শিরোনাম
বান্দরবানে ৫ বন্ধু মিলে পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণ, আটক-৩ ১৬ বছর পর হারানো ক্ষমতা ফিরে পাচ্ছে সশস্ত্র বাহিনী নাইজেরিয়ায় ফজরের নামাজের সময় ভয়াবহ হামলায় নিহত অন্তত ২৭ দিল্লিতে শেখ হাসিনার জন্য রাজনৈতিক কার্যালয় গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৬২ হাজার ছাড়াল, ১৯ হাজারই শিশু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ১০ লেন করার পরিকল্পনা চূড়ান্ত,৬২ হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্প জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনী জোট বাঁধতে পারে যেসব ইসলামী দল খাগড়াছড়িতে কাগজের কার্টুনে নবজাতকের মরদেহ রাঙ্গামাটির কাপ্তাই হ্রদের পানি বিপদসীমায়: ফের খুলে দেওয়া হচ্ছে জলকপাট রাঙ্গামাটিতে স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রতিষ্ঠবার্ষিকীতে বর্ণাঢ্য আয়োজন

আমার দেখা চব্বিশের জুলাই থেকে ৫ আগস্ট

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ৫ আগস্ট, ২০২৫
  • ৯৮ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- জুলাই-২০২৪ উত্তরা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন জুলাই গণ-অভ্যুত্থান- এর কেন্দ্রস্থল। এই আন্দোলন সরকারি চাকুরি কোটা সংস্কার, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, এবং অবৈধ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শুরু হয়েছিল। শিক্ষার্থীদের এই শান্তি পূর্ণ যৌক্তিক আন্দোলনের সময় পুলিশের সাথে ছাত্রলীগ যুক্ত হয়ে উত্তরা ও আশপাশের এলাকায় ব্যাপক বিক্ষোভ, সংঘর্ষ, এবং সহিংসতার ঘটনা ঘটায়।

জুলাই আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল অন্যতম হটস্পট ছিলো উত্তরা। এখান থেকে ছাত্র-জনতা স্বৈরাচার হাসিনার বিরুদ্ধে শক্ত দুর্গ গড়ে তুলেছিল। এই অঞ্চলে পুলিশের সাথে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষের ফলে অনেক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। খালি হয়েছে অনেক মায়ের বুক। বিধবা হয়েছে অনেক বোন, সন্তান হারা হয়েছে বাবা।

১৬ই জুলাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্প থেকে স্বৈরাচার বিরোধী মিছিল নিয়ে দিয়াবাড়ী খালপাড় হয়ে জমজম টাওয়ার সড়ক মিছিল মিছিলে সরব করে তোলে। পরবর্তীতে তারা উত্তরা বিমানবন্দর মহাসড়ক বিএনএস সেন্টারের সামনে এসে জড়ো হয়। শিক্ষার্থীরা যৌক্তিক দাবি নিয়ে শান্তি পূর্ণ আন্দোলন করেন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালায় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতা কর্মীরা। তাদের সড়কে বসতেই দিবেনা, তবুও শিক্ষার্থীরা হাল ছাড়নি, বসে আছে সড়কে, স্লোগান দিচ্ছে কোটার বিরুদ্ধে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপর হামলা ও গ্রেফতারের বিরুদ্ধে উত্তরা জুড়ে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

