রুশ যুদ্ধে শত বাংলাদেশি

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় সোমবার, ৭ এপ্রিল, ২০২৫
  • ১৩ দেখা হয়েছে

রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে ভালো বেতনে চাকরির আশায় ফাঁদে পড়ছেন তরুণেরা।
রাশিয়ায় গিয়ে বাধ্য হয়ে স্বল্প প্রশিক্ষণের পর ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামছেন।
যুদ্ধে তিনজনের প্রাণহানি, আহত কয়েকজন, অনেকের অবস্থান শনাক্ত হয়নি।
এরপরও থামছে না রাশিয়া যাওয়া, ১১ তরুণকে বিমানবন্দর থেকে ফেরত।

ডেস্ক রির্পোট:- বিদেশে ভালো কাজের লোভ দেখিয়ে বাংলাদেশের তরুণদের এবার ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাশিয়ার ভাড়াটে যোদ্ধা বানাচ্ছে মানব পাচারকারীরা। জনপ্রতি মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে তাঁদের সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ হয়ে নেওয়া হচ্ছে রাশিয়ায়। সেখানে জোর করে চুক্তিনামায় সই করিয়ে যোদ্ধা হিসেবে পাঠানো হচ্ছে যুদ্ধে। এ পর্যন্ত অন্তত ১০০ তরুণ এভাবে দেশটিতে গেছেন। তাঁদের মধ্যে তিনজন নিহত ও বেশ কয়েকজনের আহত হওয়ার খবরও এসেছে।

বিষয়টি নজরে আসার পর ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ আন্তর্জাতিক তিন বিমানবন্দরেই নজরদারি বাড়ানো হয়। কিন্তু এরপরও সোনার হরিণ ধরার স্বপ্নে বিভোর তরুণদের যুদ্ধের ফাঁদে পড়া ঠেকানো যাচ্ছে না। গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত রাশিয়াগামী সন্দেহে ১১ তরুণকে ঢাকার বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

তরুণদের দালালদের মাধ্যমে জোগাড় করে রাশিয়ায় পাঠাচ্ছে একাধিক ট্রাভেল এজেন্সি। এক দালালকে গ্রেপ্তারের পর কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্সির ওপর নজরদারি করছে প্রশাসন। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোয় বিশেষ সতর্কতা জারির অনুরোধ করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ইতিমধ্যে ফাঁদে পড়ে রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধে যাওয়া ১০০ তরুণের কয়েকজনের অবস্থান শনাক্ত হলেও বাকিদের খোঁজ নেই। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে আসা ও যুদ্ধাহত কয়েকজন দেশে ফেরার আকুতি জানিয়েছেন পরিবারের কাছে।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ সুপার জসীম উদ্দিন আজকের পত্রিকাকে গতকাল বলেন, রাজধানীর বনানী থানায় একটি মামলার তদন্তের অংশ হিসেবে এক দালালকে গ্রেপ্তার করা হয়, যিনি মানব পাচার চক্রের সদস্য। সন্দেহভাজন আরও দু-একটি ট্রাভেল এজেন্সিকেও নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তিনি জানান, দালালদের এই ফাঁদ থেকে বাঁচতে সাধারণ মানুষকে সচেতন করারও চেষ্টা চলছে।

কূটনীতিক, সিআইডি ও পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) ইমিগ্রেশন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে ভালো বেতনে চাকরির লোভ দেখিয়ে মানব পাচারকারীরা তরুণদের তৃতীয় দেশ হয়ে রাশিয়ায় নিচ্ছে। তাঁরা রাশিয়া গিয়ে চাপের মুখে ভাড়াটে যোদ্ধা বনে যাচ্ছেন। তাঁদের কেউ কেউ ওমরাহ ভিসায় সৌদি আরব, ভ্রমণ ভিসায় সংযুক্ত আরব আমিরাত, তুরস্কসহ তৃতীয় দেশ হয়ে রাশিয়ায় যাচ্ছেন। পরে তাঁদের চুক্তিনামায় সই করিয়ে স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ দিয়ে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে।

একজন পদস্থ কূটনীতিক বলেন, মানব পাচারকারীরা লোভ দেখিয়ে দুবাই, ইস্তাম্বুলসহ বিভিন্ন রুটে রাশিয়ার বিভিন্ন গন্তব্যে তরুণদের নিতে শুরু করেছে, এমন তথ্য গত বছর মে-জুনের দিকে স্বরাষ্ট্র ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু সরকার এ অনুরোধ আমলে নেয়নি। মানব পাচার ঠেকানোর বিষয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। তিনি বলেন, মানব পাচারকারীদের তৎপরতার কথা প্রায় একই সময় মস্কোয় রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও জানানো হয়।

ময়মনসিংহের গৌরীপুরের ইয়াসিন মিয়া শেখ গত বছর দালালের মাধ্যমে রাশিয়ায় গিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধে অংশ নেন। ঈদের পরদিন রাশিয়ায় থাকা এক পরিচিতজনের কাছ থেকে পরিবার জেনেছে, ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইয়াসিন নিহত হয়েছেন। নাটোরের সিংড়ার হুমায়ুন কবীরও নিহত হন। তাঁর ভগ্নিপতি রহমত আলী এখনো রাশিয়ায় আটকে রয়েছেন। পরিবারের দাবি, ওমরাহ ভিসায় সৌদি আরব নেওয়ার কথা বলে তাঁদের রাশিয়ায় নেওয়া হয়। সেখানে জোর করে প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধে পাঠানো হয়।

রহমত আলীর স্ত্রী যমুনা বেগম দাবি করেন, রহমত ও হুমায়ুনকে রাশিয়ায় আড়াই লাখ টাকা বেতনে মালি ও কুকের চাকরির লোভ দেখানো হয়। দুজনের জন্য ১৮ লাখ টাকা জমা দিতে বললে তাঁর স্বামী ও ভাই জমি বিক্রি করে একটি প্রতিষ্ঠানে (ট্রাভেল এজেন্সি) ১৮ লাখ টাকা জমা দেন। তবে ২০২৪ সালের ১৮ অক্টোবর রহমত আলী ও হুমায়ুন কবীরকে ওমরাহ ভিসা করে দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, সৌদি আরবে ওমরাহ শেষে তাঁদের রাশিয়া নেওয়া হবে। সৌদি আরবে তাঁদের দুই মাস রেখে রাশিয়ায় নেওয়া হয়।

যমুনা বেগম বলেন, রাশিয়ায় সেনানিবাসে নিয়ে তাঁর স্বামী ও ভাইকে জোর করে চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করিয়ে ২০ দিন যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরিবারের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে তাঁরা বারবার বাঁচানোর আর্তি জানান। তাঁর স্বামীই চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি ইউক্রেনের ড্রোন হামলায় হুমায়ুন নিহত হওয়ার খবর পরিবারকে জানান।

যশোরের জাফর হোসেনকে সাইপ্রাসে ভালো কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ৯ লাখ টাকা নিয়ে সৌদি আরব, দুবাই হয়ে রাশিয়ায় পাঠানো হয়। তিনি এখন যুদ্ধক্ষেত্রে আটকা পড়েছেন। প্রাণ নিয়ে সংশয়ের কথা জানিয়েছেন পরিবারকে।

সিআইডি জানায়, বনানী থেকে তামান্না নামের এক নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁরা জেনেছেন, তিনি ‘ড্রিম হোম ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস লিমিটেড’ নামের এজেন্সির অংশীদার এবং পাচারকারী চক্রের সদস্য। তাঁরা ১০ জনকে ওমরাহ ভিসায় সৌদি আরব পাঠিয়ে পরে রাশিয়ায় বিক্রি করে দেন। সেখান থেকে সুলতান নামের একজন তাঁদের রুশ সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেন। এই চক্রের কাছ থেকে পালিয়ে দেশে ফিরেছেন আকরাম হোসেন। তিনি যুদ্ধাহত আমিনুল ইসলামের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে বনানী থানায় মামলা করতে সহায়তা করেন।

আমিনুল ইসলামের স্ত্রী ঝুমু আক্তার আজকের পত্রিকাকে বলেন, তাঁর স্বামীকে যুদ্ধ করতে বাধ্য করেছে। তিনি যুদ্ধে আহত হয়ে পড়ে আছেন। সেখানে আরও বাংলাদেশি আছে। কিন্তু দেশে সেভাবে কোনো সহায়তা পাচ্ছেন না। কী করা উচিত বুঝতেও পারছেন না। তাঁর দাবি, এজেন্সিগুলো মিথ্যা বলে তাঁদের রাশিয়া পাঠিয়েছে।

বনানীর ৪ নম্বর সড়কের একটি বাড়ির নিচতলার দুটি কক্ষ নিয়ে ‘ড্রিম হোম ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস লিমিটেড’-এর কার্যালয়। প্রতিষ্ঠানের মালিক এম এম আবুল হাসান কয়েক মাস ধরে কার্যালয়ে আসেন না বলে জানান ভবনের নিরাপত্তাকর্মী মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে লোক পাঠানোর বিষয়ে শহীদুল্লাহ বলেন, যাঁরা গেছেন, তাঁরা সব জেনেশুনেই গেছেন। শুনেছেন, ওখানে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর তাঁদের ২০ লাখ টাকা করে দেওয়া হবে। প্রতি মাসে পরিবারের ভরণপোষণের জন্য টাকা পাঠানো হবে। এসব কথায় লোভে পড়েছেন অনেকে। তিনি শুনেছেন, কেউ কেউ নাকি প্রশিক্ষণ শেষে বাড়িতে টাকাও পাঠিয়েছেন।

পুলিশের বিশেষ শাখার ইমিগ্রেশন বিভাগ জানায়, ভালো বেতনে চাকরির লোভ দেখিয়ে রাশিয়ায় নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানোর এবং হতাহতের খবর শুনেও কিছু তরুণ বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে রাশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করছেন। জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত সন্দেহভাজন ১১ জন তরুণকে বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। রাশিয়ায় এমন শতাধিক তরুণ থাকতে পারেন বলে তাঁরা জেনেছেন।

ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, অভিবাসন বা মানব পাচার নিয়ে একাধিক সংস্থা কাজ করলেও কেউ দায় নিচ্ছে না। পুরো প্রক্রিয়াকে এক প্ল্যাটফর্মে এনে নেতৃত্ব নির্ধারণ করা জরুরি। শুরুতে এটি হলে এই শতাধিক তরুণ জীবনযুদ্ধে আটকা পড়তেন না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার অনেক নাগরিককেও যুদ্ধের জন্য মানব পাচারকারীরা রাশিয়া নিয়ে গেছে।

রুশ সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিদেশিরা বেতনের বিনিময়ে যুদ্ধে যেতে চাইলে রাশিয়া লিখিত চুক্তির আওতায় নিয়োগ দেয়।

মস্কোয় বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত মো. ফয়সাল আহমেদ আজকের পত্রিকাকে গতকাল বলেন, বাংলাদেশের যাঁরা যুদ্ধে গেছেন, তাঁদের ফেরত পাঠানোর জন্য রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কূটনৈতিক পত্র দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে তৎপরতা চলছে।

সংশ্লিষ্ট অন্য একজন কর্মকর্তা বলেন, যাঁরা আটকা পড়েছেন, তাঁদের দেশে ফেরানোর প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি। বরং যাঁরা রাশিয়ায় আসার চেষ্টা করছেন, তাঁদের সচেতন করা জরুরি।

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions