বিভীষিকাময় এক ঘটনা দেখলো দেশ,আগুনে পুড়ে ঝরে গেল অন্তত ২৭ জীবন,মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে-১৭১

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২২ জুলাই, ২০২৫
  • ৩৬ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- মর্মান্তিক। মর্মন্তুদ। বিভীষিকাময় এক ঘটনা দেখলো দেশ। স্কুল ভবনে আকস্মাৎ আছড়ে পড়লো প্রশিক্ষণ বিমান। বিস্ফোরণ-আগুনে পুড়ে ঝরে গেল অন্তত ২২টি জীবন। অগ্নিদগ্ধ হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে দেড় শতাধিক কচি প্রাণ। পোড়া শরীর নিয়ে শিশুদের বাঁচার আকুতি। আহত সন্তান নিয়ে অভিভাবকদের গগন বিদারী আর্তনাদ। হাসপাতালে হাসপাতালে কান্না আর আহাজারিতে সোমবারের বিকালটা হয়ে উঠেছিল এক বিভীষিকার বিকাল। গতকাল দুপুরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান এফটি-৭ বিজিআই রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজের স্কুল ভবনে বিধ্বস্ত হয়। এতে বিমানের পাইলটসহ অন্তত ২২ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের কয়েকজন ছাড়া সবাই স্কুলের ক্ষুদে শিক্ষার্থী। গুরুতর আহতদের জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। এছাড়া উত্তরাসহ রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালেও অনেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিমানটি দুর্ঘটনায় পড়ে বলে জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর আইএসপিআর। দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে বিমান বাহিনীর পক্ষ থেকে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। তিনদিনের জন্য স্থগিত করা হয়েছে জুলাই অভ্যুত্থান স্মরণে চলমান কর্মসূচি। দেশের ইতিহাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা এটিই প্রথম। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন ট্র্যাজেডির ঘটনাও বিরল।
আহতদের চিকিৎসায় সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছে সরকার। ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থল ও হাসপাতালে ছুটে যান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা। সেনাবাহিনী প্রধান, পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাবসহ বিভিন্ন বাহিনী প্রধানরাও ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তারা উদ্ধার ও আহতদের চিকিৎসা তৎপরতা তদারকি করেন। স্থানীয় জনসাধারণ ও স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষার্থীরাও উদ্ধার কাজে সহায়তা করেন। হতাহতের ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিন, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। শোক প্রকাশ করা হয়েছে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও। আহতদের দেখতে ও চিকিৎসার খোঁজ নিতে বিভিন্ন দলের নেতারা তাৎক্ষণিক হাসপাতালে ছুটে যান। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর-আইএসপিআর জানিয়েছে, বিমান বাহিনীর ‘এফ-৭ বিজিআই’ফাইটার জেটটি সোমবার দুপুর ১টা ৬ মিনিটে উড্ডয়নের ১২ মিনিটের মাথায় বিধ্বস্ত হয়। মাইলস্টোন স্কুলের উত্তরা ক্যাম্পাসের হায়দার আলী ভবন নামের দুইতলা একাডেমিক যে ভবনে বিমান বিধ্বস্ত হয় সেখানে ইংরেজি মাধ্যমের ক্লাস থ্রি থেকে এইটের শিক্ষার্থীদের কোচিং হতো। এছাড়া প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের ক্লাসও নেয়া হতো এ ভবনে। বেলা একটার পর ক্লাস ছুটি হলেও শিক্ষার্থীদের একটি অংশ কোচিংয়ে থেকে যায়। এছাড়া অভিভাবকদেরও অনেকে ভবনের সামনে অবস্থান করছিলেন। বিধ্বস্ত হওয়ার পরপরই উড়োজাহাজটিতে আগুন ধরে যায়। অনেক দূর থেকেও সেখানে ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়। জ্বলন্ত উড়োজাহাজটির আগুন নেভাতে ঘটনাস্থলে ছুটে যায় ফায়ার সার্ভিসের নয়টি ইউনিট। উড়োহাহাজের আগুন ক্লাসরুমে ছড়িয়ে পড়লে সেখানে আটকা পড়েন শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মচারীরা। দুর্ঘটনার পরপরই স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও আশপাশের লোকজন উদ্ধারে ছুটে যান। পরে যুক্ত হয় ফায়ার সার্ভিস ও অন্যান্য বাহিনী। দুর্ঘটনাস্থল থেকে আহত ও দগ্ধদের রিকশা, ঠেলাগাড়িসহ বিভিন্ন বাহনে করে সরিয়ে নিতে দেখা যায়। প্রাথমিকভাবে ঢাকা সিএমএইচ, উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতাল, উত্তরা আধুনিক হাসপাতাল, কুর্মিটোলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল, লুবনা জেনারেল হাসপাতাল এন্ড কার্ডিয়াক সেন্টারে নেয়া হয় আহতদের। সেখান থেকে দগ্ধদের অধিকাংশকে পাঠানো হয় জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে ঘটনাস্থালে সাংবাদিকদের বলেন, তাদের কর্মীরা ধ্বংসস্তূপ থেকে ১৯ জনের লাশ উদ্ধার করেছে। আইএসপিআর রাতে জানায়, বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমানের পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলামসহ মোট ২১ জন সেখানে মারা গেছেন। নিহতদের মধ্যে ঢাকা সিএমএইচ-এ নিহত ১২ জন, বার্ন ইনস্টিটিউটে ২ জন, কুর্মিটোলা জেনারেল হসপিটালে ২ জন, উত্তরার লুবনা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড কার্ডিয়াক সেন্টারে ২ জন, ঢাকা মেডিকেলে ১ জন, উত্তরা আধুনিক হসপিটালে ১ জনের লাশ ছিল। ওদিকে, জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক ইন্সটিটিউটের আবাসিক সার্জন শাওন বিন রহমান রাত ১টার দিকে জানান, রাতে সাড়ে ১০টায় ১ জন ও ১২টার দিকে আরেকজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। সোমবার রাতে এক বিজ্ঞপ্তিতে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, রাজধানীর ৮টি হাসপাতালে ১৭১ জন চিকিৎসা নিচ্ছে। রাতে জাতীয় বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান জানান, হাসপাতালে আহত ৮৮ জন ভর্তি আছে। এর মধ্যে বার্ন ইনস্টিটিউটে ৪৪ জন আছেন। তাদের ২৫ জনের অবস্থা গুরুতর।
বেলা দুইটার পর দেখা যায়, বিমান দুর্ঘটনার পর উত্তরা উত্তর মেট্রো স্টেশন থেকে সারিবদ্ধ হয়ে একের পর এম্বুলেন্স প্রবেশ করছে রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, আনসার, এপিবিএন সদস্যরা সকলে মিলে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করছে। এক একটি এ¤ু^লেন্সে স্কুলের ভেতর থেকে আহতদেরকে উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ মেডিকেল, সিএমএইএচ, জাতীয় বার্র্নসহ বিভিন্ন হাসপাতালে। বিমান বিধ্বস্তের খবর পেয়ে অনেক অভিভাবক স্কুলের সামনে ভিড় করছেন তাদের সন্তানের খোঁজ নিতে। অনেকে ভেতরে ঢুকতে না পেরে স্কুলের গেটের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েন। আরিফুল ইসলাম নামে এক অভিভাবক বলেন, আমার মেয়ে সুফিয়া কামাল হলের ৭ তলার ৯ নম্বর রুমে ছিল। ওর এখন কী অবস্থা, কোথায় আছে আমরা কিছুই জানি না। বাংলা ভার্সনের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী নিধির খোঁজে আসা তার বড় ভাই বলেন, যেখানে বিমানটা বিধ্বস্ত হয়েছে সেই ভবনেই আমার বোন ক্লাস করছিল। ও বাংলা ভার্সনের ৩য় শ্রেণিতে পরে। ওর রোল ১১১২। নিধি এখনো বাসায় যায়নি। আমরা সবগুলো হাসপাতাল খুঁজে দেখছি কোথাও নেই।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভেতরে প্রবেশ করে দেখা যায়, গেট দিয়ে ঢুকে ভেতরের বাম পাশে বড় মাঠ। মাঠের সামনেই ইংরেজি ভার্সন ও নাইন থেকে ইন্টার মিডিয়েটের শিক্ষার্থীদের জন্য একের পর এক ভবন। সেখানে গতকাল অনেক শিক্ষার্থীরই পরীক্ষা চলছিল। আর মাঠের সামনে হাতের ডান পাশে ‘হায়দার আলী হল’ নামে পুরনো দুই তলা ভবন। যেখানে প্লে গ্রুপ থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা ভার্সনের শিশুদের ক্লাস নেয়া হয়। ক্লাসের পর সেখানেই হয় কোচিং। বিকট শব্দে বিধ্বস্ত হয়ে ওই বিমানটি ঠিক ওই হায়দার আলী হলের সিঁড়ির নিচে ঢুকে যায়। বিমানের আগুনে মুহূর্তেই ভবনে আগুন লেগে যায়। মো. হুমায়ন কবির নামে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একজন শিক্ষক বলেন, আমি তখন ক্লাস টেনের রুমে ছিলাম। ওদের একটা পরীক্ষা চলছিল। এর মধ্যেই আমাদের ওই বিল্ডিংয়ের ওপরে বিশাল এক বিস্ফোরণের শব্দ হলো। ওই বিস্ফোরণের বিষয়টি জানতে বাইরে এসে দেখি একটি বিমান বাংলা ভার্সনের প্রাথমিকের ভবনের সিঁড়ির নিচে ঢুকে গেছে। তাতে দাউ দাউ করে আগুন জ¦লছে। বাচ্চারা ছোটাছুটি করছে। ওই সময় ক্লাসরুমে থাকা ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্কুলটির পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র দেব মিত্র বলে, প্লে গ্রুপ থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত আমাদের সকলের ওই হায়দার আলী ভবনে ক্লাস হয়। অন্যদিনের মতো কালকেও আমরা ক্লাসরুমে ছিলাম। সাড়ে ১২টায় অনেকের ছুটি হয়ে গেলে কেউ কেউ ক্লাসরুমের সামনের দোলনায় ঝুলছিল, বল নিয়ে খেলা করছিল। আর আমরা যারা বৃত্তির কোচিং করবো তারা ক্লাসরুমে বসে টিফিন খাচ্ছিলাম। এরমধ্যে হঠাৎ বিশাল একটা শব্দ হলো। তাকিয়ে দেখলাম- এটা বিমান যেন সামনের ভবনের ছাদের আঘাত খেয়ে আমাদের দিকে ছুটে আসছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখি আগুন আর আগুন। আমি তখন খাবার ও বইয়ের ব্যাগ ফেলে দৌড়ে মাঠের দিকে চলে যাই। তখন শিক্ষকরা পাশের ভাঙা গেট দিয়ে আমাদের বেরিয়ে যেতে বলেন। আমিও তখন তাদের সঙ্গে বাইরে চলে আসি। পরে রাস্তার একজনের ফোন দিয়ে আমার বাবার নম্বরে ফোন করে জানাই। আকবর নামে স্কুলটির একজন সিকিউরিটি গার্ড বলেন, আমরা স্কুলের ভেতরেই ছিলাম। কিছু বাচ্চার ছুটি হয়েছে, যাদের অভিভাবক নিতে এসেছে তাদের বের করছিলাম। এর মধ্যেই এই ঘটনা। তিনি বলেন, বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার আগে এত জোরে শব্দ হয়েছে যে, আশপাশের মানুষ পর্যন্ত চলে এসেছে। তিনি বলেন, এই স্কুলের ওপর দিয়ে বিমানের রুট। হযরত শাহ্জালাল বিমান বন্দরে ওঠা-নামা করা সকল বিমানই এই স্কুলের ওপর দিয়ে যায়। তাই বিমান নিয়ে আমরা তেমন কোনো কিছু ভাবি না। কিন্তু বিমান যে এইভাবে স্কুলের ওপর পড়বে তা কখনোই চিন্তা করিনি। হাদি আলমাস নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, আমরা দেখলাম বিমানটি স্কুলের নতুন বিল্ডিয়ের সঙ্গে মনে হলো ধাক্কা খেলো। এরপরই আগুন ধরে আছড়ে পড়ে। তিনি বলেন, এখানে সব ছোট ছোট বাচ্চা। কতো বাচ্চা ছটফট করে চোখের সামনে চলে গেল কিছুই করতে পারলাম না। দিনভর উদ্ধার কাজ চালানোর পর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ফায়ার সার্ভিস ও বিমান বাহিনীর কর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত বিমানের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করে ট্রাকে করে নিয়ে যান। বিমানের আগুনে হায়দার আলী ভবনের বেশির ভাগই পুড়ে গেছে। নিচতলা-দুইতলার একাধিক শ্রেণি কক্ষের কিছু অবশিষ্ট নেই। ভবনে প্রবেশের সিঁড়ির নিচে মাটির ভেতর ঢুকে যায় বিমানের মাথা। মাইলস্টোনের মাঠে বসে উদ্ধার তৎপরতা পর্যবেক্ষণ করছিলেন শিক্ষা উপদেষ্টা চৌধুরী রফিকুল আবরার। সবশেষ ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সন্ধ্যায় তিনি বলেন, আমরা এটুকু নিশ্চিত করতে পারি যে- যারা আহত হয়েছেন, তাদের সুচিকিৎসার জন্য আমরা ভীষণ রকমভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। এ ব্যাপারে কোনো ধরনের গাফিলতি এখানে হবে না। আমরা এটাও মনে করি যে এই দুর্ঘটনার একটা ভালো রকমের তদন্ত হওয়া দরকার, সেটাও করা হবে। শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, আমরা অত্যন্ত শোকাহত যে এই ঘটনা ঘটেছে, অনেকগুলো তরুণ প্রাণ ঝরে গেছে। এই ধরনের একটা ভয়ানক দুর্ঘটনায় আমরা শোকসন্তপ্ত পরিবারগুলোর প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। যারা আহত হয়েছেন, তারা যেন দ্রুত সুস্থ হন, তার জন্য আমরা পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা করছি।
দুর্ঘটনায় পড়া এফ-৭ বিজিআই মূলত চীনের তৈরি চেংদু জে-৭ সিরিজের একটি মাল্টি-রোল জেট ফাইটার। সোভিয়েত আমলের মিগ ২১ এর উন্নত এই চীনা সংস্করণ তৈরি করেছে চেংদু এয়ারক্র্যাফ্ট করপোরেশন। চেংদু জে-৭ সিরিজের সবচেয়ে আধুনিক সংস্করণ এফ-৭ বিজিআই। এক ইঞ্জিনের এ বিমানের সর্বোচ্চ গতি মাক ২.২ (শব্দের গতির ২.২ গুণ)। আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র, লেজার গাইডেড বোমা ও জিপিএস গাইডেড বোমা, বাড়তি জ্বালানি ট্যাংকসহ দেড় হাজার কেজি ওজন বইতে পারে এসব জঙ্গি বিমান। এ বিমানের ককপিটে একজন বৈমানিক বসতে পারেন। কেএলজে-৬ এফ রাডার ব্যবহার করা হয় এফ-৭ বিজিআই বিমানে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর মোট ৩৬টি এফ-৭ যুদ্ধবিমান রয়েছে। এরমধ্যে বেশির ভাগই এফ-৭ বিজিআই। ২০১১ সালে বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে ১৬টি জেট ফাইটার কেনার চুক্তি করে এবং ২০১৩ সালে সেগুলো বিমান বাহিনীর বহরে যুক্ত হয়। ওই বছরই চেংদু এয়ারক্র্যাফ্ট করপোরেশন এই মডেলের উড়োজাহাজের উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। এর আগে ২০১৮ সালের নভেম্বরে টাঙ্গাইলের মধুপুরে মহড়ার সময় বিমান বাহিনীর একটি এফ-৭ বিজি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। ২০২১ সালের নভেম্বরে চট্টগ্রামের জহুরুল হক ঘাঁটি থেকে উড্ডয়নের পর বঙ্গোপসাগরে বিধ্বস্ত হয় একটি এফ-৭ এমবি। ওই দুই ঘটনায় দু’জন বৈমানিক নিহত হন।