১৮ই জুলাই : সশস্ত্র অবস্থায় পুলিশ-ছাত্রলীগ, অপরদিকে নিরস্ত্র শিক্ষার্থী, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, মূহুর্তের মধ্যে ছুটে আসে ছাত্র-জনতা। উৎসুক জনতার কমতি ছিলনা ওই দিন। তারাও দেখছে, কি হচ্ছে বুঝে উঠতে পারছে না। শুরু হলো পুলিশের ফাঁকা গুলি ও কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া-ছুঁড়ি। কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ায় চোখ-মুখ জ্বলছে, তবুও সেই দিন পিছু হটেনি তারা। প্রতিবাদ হিসাবে তারা রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পুলিশকে ইট পাটকেল মারছে। এক দিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগ ও পুলিশের লাঠি চার্জ, গুলি, অপরদিকে মেয়াদ উত্তীর্ণ বিষাক্ত টিয়ার সেল ও কাঁদানে গ্যাসের মধ্যে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়ে উঠে উত্তরা আজমপুর বিএনএস সেন্টার। বিমানবন্দর মহাসড়কের অবরোধ কর্মসূচিতে অবস্থান নেয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইইউবিএটি, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি, উত্তরা ইউনিভার্সিটি, রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ, মাইলস্টোন কলেজ, উত্তরা হাইস্কুল, নওয়াব হাবিবুল্লাহ স্কুল এন্ড কলেজ, টঙ্গী সরকারি কলেজ, টাউন কলেজসহ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। টিয়ারগ্যাস, রাবার বুলেট, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার মার পেঁচে পরে ‘পানি লাগবে পানি’ র ফেরিওয়ালা মীর মুগ্ধ পুলিশের গুলিতে নিহত হন। ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত’র ঘটনায় উত্তপ্ত হয়ে উঠে উত্তরার রাজপথ। ধীরে ধীরে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে সাধারণ মানুষ। মুগ্ধের মৃত্যুতে ভারী হয়ে উঠে উত্তরার আকাশ। উত্তরার অলি-গলিতে হেঁটে হেঁটে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পানি খাওয়ানো সেই ছেলেটা মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধকে আজিমপুরে পুলিশ গুলি করে মেরে ফেলার ঘটনায় সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি ছাত্র আন্দোলন আরো বেগবান হয়ে উঠে।

১৯ জুলাই : ’২৪- এর ছাত্র আন্দোলনে শরিক হতে শিক্ষার্থীদের সাথে আসা কয়েকজন অভিভাবকের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তারা বলেছেন, শেখ হাসিনার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, পুলিশ ও র‌্যাব বাহিনী যে ভাবে ৫ মিনিট পর পর শিক্ষার্থীদের উপর নির্বিচারে ফাঁকা গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ছে, এটি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দমাতে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পুলিশ বাহিনী ব্যবহার করেছে সাউন্ড গ্রেনেড। কাঁদানে গ্যাস থেকে বাঁচতে সড়কে বাঁশ, কাঠ, টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে স্লোগান দিচ্ছে কোমল মতি শিক্ষার্থীরা। তারা বলছে, ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার।’ ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস, উই ওয়ান্ট জাস্টিস,’ ‘দিয়েছি তো রক্ত আরো দিবো রক্ত,’ ‘ছাত্রলীগের আস্থানা ভেঙে দাও গুড়িয়ে দাও।’ স্লোগান শেষ হতে না হতেই এরই মধ্যে শুরু হয় পুলিশের গুলি। উত্তরা পূর্ব থানার সামনে থেকে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ লোহার বড় বড় রড, বাঁশ কাঠ হাতে নিয়ে পুলিশ বাহিনীসহ ঝাপিয়ে পরে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার উপর। ওই সময় আহত হয় শতাধিক শিক্ষার্থী।

রক্তাক্ত শরীর নিয়ে শুরু হয় দৌড়া দৌড়ি, আহতদের নিয়ে হাসপাতালে ছুটছেন কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। কারো শরীরে রাবার বুলেট, কারো মাথায় গুলি লাগে, কারো বুকে, কারো পিঠে আবার কারো কারো পায়ে গুলি ও রাবার বুলেটের যন্ত্রণা নিয়ে ভ্যানগাড়ি অটোরিকশা ও পায়ের রিকশা করে ছুটছেন হাসপাতালের দিকে। আহতদের চিকিৎসা দিতে হাসপাতালে নেওয়ার সময় রিকশা ও ভ্যান গাড়িতেও হামলা করে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ। সেই দিন তিল ধারণের জায়গা ছিলোনা উত্তরার হাসপাতালগুলোতে। চারিদিকে রক্ত আর রক্ত। কি হৃদয় বিদারক করুণ দৃশ্য! নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হতো না। সহপাঠীদের গ্রেফতারের খবর পেয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা যখন ন্যায্য দাবী নিয়ে বিএনএস সেন্টার এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে আজমপুর পূর্ব থানার দিকে রওয়ানা দেয়, ঠিক তখনই আজমপুর রাজউক মার্কেটের কোনায় র‌্যাব বাহিনীর একটা গাড়ী ব্যাক গিয়ার মেরে শিক্ষার্থীদের উপর তুলে দেয়। এতে আহত হয় অনেক অনেক সাধারণ মানুষ। র‌্যাবের এহেন অমানবিক দৃশ্য দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন। ধীরে ধীরে ছাত্র আন্দোলনের তীব্রতা আরো বেড়ে যায়। আন্দোলন ঠেকাতে পুলিশ ও র‌্যাব বাহিনী টিয়ারগ্যাস, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করা শুরু করে। ছাত্ররা জীবনের পরোয়া না করে তাদেরকে ধাওয়া করে পূর্ব থানার সামনে স্লোগান দিতে থাকে। এ সময় উত্তেজিত জনতা উত্তরা পূর্ব থানার সামনে পুলিশের কয়েকটি গাড়ি পুরিয়ে দেয়। সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের গায়ে গাড়ি উঠিয়ে দেওয়ার দৃশ্যটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। এই দৃশ্য দেখার পর স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রক্তে শিহরণ জেগে উঠে। তারা আরো বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে ‘ছিঃ ছিঃ হাসিনা লজ্জায় বাঁচি না’, ‘আমার ভাই মরলো কেন? শেখ হাসিনা জবাব চাই’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ বলে স্লোগান দিতে থাকে।

আমি কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে আলাপ করে জেনেছিলাম, তারা প্রতিদিন সকালে বাসা থেকে বের হয়ে সারা দিন উত্তরার রাজপথে কাটাতো। কি খাবে? নেই কোন চিন্তা। অপরদিকে দেখা যায়, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের জন্য শত শত মানুষ কার্টুন কার্টুন বিস্কুট, শত শত পানির বোতল, চিড়া-মুড়ি গুড়সহ শুকনো খাবার নিয়ে এসে বলছেন নেন- খাবার নেন, নেন-পানি নেন, কি লাগবে নেন ভাইয়া। এমন দৃশ্য দেখলে কার মনে দাগ কাটবে না?

উত্তরা বিএনএস সেন্টার এলাকায় আমি আরো দেখলাম, প্রতিদিন দুপুর ও বিকালে মেডিক্যাল টিমের নারীরা খাওয়ার স্যালাইন, তুলা, স্যাভলন, নাপা ট্যাবলেটসহ বিভিন্ন ঔষধ নিয়ে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের সেবা দিয়েছেন। তাদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম চাকুরী হারানো ভয় নেই? ওই দিন তারা বলেছে চাকরি গেলে যাক, চাকুরির ভয় করিনা, এই মূহুর্তে আমার ভাই-বোনদের সেবা দেওয়া জরুরি।

দেওয়ান বাড়ি থেকে কয়েকজন এসেছে আন্দোলনে তারা আপন তিন বোন, সাথে দুই বছরের শিশু বাচ্চা। কেন আসেন জানতে চাইলে তারা বলেন, অধিকার আদায় করতে এসেছি। শেখ হাসিনা আমাদের দাবি না মানা পর্যন্ত আমরা মাঠে থাকবো।

আজমপুর এলাকায় দেখা যায়, উত্তরার সেক্টর এলাকার অনেক নারী পুরুষ রিকশাভরে ভরে খাবার পানি ও শুকনো খাবার নিয়ে বিমানবন্দর মহাসড়ক বিএনএস সেন্টার ও আজমপুর এলাকার শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করেন। ফলে খাবারের অভাব ছিলোনা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের।

১৯ জুলাই ২০২৪ কোটা সংস্কার আন্দোলনের দ্বিতীয় দিনে সারা দেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালিত হয়। ওই দিন ও উত্তরায় পুলিশ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ, যুবলীগের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এতে অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ফ্যাসিষ্ট সরকার ওই দিন দিবাগত রাত ১২টা থেকে সারা দেশে কারফিউ জারি করে এবং বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করে।

২০-২৫ জুলাই ২০২৪ পর্যন্ত কারফিউ চলাকালীন সময়েও বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ চলতে থাকে। এসময় দেখা গেছে কারফিউর কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত বন্ধ থাকে এবং যানবাহন চলাচল সীমিত হয়ে যায়।
ফ্যাসিস্ট সরকার কারফিউর সময়সীমা প্রথমে নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্য জারি করলেও পরে তা অনির্দিষ্টকালের জন্য বাড়ানো হয়।

একটা জিনিস আমি দেখলাম, ভাবতেও অবাক লাগে, সারা দেশে কারফিউ অব্যাহত থাকলেও আওয়ামী লীগ নেতারা ওই সময় রাজলক্ষী, আমির কমপ্লেক্স, জমজম টাওয়ার, আব্দুল্লাহপুর, জসিমউদদীন ও আজিমপুর সমাবেশ করেছেন। সংবাদ কর্মী হিসেবে আমার এই সংবাদটি পত্রিকায় ছাপানো হয়েছে। আন্দোলনের সময় সরকার দেশজুড়ে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয়। তখন আমরা কেউ অবাধ তথ্য প্রবাহ সুবিধা পাইনি। কারফিউ জারির এই সিদ্ধান্ত দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এবং বিভিন্ন দেশ এই সহিংসতার নিন্দা জানায় এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানায়।

ছাত্র আন্দোলন ঠেকাতে ১৬ জুলাই থেকে ৪ আগষ্ট পর্যন্ত পুরো উত্তরাজুড়ে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের তান্ডব অব্যাহত ছিলো। উত্তরার প্রতিটি সেক্টর ছিলো তাদের নিয়ন্ত্রণে। পুলিশের নাকের ডগায় দেশি বিদেশি অস্ত্র হাতে পুরো উত্তরায় ঘুরে বেড়াতো তারা। তৎকালীন এমপি খসরু চৌধুরী, সাবেক এমপি হাবিব হাসান, আফসার খান, তোফাজ্জল হোসেন, নাঈম বেপারী, আলাউদ্দিন সোহেলের নেতৃত্বে বিমানবন্দর মহাসড়কে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করা হতো। ওই সময় আমি দেখেছি জসিমউদদীন এলাকায় ঢাকা-১৮ আসনের সাবেক এমপি খসরু চৌধুরীকে ছাত্র- জনতা ধাওয়া করে। ধাওয়া খেয়ে তিনি দুই দিন পর বিদেশ পালিয়ে যান।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর নির্যাতন চালাতে চালাতে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর দলবল নিয়ে উত্তরায় হামলা করলে শিক্ষার্থীরা একজোট হয়ে তাকে ধাওয়া করলে সে পালিয়ে যায়। খবর পেয়ে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা উত্তরা ৭ নং সেক্টরের ওই বাসায় ছুটে গিয়ে লোহার গেইট ভেঙে ভিতরে ঢুকে যায়। ঘরের দরজা ভাংতে গেলে জাহাঙ্গীরের বডিগার্ড পিস্তল দিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলি চালায়। এতে ঘটনাস্থলে তিনজন নিহত হয়। উত্তেজিত জনতা সেই বর্ডিগার্ডকে পিটিয়ে মেরে ফেল্লেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসে জাহাঙ্গীরকে নিয়ে যায়।

আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগ নেতা হাবিব হাসানকে শিক্ষার্থীরা ধাওয়া করলে তার সাথে থাকা সোহেল ও তার ক্যাডার বাহিনী অস্ত্র দিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলি করে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। ওই সময় দুইজন শিক্ষার্থী মারা গেলে উত্তেজিত জনতা আওয়ামী লীগ নেতা ইঞ্জি: আনোয়ারকে ধরে পিটিয়ে মেরে ফেলে।
২ আগস্ট : শুক্রবার বৃহত্তর উত্তরার বিভিন্ন স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে বিমানবন্দর মহাসড়কে উপস্থিত হয়ে স্লোগান তুলেন, আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দিবো না, রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে অন্যায়, ছিঁ ছিঁ পুলিশ ভাই, তোমার কি ভাই-বোন নেই।

৩ আগস্ট : শনিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ছাড়াও যুবলীগ ও ছাত্রলীগের অবস্থান কর্মসূচি ও উত্তরার বিভিন্ন সড়কে বিক্ষোভ মিছিল করেন। পুলিশের ধাওয়া খেয়ে উত্তরা আধুনিক হাসপাতাল ও উত্তরা ১১ নং সেক্টরে আশ্রয় নেওয়া শিক্ষার্থীদেরকে তারা বেদম প্রহার করে। এই দিন পুলিশের গুলিতে লন্ড্রি দোকানদার দুলাল সহ আরো অনেকে আহত হয়েছে।

৫ আগস্ট : আমি ওইদিন একটু সকাল সকাল এসেছিলাম উত্তরায়। ১৪৪ ধারা চলাকালীন সময়ে ভোর থেকে সড়কে সেনাবাহিনীর সদস্য ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি ছিলো অনেক বেশি। সরকার পতনের একদফা দাবি নিয়ে গণভবনের উদ্দেশ্যে যেতে ১৪৪ ধারা ভেঙে ৫ আগস্ট সকাল থেকে উত্তরার বিভিন্ন অলিগলিতে জড়ো হয় ছাত্র-জনতা। সকাল ১০টার দিকে লোকজনের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ভোর থেকে উত্তরা আব্দুল্লাহপুর ও বিএনএস সেন্টার থেকে বিমানবন্দর ফুটওভার ব্রিজ ও সড়কে সেনাবাহিনী সশস্ত্র অবস্থায় পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে কেউ বিমানবন্দর মহাসড়কে আসে না। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সড়কে জমে গেলো হাজার হাজার মানুষ, মানুষের ঢল দেখে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা যার যার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আন্দোলনকারীরা স্লোগান দিতে দিতে বিমানবন্দর মহাসড়ক বিএনএস সেন্টার পার হয়ে চলে যায় গণভবনে। এর পরই সড়কে নেমে আসে মানুষের ঢল। গাজীপুর ও উত্তরা থেকে কয়েক লাখ মানুষ সরকার বিরোধী স্লোগান দিতে দিতে হাঁটতে শুরু করে গণভবনে দিকে। তাদের চোখে মুখে ছিলো আনন্দের ছাপ, তাদের একটাই দাবি শেখ হাসিনা বাংলা ছাড়। হাতে ছিলো বাংলাদেশের পতাকা, আরো ছিলো রঙ বে রঙয়ের ফেস্টুন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের তোপের মুখে ৫ আগস্ট (৩৬ জুলাই) এই দিনে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন এবং দেশ ত্যাগ করেন। আন্দোলনকারীরা ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ হিসেবে এই দিনটি উদযাপন করবেন।

৫ আগস্ট দুপুরে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে আওয়ামী লীগের দোসর গুন্ডা পুলিশ বাহিনী উত্তরা পূর্ব থানার সামনে নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে অনেক নিরিহ মানুষ মারা যায়। ওই দিন আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম পূর্ব থানা উল্টো পাশে। ঘড়ির কাঁটায় বিকাল ৪.২০ ধোঁয়া আর ধোঁয়া কিছুই দেখা যায় না, বন্দুকের আওয়াজ আর আওয়াজ। উত্তরা পূর্ব থানায় লুকিয়ে থাকা ছাত্রলীগ ও পুলিশ বাহিনী নিজের প্রাণ বাঁচাতে সড়কে এলোমেলো গুলি চালিয়ে সাউন্ড গ্রেনেডে ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে পালিয়ে গেলেন এয়ারপোর্টের দিকে। এই নরপিশাচরা নিজেরা কয়েকজন বাঁচতে কেঁড়ে নিলো অনেকগুলো তাজা প্রাণ, আহত হয়েছে অনেকে। সব শেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে এটাই শান্তনা। ৫ আগস্ট রাতেই উত্তরাতে বিজয় মিছিল। সড়কের কোথায় তিল পরিমাণ জায়গা নেই। আপামর জনগণ অংশ গ্রহণ করেছে এই বিজয় উৎসবে। আমার দৃষ্টিতে এ বিজয় ছাত্র-জনতার রক্তস্নাত বিজয়।ইনকিলাব

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions