ডেস্ক রির্পোট:- গুম করে ভুক্তোভোগীদের নির্যাতনের জন্য শব্দনিরোধক বিশেষ কক্ষ তৈরি করেছিল র্যাব। যাতে নির্যাতনের সময় ভুক্তোভোগীদের কান্নার শব্দ বাইরে থেকে না শোনা যায়। ভুক্তোভোগীদের ১০ ধরনের শারীরিক নির্যাতন করা হতো। নির্যাতনে শরীরে ক্ষত সৃস্টি হলে ওষুধ ও মলম দেওয়া হতো। এরপর শরীরের দাগ মুছলে তাদের জনসমক্ষে আসামি হিসেবে উপস্থাপন করা হতো।
এসব তথ্য উঠে এসেছে গুম সংক্রান্ত কমিশনের প্রতিবেদনে। আজ মঙ্গলবার বিকেলে গুম সংক্রান্ত কমিশন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুম ও নির্যাতনের প্রাতিষ্ঠানিক দিক উন্মোচন করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে গত বছরের ৫ আগস্টের আগে যে গুমের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল, তার পদ্ধতিগত চর্চা উন্মোচনের চেষ্টা করে কমিশন। গুম করে মানুষকে গোপন বন্দিশালায় মাস ও বছরের পর বছর রাখা হতো। এসব ব্যক্তিদের নির্যাতনের জন্য আলাদা কক্ষ তৈরি করা হয়েছিল। এসব কক্ষগুলো বিশেষ কায়দায় শব্দনিরোধক করে তৈরি করা হতো। নির্যাতনের জন্য সেখানে বৈদ্যুতিক শর্ট দেওয়ার চেয়ার, ঘূর্ণয়মান চেয়ার, হাত–পা বাধার বিশেষ রশি, নখ তুলে ফেলাসহ শারীরিক নির্যাতন করতে বিভিন্ন ষন্ত্র রাখা হতো। এসব কক্ষ র্যাব ও ডিজিএফআই ব্যবহার করতো।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ভুক্তোভোগীদের নির্যাতনের জন্য র্যাব ২–এ সিপিসি ৩–এ বৈদ্যুতিক ঘূর্ণায়মান চেয়ার, টিএফআই সেলে মানুষকে ঝুলিয়ে রাখার জন্য পুলি–সিস্টেম এবং একাধিক স্থানে শব্দনিরোধক কক্ষ তৈরি করেছিল তারা।
গুম সংক্রান্ত কমিশন নির্যাতনের গুম হওয়া মানুষের উপর চালানো নির্যাতনের দশটি দিক তুলে ধরেছে প্রতিবেদনে। সেগুলো হলো:
সর্বব্যাপী অস্বস্তি সৃষ্টি করে রাখা হতো। এসব ব্যক্তিদের প্রহরীদের অর্ধেক খাবার দেওয়া হতো। নিজের ভাগ্যে কী ঘটবে সে কিছুই জানতো না। দীর্ঘ সময় মানসীক যন্ত্রণায় ভুগতেন তারা।
ছোট্ট বন্দিশালায় যেখানে ঘুমতো, সেখানেই টয়লেটের ব্যবস্থা। টয়লেটে বসলেও সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে মনিটরিং করা হতো। বন্দিদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তাও অস্বস্তিকর ও ভীতিকর ছিল।
নারীদের জন্য গোপন বন্দিশালা ছিল আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি। নারীদের গুম করে অনেকটা ক্রুসিফাইডের মতো করে হাত দুই দিকে বেঁধে রাখা হতো। এভাবে শরীরে ওড়নাও রাখতে দিতো না তারা। নারীদের পিরিয়ডের সময় তাদের প্যাড দেওয়া হতো না। উল্টো পুরুষ প্রহরীরা এটা নিয়ে হাসাহাসি করতো। ২০১৮ সালে ২৫ বছর এক নারীকে গুম করে তাকে ২৪ আটকে রাখা হয়েছিল। ওই নারীর বর্ণনায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
অসংখ্য গুম হওয়া মানুষের নির্মম প্রহারের অভিজ্ঞতা আছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গোপন বন্দিশালা থেকে ব্যক্তিদের নির্যাতনের জন্য শব্দনিরোধক কক্ষে নিয়ে যাওয়া হতো। সেখানে কখনো চোখে গামছা বেধে, কখনো জমটুপি পরিয়ে হাত ওপরে বেঁধে বেধড়ক পেটানো হতো।
২০২৩ সালে ডিএমপির সিটিটিসি ৪৭ বছর এক ব্যক্তিকে গুম করে ১৪ দিন গোপন বন্দিশালায় রেখেছিল। ওই ভুক্তোভোগী বলেন, ‘মারধরের সময় একাধিক লোক থাকতো। দুজন তিনজন মিলে পেটাতো। মারতে মারতে বলত, তোর মাংস হাড্ডি আলাদা করে ফেলব।’
নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের শরীরে একাধিক স্থায়ী আঘাতের চিহ্ন দেখতে পেয়েছে কমিশন। ২০১৭ সালের ২৩ বছরের এক যুবককে অপহরণ করে গুম করে র্যাব ১১ এর সদস্যরা। তাকে জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে নিয়ে পা উপরের দিকে ঝুলিয়ে নির্যাতন করা হয়। তার নাভীর দুপাশে নির্যাতনের এখনো দাগ রয়েছে।
ডিএমপির সিটিটিসি নির্যাতনের জন্য চারটি শিফট ভাগ করে নিতেন কর্মকর্তারা। ২০২২ সালে সিটিটিসি ৪৬ বছরের এক ব্যক্তিকে গুম করে ২৫৩ দিন আটকে রেখেছিল। তাকে টানা ২৪ ঘন্টা নির্যাতন করা হয়। এজন্য চারটি শিফটে সিটিটিসির কর্মকর্তারা ভাগ হয়ে নিয়েছিলেন। তাঁর জবানবন্দিতে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
হাত ছাদের সঙ্গে বেঁধে ঝুলিয়ে নির্যাতন, উল্টো করে বেঁধে নির্যাতন করতো র্যাব সদস্যরা। নির্যাতনের একটি কমন বিষয় ছিল নখ তুলে ফেলা। র্যাব সদস্যরা এই কাজটি প্রায়ই করতেন। এ ছাড়াও নখের ভেতরে সুইচ ঢুকিয়ে দিতো, বাঁশ দিয়ে নির্যাতন করত, বিশেষ চেয়ারে বসিয়ে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া, ওয়াটারবেডিং অর্থাৎ মুখের ওপর গামছা দিয়ে ওপর থেকে পানি ছাড়া হতো। এ সময় তিন চারজন টর্চার সেলের মেঝেতে হাত পা দিয়ে চেপে ধরতো। ভুক্তোভোগীদের যৌন হয়রানি করা হতো। কেউ কেউ লজ্জায় কমিশনকে এই ঘটনা বলতে চায়নি, তারপরও কয়েকজন বন্দি এবিষয়ে মুখ খুলেছিল কমিশনের কাছে। বন্দিদের প্রসবের সময় বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হতো।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুম করে গোপন বন্দিশালায় আটকে রাখায় অনেকে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। অনেকের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়েছে মানসিক স্বাস্থ্যে। একজন তরুণকে ২০১৯ সালে গুম করে র্যাব-৩ ও গোয়েন্দা শাখা। তাঁকে ২০ মাস ১৩ দিন গুম করে রাখা হয়। র্যাবের নির্যাতনে তিনি এখন মানসিক অসুস্থতায় ভুগছেন। একাকী হাসছেন, কথা বলছেন এবং কাঁদছেন।
গুম সংক্রান্ত কমিশনের সদস্য নূর খান লিটন বলেন, গুমের সবচেয়ে বেশি অভিযোগ র্যাবের বিরুদ্ধে। তাঁরা গুম করে বিভিন্ন ব্যক্তিকে গোপনে নির্যাতন করতো। এজন্য তাদের অনেক আয়োজন ছিল। নির্যাতনের পর আবার মেডিসিন দেওয়া হতো। যখন সুস্থ হতো–তখন একটি মামলা দিয়ে জনসমক্ষে আনা হতো।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কমিশনের কাছে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৮৫০টি অভিযোগ এসেছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৫০টি অভিযোগ যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। এখনো নিখোঁজ ৩৪৫ জন।আজকের পত্রিকা