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিমান বাহিনীর বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনায় শোক জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। এক তথ্য বিবরণীতে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট দুর্ঘটনায় নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। তিনি বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন। প্রধান উপদেষ্টা এক শোকবার্তায় বলেন, এই দুর্ঘটনায় বিমানসেনা ও মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষক-কর্মচারীসহ অন্যান্যদের যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয়। জাতির জন্য এটি একটি গভীর বেদনার ক্ষণ। তিনি বলেন, সরকার দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি এবং সবধরনের সহায়তা নিশ্চিত করবে। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় জানিয়েছে, মাইলস্টোনের ঘটনায় মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক পালন করা হবে। এর অংশ হিসেবে মঙ্গলবার দেশের সকল সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। পাশাপাশি সকল সরকারি, বেসরকারি ভবন ও বিদেশে বাংলাদেশি মিশনেও জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। হতাহতদের জন্য দেশের সকল ধর্মীয় উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হবে।

উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সোমবার রাতে এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, এ ঘটনায় পুরো জাতি হতভম্ব, বাকরুদ্ধ। আমরা নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করছি। আগুনে পুড়ে যাওয়া শিশুদের মা-বাবাকে আমরা কী জবাব দেবো? প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমার বলার কোনো ভাষা নেই। কীভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। আমার মতো সারা দেশের লোক আজ হতবাক। এ রকম একটা কাণ্ড হতে পারে আমরা কেউ কল্পনা করিনি, ধারণার মধ্যে ছিল না। কিন্তু এ অবিশ্বাস্য জিনিস আমাদের হঠাৎ করে গ্রহণ করতে হয়েছে। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের যে দুর্ঘটনা প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে শিশুদের ওপর পড়লো, আগুনে পুড়ে মরলোÑ মা-বাবাদের আমরা কী জবাব দেবো, কী বলবো। অজানা শিশুদের মুখ সবার চোখে ভেসে উঠছে। সারা জাতি হতভম্ব, বাকরুদ্ধ। শোকাহত বললে কম বলা হবে।
তিনি আরও বলেন, এখনো লাশ আসছে হাসপাতালে। এখনো হাসপাতালে মারা যাচ্ছে। মা-বাবা খোঁজ নিচ্ছে আমার সন্তান কোথায়? তাকে আর কোনোদিন চেনা যাবে কিনা। যাদের লাশ দেখছি তার মধ্যে আমার সন্তান আছে কিনা। পৃথক করার তো কোনো উপায় নেই। এরা আমাদের সবার সন্তান। হঠাৎ করে চিরদিনের জন্য চলে গেল। আমরা তদন্ত করবো কিন্তু তদন্তে তো তারা ফিরে আসবে না। আমরা চিকিৎসার ব্যবস্থা করছি। সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ছে। সকল হাসপাতালে মানুষ ছুটে আসছেন। সবার প্রতি আমাদের অনুরোধ হাসপাতালে ভিড় করবেন না। আহতদের জন্য এটি ভালো না। তাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধের শক্তি নেই। আমরা ভিড় করে থাকলে আমাদের শরীর থেকে তাদের মধ্যে কী রোগ ছড়িয়ে পড়ে তা বলা মুশকিল। কাজেই দূরে থেকে দোয়া করেন সবাই। আমরা বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনদের প্রতি আমাদের সহানুভূতি জানাচ্ছি।
