়াদম হতে নোয়াপাড়া পর্যন্ত ৫ থেকে ৬ মাস ধরে নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন বলে অভিযোগ করেছে স্থানীয় পাহাড়ি জনগণ। একই পরিস্থিতি দেখা গেছে পানছড়ি উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতেও। সার্বিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েক লাখ মোবাইল ব্যবহারকারী বর্তমানে প্রযুক্তি যুগে থেকেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে।
এই নেটওয়ার্ক সংকটের পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ হলো ইউপিডিএফ গোষ্ঠীর দ্বারা সৃষ্ট নিরাপত্তাহীনতা। গত ১৯ এপ্রিল ২০২৫, খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলার ময়ূরখীল এলাকায় মোবাইল টাওয়ার মেরামতের সময় রবি কোম্পানির দুই টেকনিশিয়ান, মো. ইসমাইল হোসেন (৩৫) ও আব্রে মারমা (২৫) কে অপহরণ করে ইউপিডিএফ (প্রসীত) সন্ত্রাসীরা।
এরপর ৫ জুন ফটিকছড়ির লেলাং ইউনিয়নের কর্ণফুলী বাজার এলাকায় টাওয়ারে কাজ করতে গিয়ে অপহরণ হন আরো দুই টেকনিশিয়ান—মো. সুমন ইসলাম ও আব্দুর রহিম। ফলে এখন পর্যন্ত অপহৃত মোট টেলিকম কর্মীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ জন। তাদের উদ্ধারের দাবিতে বাংলাদেশ প্রাইভেট টেলিকমিউনিকেশন কর্মচারী ইউনিয়ন একাধিকবার সংবাদ সম্মেলন করেছে। সর্বশেষ গত সোমবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি হলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তারা দাবি জানান অপহৃত সহকর্মীদের দ্রুত পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার।
ফ্যামিলি ট্যুর প্যাকেজ
গত ২২ জানুয়ারি ২০২৫ থেকে শুরু করে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা, মাটিরাঙ্গা, মানিকছড়ি এবং রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর এলাকায় অন্তত ৫০টির বেশি মোবাইল টাওয়ার সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে বিকল হয়ে পড়েছিল। ওই সময় ইউপিডিএফ টাওয়ারে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে, অফিস ভাঙচুর করে এবং মূল্যবান সরঞ্জামাদি লুট করে। প্রশাসনের হস্তক্ষেপে পরবর্তীতে কিছু কিছু টাওয়ার সীমিতভাবে সচল করা হলেও সমস্যা আজও রয়ে গেছে।
বরকলসহ পাহাড়ের নানা এলাকায় টেলিকম নেটওয়ার্ক সচল রাখতে প্রশাসনের ব্যর্থতায় স্থানীয় জনগণ ক্ষুব্ধ। তারা বলছেন, আঞ্চলিক দলের সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি প্রতিরোধে প্রশাসন যদি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করত, তাহলে রবি-এয়ারটেল টাওয়ার সচল থাকত এবং জনগণ এমন ভোগান্তিতে পড়ত না।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, শিক্ষক, ব্যবসায়ী ও সাধারণ জনগণ বারবার প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আবেদন জানালেও তেমন দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য বেড়ে চলেছে, আর জনগণ প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতা ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার মাঝে দিন পার করছে।
এই পরিস্থিতির ফলে পার্বত্য এলাকার জনগণ একপ্রকার “ডিজিটাল অন্ধকারে” বসবাস করছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশাসনিক কাজ, পেশাগত দায়িত্ব—সবই ব্যাহত হচ্ছে। ব্যাংকিং সেবা, অর্থ লেনদেন, অনলাইন পরীক্ষা ও আবেদন থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ—সবকিছু এখন অচল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বহীনতা এবং অনিরাপদ বিনিয়োগ পরিবেশের কারণে টেলিকম কোম্পানিগুলো ধীরে ধীরে পার্বত্য এলাকা থেকে সেবা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে, যা দেশের একত্রীকরণ প্রক্রিয়ার জন্য অশনিসংকেত।
প্রায় দুই দশক ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদ দমনের ব্যর্থতা এবং আঞ্চলিক সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজির প্রতাপ পাহাড়ের জনগণকে আজ পর্যুদস্ত করে তুলেছে। প্রশাসন ও সরকার যদি এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করে, তাহলে দেশ সমৃদ্ধির বিভাজন আরও তীব্রতর হবে এবং পাহাড়ের জনগণ চিরতরে রাষ্ট্রের মূলধারার বাইরে থেকে যাবে।পার্বত্যনিউজ