প্রফেসর ইউনূস বলেন, বাংলাদেশের যত সন্তান আছে সবাই আপনাদের সন্তান। আমরা নিজেদের মনকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু আপনাদের সান্ত্বনা দেয়া বিরাট ব্যাপার। আমরা সবাই আপনাদের সঙ্গে আছি। জাতির সবাই আপনাদের সঙ্গে আছে। আমরা তাদের জন্য শোক দিবস ঘোষণা করেছি। সবাই মিলে আমরা তাদের স্মরণ করবো। তাদের আত্মার শান্তি কামনা করবো। আজ থেকে সবাই তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করবো। আল্লাহ আপনাদের শান্তি দিক। আমাদের জাতির সবাইকে যারা এ দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত সবাইকে শান্তি দিক। তাদের জন্য দেশবাসী সবাই দোয়া করছে। আল্লাহ মৃত শিশুদের জান্নাতবাসী করুক।
স্বজনদের আহাজারিতে ভারী বার্ন ইউনিট
মর্মান্তিক। হৃদয়বিদারক। ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর আড়াইটা। স্পট জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগ। বাইরে অপেক্ষা করছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। খবর সংগ্রহ করার জন্য গণমাধ্যমকর্মীদের ভিড়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও শৃঙ্খলা রক্ষার্থে ব্যস্ত সময় পার করেছেন। হাসপাতালের ওয়ার্ড বয়, নার্স, চিকিৎসকরা দম ফেলার সময় পাচ্ছেন না। রাস্তায় শত শত উৎসুক জনতার ভিড়। এর মধ্যেই সাইরেন বাজিয়ে একের পর এক এম্বুলেন্স এসে থামছে জরুরি বিভাগের সামনে। আগে থেকেই প্রস্তুত স্ট্রেচার, ট্রলি। এম্বুলেন্সের দরজা খুলে রোগীকে ভেতরে নেয়া হচ্ছে। রোগীর স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। অনেক স্বজন তাদের রোগীকে কোথায় কোন ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে সেটি খুুঁজে না পেয়ে চিৎকার করে কাঁদছেন। স্বজনদের কান্না আহাজারি ও রোগীদের ঝলসে যাওয়া শরীরের যন্ত্রণার চিৎকারে ভারী হয়ে ওঠে বার্ন ইউনিট প্রাঙ্গণ। সর্বশেষ তথ্যমতে বার্ন ইউনিটে চিকিৎসার জন্য ৫১ জনকে ভর্তি করা হয়েছে। হাসপাতালটিতে এসে মারা গিয়েছেন দু’জন। তারা হলেন- জুনায়েদ (৯) ও তানভীর (১৪)। ভর্তি রোগীরা হলেন- আসিফ (১২), মাহতাব (১৪), শামীম (১৪), আয়াত (১০), মুনতাহা (১০), রোহান (১৪), আবিদুর রহমান (১০), নাফিজ (৯), রফি বড়ুয়া (১০), সায়মা (৯), অয়ন (১৪), আবিদ (৯), সায়েম ইউসুফ (১৪), মেহেনুর (১২), আয়মান (১০), জায়রা (১৩), ইমন (১৭), আশরাফ (৩৭), ইউশা (১৯), পায়েল (১২), আলবেরা (১০), তাসমিয়া (১৫), মাহিয়া (১৪), ফাইয়াজ (১৪) আইসিইউতে মাসুমা (৩৮), মাহাতা (১৪), কাব্য (১৩), নিলয় (১৪), লরিন, জাকির (৫৫), লিমন (১৭) সায়রা (১০), রাইয়া (১১), ইদ্রিস (১৫), জায়মা (১৩), সাইবা (৯), রাইসা (১১), সামিয়া (১৪) মাহিন, নাফিস, মাসুকা (৩০), তৌফিক, নিশি (২৮), নুসরাত (১২), আরিয়ান-১, আরিয়ান-২ (১২), বাপ্পি (১০), মাসুম, এরিকসন দগ্ধদের বেশির ভাগের বয়সই ১০ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে।
গুরুতর আহত ১০ জনকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়েছে। এদের বেশির ভাগেরই শরীরের ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত দগ্ধ হয়েছে। যাদের আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়েছে তারা হলেন- মাসুকা (৩৭), বাপ্পী সরকার (৯), মাহতাব (১৪), নাফিজ (৯), শামীম (১৪), শায়ান ইউসুফ (১৪), সায়মা (১০), মাহিয়া (১৫), আফরান (১৪) এবং মাইলস্টোন স্কুলের কো-অর্ডিনেটর মাহরিন চৌধুরী (৪২)। এরিকসন ও মেহরিনের শরীরের শতভাগ দগ্ধ হয়েছে। দু’জনের দগ্ধ হয়েছে ৮০ শতাংশ করে। তারা হলেন- ১৩ বছর বয়সী নাজিয়া ও মাহতাব। ৬২ শতাংশ দগ্ধ হয় ১৫ বছর বয়সী মাকিনের। ৬০ শতাংশ করে দগ্ধ হন আয়ান ও মাসুমা। অন্যদের মধ্যে তাসনিয়ার ৩৫ শতাংশ, আরিয়ানের ৫৫ শতাংশ, আশরাফুল ইসলামের ১৫ শতাংশ, রোহানের ৫০ শতাংশ, শ্রেয়ার ৫ শতাংশ, কাব্য ২০ শতাংশ, ইউশা ৬ শতাংশ ও রূপী বড়ুয়ার ৬ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। এ ছাড়া তাসমিয়া ৫ শতাংশ, জায়ানা ৮ শতাংশ, সাইবা ৮ শতাংশ, পায়েল ১০ শতাংশ, আবির ২০ শতাংশ, কাফি আহমেদ ১০ শতাংশ, মুনতাহা ৫ শতাংশ, আলবিনা ৫ শতাংশ ও নিলয়ের শরীরের ১৮ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। নওরিন ও মাসুকা নামের দু’জনের বয়স কিংবা দগ্ধ হওয়ার পরিমাণ জানা যায়নি।
সরজমিন বার্ন ইউনিট ও আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা যায়, স্বেচ্ছাসেবীরা হ্যান্ডমাইকে বলছেন, আপনারা সড়ক থেকে সরে দাঁড়ান। এম্বুলেন্স আসার সুযোগ করে দেন। দগ্ধ অনেক রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক। আপনারা কেউ রক্ত দেয়ার থাকলে যোগাযোগ করুন। মাইকিং করে অন্য আরেকটি দল ভর্তি রোগীর স্বজনদের সন্ধান চেয়ে রোগীর নাম ঘোষণা করে স্বজনদের যোগাযোগ করতে বলছেন। সড়কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ অসংখ্য ভলান্টিয়ার উৎসুক জনতাকে সরিয়ে দিচ্ছেন। ওই সড়ক দিয়ে অন্যান্য যানবাহন চলাচল থেকে বিরত রাখতে কাজ করছেন। আর কিছুক্ষণ পরপর সাইরেন বাজিয়ে দগ্ধদের নিয়ে বার্ন ইনস্টিটিউটে ঢুকছে এম্বুলেন্স। তাদের নামিয়ে দিয়ে দগ্ধ অন্যদের আনতে আবার ছুটে যাচ্ছে উত্তরায়। দগ্ধদের সঙ্গে আসা স্বজনদের আহাজারিতে হাসপাতাল চত্বর ভারী হয়ে উঠেছে। নিখোঁজদের সন্ধানে এক ফ্লোর থেকে অন্য ফ্লোরে ছুটে বেড়াচ্ছেন তারা। তাদের চোখে-মুখে আতঙ্ক, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার ছাপ। কোথায়, কোন অবস্থায় আছে তার নিখোঁজ সন্তান। কোনো এম্বুলেন্স আসার সঙ্গে সঙ্গেই বাঁশি বাজিয়ে পথ করে দেয়া হচ্ছে, যাতে দগ্ধদের দ্রুত জরুরি বিভাগে নেয়া যায়। দুর্ঘটনার সময় মাইলস্টোন স্কুলে চলছিল প্রথম থেকে সপ্তম শ্রেণির ক্লাস। হঠাৎ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ায় শিক্ষার্থীরা দিশাহারা হয়ে পড়ে। অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়ে, কেউ কেউ প্রাণ বাঁচাতে দৌড়ে মাঠে ছুটে যায়। ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়তেই সন্তানদের খোঁজে উদ্বিগ্ন অভিভাবক ও স্বজনরা ছুটে আসেন কলেজে। সেখানে না পেয়ে ছুটে আসেন বার্ন ইনস্টিটিউটে। ইনস্টিটিউটের প্রবেশপথে ও আশপাশে অভিভাবকদের দীর্ঘ সারি তৈরি হয়। এম্বুলেন্স আসতেই জানতে চাচ্ছেন ভেতরে থাকা রোগীর নাম। খোঁজ নিচ্ছেন সেই রোগী তার আদরের সন্তান কিনা। স্বজনদের উপচে পড়া ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন পুলিশ ও আনসার সদস্যরা। একসঙ্গে এতো রোগীর চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। দগ্ধদের অধিকাংশের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলেও জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। দগ্ধদের দেখতে ও খোঁজখবর নিতে কিছুক্ষণ পরপর বার্ন ইনস্টিটিউটে উপস্থিত হচ্ছেন অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টারা ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
দোয়া চাইলেন স্বজনরা: আহতদের মা-বাবা, সন্তান, নাতি, ভাই-বোনের জন্য স্বজনদের আহাজারি ও আর্তনাদে চারপাশে এক হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সেখানে স্বজনরা দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন। বার্ন ইনস্টিটিউটের সামনে বসে কাঁদছিলেন ঝর্না আক্তার। তার ছোট ছেলে জুনায়েদ তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী, এ দুর্ঘটনায় গুরুতর দগ্ধ হয়ে ভর্তি হয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে খুব ভালো ছিল। মাঠে খেলতে গিয়েছিল, এখন বার্ন ইনস্টিটিউটে। আমি দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই, মহান আল্লাহ যেন আমার জুনায়েদসহ সবাইকে সুস্থ করে দেন। একইভাবে কান্নায় ভেঙে পড়েন মুসলিম উদ্দিন, যিনি তার একমাত্র নাতিকে নিয়ে এসেছেন বার্ন ইনস্টিটিউটে। তার নাতিও তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে এবং আজকের দুর্ঘটনায় গুরুতর দগ্ধ হয়েছে। চোখ মুছতে মুছতে বলছিলেন- আপনারা দোয়া করেন, আমার নাতি যেনো বাঁচে। একমাত্র নাতি আমার…কী কষ্টে আছে তা বলে বোঝাতে পারবো না। স্বজনদের আরেকজন সাজ্জাদ, চোখের পানি ফেলতে ফেলতে জানান- তার ভাগনে আফিফ আরিয়ান, সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। আফিফের অবস্থা গুরুতর। আমরা ওকে মানুষ করছি খুব যত্নে, আজ পর্যন্ত কোনো আঘাত লাগতে দেইনি। এখন সে হাসপাতালের বিছানায় দগ্ধ হয়ে পড়ে আছে… কীভাবে সে সহ্য করছে জানি না,’ বলেন কান্নারত সাজ্জাদ। একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সাইম খান এসেছেন তার ছোট বোনকে নিয়ে। তার বোন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। আগুনে দগ্ধ হয়ে এখন বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি। সাইম বলেন, আমার বোনসহ যারা আহত হয়েছে, সবার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই। কেউ যেন এমন পরিস্থিতিতে না পড়ে।
আহতদের প্রয়োজনে বিদেশে নেয়া হবে: বিমান দুর্ঘটনায় আহতদের প্রয়োজনে বিদেশে নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে এ কথা জানিয়ে বলেন- আমাদের জাতীয় জীবনে বিরাট একটি ট্র্যাজেডির দিন। এর আগে এমন ঘটনা ঘটেছে কিনা সেটা আমাদের জানা নেই। এ ঘটনায় আমরা সবাই শোকাহত, বাকরুদ্ধ। চিকিৎসার জন্য যত প্রস্তুতি দরকার চিকিৎসকরা করছেন। বাইরে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হলেও সে ব্যবস্থাও করা হবে। এ ছাড়া যদি বিদেশ থেকে চিকিৎসক আনতে হয় তবে সেটাও করা হবে। মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক দিবস ঘোষণা করা হয়েছে। এ দুর্ঘটনা কেন ঘটলো তা তদন্ত করে বের করা হবে।
নেগেটিভ রক্তের জন্য হাহাকার: বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আহত হয়ে বার্ন ইউনিটে ভর্তি রোগীদের চিকিৎসার জন্য আনার পরপরই রক্তের প্রয়োজন হয়। কিন্তু রক্তদাতার সংকট চলছিল। পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে আহত রোগীদের জন্য রক্তের প্রয়োজন এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজন রক্ত দিতে আসেন। কিন্তু একসময় প্রয়োজনের তুলনায় অধিকসংখ্যক রক্তদাতা চলে আসেন। পরে অধিকসংখ্যক পজেটিভ রক্তদাতা হওয়াতে বার্ন ইউনিট কর্তৃপক্ষ আপাতত রক্তদাতাদের না আসার অনুরোধ জানিয়েছেন। তবে নেগেটিভ রক্তদাতার সংকট চরমে। নেগেটিভ রক্তের জন্য ভলান্টিয়াররা হ্যান্ডমাইক দিয়ে মাইকিং করছিলেন। অনেকে ব্যানার হাতে নিয়ে নেগেটিভ রক্তদাতা খুঁজছিলেন।মানবজমিন

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions