ডেস্ক রির্পোট:- ছয়টি বিষয়ে গঠিত সংস্কার কমিশনের সুপারিশে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মতামত জমা দিয়েছে বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। গতকাল বিএনপি ও এনসিপি তাদের মতামত জমা দিয়েছে। এসব মতামতে বিভিন্ন বিষয়ে একমতের সঙ্গে এসেছে নানা বিষয়ে ভিন্নমত। এ ছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে দলগুলোর পক্ষ থেকে বিপরীতধর্মী মতামতও এসেছে। দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ এবং সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের বিষয়ে দলগুলো ভিন্ন ভিন্ন মতামত দিয়েছে।
সব দলের মতামত পাওয়ার পর তা পর্যালোচনা করে জাতীয় ঐকমত্যের সুপারিশ চূড়ান্ত করবে এ সংক্রান্ত কমিশন। গতকাল জমা দেয়া দলীয় মতামতে বেশ কিছু বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ করেছে বিএনপি। ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে ১৯৭১ সাল এবং ২০২৪ সালকে এক কাতারে আনার বিষয়ে বিএনপি ভিন্নমত পোষণ করেছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় নাম পরিবর্তনের প্রস্তাবেও সায় দেয়নি দলটি। বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে প্রায় সব প্রস্তাবে বিএনপি একমত। ৩১ দফা সুপারিশের মধ্যে চার-পাঁচটি বিষয়ে মতামত দেয়া হয়েছে। বিএনপি বলছে, অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংশোধনী দিয়ে নির্বাচন কমিশনের হাতে ডিলিমিটেশনের এখতিয়ার রাখা হোক। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কার নিয়ে ২০টি সুপারিশের ১১টিতে একমত দলটি। একটি প্রস্তাবে মন্তব্যসহ ভিন্নমত পোষণ করেছে দলটি। প্রশাসন সংস্কারে প্রায় অর্ধেক প্রস্তাবে একমত বিএনপি। ২৬টি প্রস্তাবনার মধ্যে অর্ধেকে নিজস্ব মতামত দিয়েছে দলটি। এদিকে ৫টি বিষয়ের ওপর সংস্কার প্রস্তাব জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে জমা দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। সংবিধানের মূলনীতিতে আল্লাহর প্রতি অবিচল ঈমান-আস্থা ফিরিয়ে আনতে মত দিয়েছে জামায়াত। দলটির সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে সংস্কার প্রস্তাব জমা দেয়া হয়। দলটি সংবিধান, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন প্রক্রিয়া ও দুর্নীতি দমন কমিশনের বিষয়ে কিছু পয়েন্টে দ্বিমত করেছে। দলটি বলছে, নির্বাচন কমিশনের যারা কর্মকর্তা, রিটার্নিং ও প্রিজাইডিং অফিসার যারা রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ থাকতে পারেন না তাদের এড়াতে বলা হয়েছে। দলটি পিআর বা সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন চায়। সংবিধানে সাম্য, গণতন্ত্র, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছে জামায়াত। ন্যাশনাল কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিলের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত নয় দলটি। দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের সঙ্গে একমত হলেও পুরাপুরি একমত নয় দলটি। তারা এ বিষয়ে বিস্তারিত মতামত দিয়েছে।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে জামায়াত আস্থাভোট, বাজেট সম্পর্কে ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কীভাবে দায়িত্ব পালন করবে সে ব্যাপারে মতামত দিয়েছে। জামায়াত জাতীয় নির্বাচনের আগে গণপরিষদ নির্বাচন চায় না।
ওদিকে রাষ্ট্রসংস্কার প্রশ্নে নিজেদের মতামত জানানোর পাশাপাশি ঐকমত্য কমিশনের কাছে তিনটি বিষয় জানতে চেয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। রোববার জাতীয় সংসদের এলডি হলে ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজের কাছে দলটি নিজেদের লিখিত মতামত হস্তান্তর করে। কমিশনের ১৬৬টি সুপারিশের মধ্যে ১১৩টির পক্ষে মত দিয়েছে দলটি। ২৯টি প্রস্তাবে আংশিকভাবে একমত এবং ২২টি প্রস্তাবের বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ করে দলটি। পুলিশ সংস্কার কমিশন ও স্থানীয় সরকার কমিশনের সুপারিশ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে না পাঠানোর কারণও জানতে চেয়েছে এনসিপি।
এনসিপি দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদদের বিষয়ে একমত পোষণ করেছে। তবে তারা বলেছে, নির্বাচনের আগেই উচ্চকক্ষের প্রার্থী কারা, তা দলগুলোকে ঘোষণা করতে হবে। এনসিপি বলেছে, অন্তর্বর্তী সরকার হতে হবে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার। তাদের মেয়াদ ৭০ থেকে ৭৫ দিন হতে পারে।
কমিশনে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)। কমিশনের ১৬৬টি প্রস্তাবের মধ্যে ৪২টি প্রস্তাবের সঙ্গে এলডিপি একমত নয় বলে জানিয়েছে। দুটো প্রস্তাবের সঙ্গে আংশিকভাবে একমত। দুটি প্রস্তাবের বিষয়ে তারা এখনো স্পষ্ট নয়। গত বৃহস্পতিবার এলডিপি নিজেদের মতামত জমা দিয়েছে।
এদিকে খেলাফত মজলিশ গণপরিষদের পক্ষে নয়। তারা ৪০০ আসনে নারীদের সরাসরি ভোটে নির্বাচনের প্রস্তাব দেয়। সংসদের মেয়াদ তারা পাঁচ বছর চায়। এ ছাড়া উচ্চকক্ষে (সিনেটে) সংখ্যালঘুদের ১ শতাংশ ভোটের ভিত্তিতে আসন বণ্টনের মতামত দিয়েছে। সংবিধানে মহান আল্লাহর প্রতি আস্থা বিশ্বাস রাখতে মতামত দিয়েছে দলটি।
শনিবার জমা দেয়া মতামতে লেবার পার্টি ১৪৭টি সুপারিশে একমত হয়েছে, সাতটিতে মতপার্থক্য আছে বলে জানিয়েছে। ১২টিতে আংশিকভাবে সম্মত হয়েছে। দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের পক্ষে মত দিলেও দেশকে চারটি প্রদেশে ভাগ করার বিপক্ষে মত দেয়া হয়েছে। গতকাল মতামত জমা দিয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। জরুরিভিত্তিতে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে দলটি। ব্যাপক আলোচনার মাধ্যমে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে ব্যাপক সংস্কার চালানোর পক্ষে মত দিয়েছে দলটি।
সংস্কার কমিশনে প্রস্তাব জমা দিয়েছে জমিয়তে ওলামা ইসলাম বাংলাদেশ, এবি পার্টি, জাকের পার্টি, ভাসানী অনুসারী পরিষদ, এনডিএম ও আমজনতার দলসহ আরও কয়েকটি দল। এসব দলও নিজস্ব মতামত তুলে দিয়েছে কমিশনের হাতে।
অনেক সুপারিশে দ্বিমত জানিয়ে বিএনপি’র মতামত পেশ
রাষ্ট্র সংস্কারে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ১৬৬টি প্রশ্নমালার যে স্প্রেডশিট পাঠিয়েছে তার মধ্যে অনেক সুপারিশে দ্বিমত পোষণ করেছে বিএনপি। এরমধ্যে দুর্র্নীতি দমন কমিশন সংস্কারের স্প্রেডশিটে ২০টির মধ্যে ১১টিতে সরাসরি একমত, ৭ থেকে ৮টিতে মন্তব্যসহ নীতিগতভাবে একমত হয়েছে এবং একটি প্রস্তাবে ভিন্নমত পোষণ করেছে দলটি। প্রশাসন সংস্কার কমিশনের ২৬টি বিষয়ে প্রস্তাবনা আছে, সেখানে প্রায় অর্ধেক বিষয়ে একমত এবং বাকি অর্ধেক বিষয়ে নিজস্ব মতামত-মন্তব্য জুড়ে দিয়েছে দলটি।
এ ছাড়া সুপারিশে ১৯৭১ ও ২০২৪ সালকে এক কাতারে আনা হয়েছে। এটি সমুচিত বলে মনে করে না বিএনপি। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় নাম পরিবর্তন করার প্রয়োজন আছে বলেও মনে করে না দলটি। ওদিকে দলটি নির্বাচন সংক্রান্ত সংস্কার কমিশন সম্পর্কে বলছে, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ক রিপোর্টে ২৭টার মতো প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এতে অধিকাংশ প্রস্তাব সংবিধান সংশোধনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। নির্বাচন কমিশন কিংবা নির্বাচন ব্যবস্থা সংক্রান্ত রিপোর্টে কিছু কিছু বিষয়ে সংবিধানের সংশ্লিষ্টতা আছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, নির্বাচনী সংস্কার নির্বাচন কমিশনের কাজ নয়। সেই বিষয়ে সংবিধান সংস্কার বিষয়ক রিপোর্টে মতামত দিয়েছে বিএনপি। রোববার জাতীয় সংসদে ঐকমত্য কমিশনের কো-চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী রীয়াজের কাছে বিএনপি’র মতামত জমা এবং কমিশনের সঙ্গে আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের কাছে এসব কথা বলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, আমরা আজকে ৫টা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের ওপরে বিএনপি’র পক্ষ থেকে আমাদের মতামত তারা যে স্প্রেডশিট আমাদেরকে দিয়েছেন, সেটা এবং বিস্তারিত মতামত তার ওপরে দুইটিই একসঙ্গে দিয়ে এসেছি। অন্যগুলো কয়েকদিন পরে বিস্তারিত মতামত দেবো। প্রায় যেগুলোতে একমত হওয়া উচিত সেগুলোতে একমত হয়েছি। আর যেগুলো আমাদের ভিন্নমত দেয়া প্রয়োজন, সেগুলোতে আমরা মতামত সহকারে দিয়েছি। মোটামুটি আমরা পুরোপুরি সহযোগিতার মধ্যে আছি।
বেলা ১টায় সংসদ ভবনের এলডি ভবনে সালাহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কো-চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী রীয়াজের কাছে বিএনপি’র মতামত হস্তান্তর করেন। এ সময়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিহউল্লাহ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান ছিলেন। ঐকমত্য কমিশনের কো-চেয়ারম্যানের সঙ্গে সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান ও প্রধান উপদেষ্টা বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন।
সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশের বিষয়ে মতামত চেয়ে গত ৬ই মার্চ বিএনপিসহ ৩৭টি রাজনৈতিক দলকে ‘চিঠি ও স্প্রেডশিট’ পাঠিয়েছিল ঐকমত্য কমিশন। ১৩ই মার্চের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত জানাতে বলা হয়। রোববার পর্যন্ত ১৬টি রাজনৈতিক দল তাদের মতামত জমা দেয়।
একাত্তর আর ’২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান এক হতে পারে না: সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, উনারা একাত্তর সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে একই কাতারে ২০২৪ সালে গণ-অভ্যুত্থানকে নিয়ে এসেছেন যেটা আমরা মনে করি সমীচীন নয়। ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের অংশটি সংবিধানের অন্য জায়গায় কীভাবে চতুর্থ তফসিল যুক্ত করা যায় সেটা পরে আলোচনা করা যায়। এখানে সরকারের কোনো লেজিটেমেসির অভাব আছে বলে আমরা মনে করি না। এই সরকার সাংবিধানিকভাবেই গঠিত হয়েছে, আর্টিকেল ১০৬ অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের মতামতের ভিত্তিতে এডভাইজারি রোল হিসেবে যেটা আছে সেটার ভিত্তিতে এই সরকার শপথ গ্রহণ করেছে।
তিনি বলেন, আমরা সবাইকে যুক্ত করেই এই রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে সাজাতে চাই, বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় কাঠামোগুলো সংস্কার করতে চাই, একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নির্মাণের জন্য বৈষম্যহীন একটি সত্যিকার সুশাসন ও ন্যায়বিচার ভিত্তিক বাংলাদেশ গঠনের জন্য। যেখানে সবারই মর্যাদা থাকবে সাম্য থাকবে। গণপরিষদ ও গণভোট নির্বাচন নয়: সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, গণপরিষদ নিয়ে অনেক বক্তৃতা দিয়েছে। নতুন রাষ্ট্র হয়েছে সেখানে সংবিধান রচনা করা দরকার, রাষ্ট্রের সংবিধান নাই সেজন্য সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে প্রতিনিধিত্ব আকারে গণপরিষদ গঠন করা হয়, সেটা নির্বাচনের মাধ্যমে হতে পারে, সিলেকশনের মাধ্যমেও হতে পারে। সেই গণপরিষদ একটা সংবিধান প্রণয়ন করে এবং সেটা গৃহীত হওয়ার পরে সংবিধানের ভিত্তিতে সংসদ নির্বাচন হয়। এখানে আমাদের রাষ্ট্র কি নতুন হয়েছে? আমাদের রাষ্ট্র পুরাতন রাষ্ট্র ৫৩/৫৪ বছর। আমাদের একটা সংবিধান আছে, সেই সংবিধানের হয়তো গণতান্ত্রিক চরিত্র বিনষ্ট হয়েছে তার সঙ্গে আমরা একমত নই। যার জন্য রাষ্ট্র কাঠামো ও গণতান্ত্রিক কাঠামো নির্মাণ করা দরকার নতুনভাবে। সেই জন্য আমরা সংবিধানের ব্যাপক সংশোধনী এনেছি, যারা গণপরিষদ দাবি করছে তারাও ৬৯টা প্রস্তাব দিয়েছে সংশোধনের জন্য আমরা একটু কম দিয়েছি। এগুলো আলোচনা করে আমরা একটা বৃহত্তর ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধানের একটা ব্যাপক সংশোধিত সংবিধান পেতে পারি। সেই সংবিধানকে তারা নতুন সংবিধান বলতে পারে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। এখানে গণপরিষদের কোনো প্রয়োজন নেই।
তিনি বলেন, সংশোধিত সংবিধানকে তারা নতুন নামে ‘রিপাবলিক’ বলতে পারে আমাদের তো আপত্তি নাই। কিন্তু তাদের সেই আইডিয়াটা পুরো জাতির উপরে চাপিয়ে দেয়াটা কতোটা যুক্তিসঙ্গত সেটার দাবি রাখে। সালাহউদ্দিন বলেন, গণভোটের বিধান তো আছে সংবিধানের ১৪২ আর্টিকেলে। সেখানে বলা আছে, আর্টিকেল ৮, ৪৮, ৫৬, ১৪২ ইটসেলফ। এগুলো যখন সংশোধিত হবে তখন গণভোটের প্রয়োজন হবে। যদি নতুন সংবিধানে আলাপ-আলোচনার মধ্যদিয়ে আরও কোনো প্রভিশন যদি এই গণভোটের অধীনে নিয়ে আসা হয় সেটা তখন দেখা যাবে। সেই সমস্ত ক্ষেত্রে গণভোটের কথা আসতে পারে।’ আমরা মনে করি, এখন সংসদ নির্বাচন করা উচিত। গণভোট নির্বাচন নয়। আমরা মনে করি, আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যদিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে একটি রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা হলে সমস্ত আলাপ-আলোচনা সংসদে হতে পারবে।
বিএনপি’র মতামতসমূহ:
দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার: সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, স্প্রেডশিটে ২০টির মতো প্রস্তাবনা সুপারিশ ছিল। ২০টার মধ্যে আমরা ১১টিতে সরাসরি একমত আর ৭/৮টাতে মন্তব্যসহ নীতিগতভাবে একমত হয়েছি। শুধুমাত্র একটি প্রস্তাবে আমরা ভিন্নমত পোষণ করেছি। কারণ ওখানে একটা আইন সংশোধনের বিষয় রয়েছে, আয়কর সংক্রান্ত।
প্রশাসন সংস্কার কমিশন: সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এখানে ২৬টা বিষয়ে প্রস্তাবনা আছে। সেখানে আমরা এর প্রায় অর্ধেক বিষয়ে একমত। আর বাকি অর্ধেক বিষয়ে আমাদের মতামত-মন্তব্য আছে, বিস্তারিত আলাপ-আলোচনায় একটা জায়গায় আসা যাবে। এসব প্রস্তাবনার মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, কর্মকর্তাদের সচিব পদোন্নতির জন্য পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন স্টেইজ থেকে, সেখানে বিদ্যমান এসএসবি বাতিলের একটা সুপারিশ করা হয়েছে। এর সঙ্গে আমরা একমত নই। তার পরিবর্তনে মন্ত্রিপরিষদ কমিটি করার একটা প্রস্তাব করা হয়েছে। আমরা মনে করি, এর মধ্যদিয়ে প্রশাসনে রাজনীতিকরণ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সেজন্য আমরা দ্বিমত পোষণ করেছি। আরেকটা বিষয় পদোন্নতির ক্ষেত্রে যে প্রস্তাবনা দেয়া আছে, সে বিষয়ে আদালতের রায় আছে। আদালতের রায় বহাল থাকা অবস্থায় এ বিষয়ে আমরা কোনো মন্তব্য করতে চাইনি। আমরা স্টেটাসকো (স্থিতিবস্থা) রাখা বাঞ্ছনীয় মনে করি।
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন: কমিশনের প্রায় সকল প্রস্তাবের সঙ্গে আমরা একমত। যেহেতু আপনারা জানেন যে, আমরা আমাদের ৩১ দফা প্রস্তাবের মধ্যে বিচার বিভাগের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার জন্য অনেকগুলো প্রস্তাব আমরা ওখানে দিয়েছিলাম। তার মধ্যে অধস্তন আদালতের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের জন্য অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ সুপ্রিম কোর্টের হাতে ন্যস্ত করার জন্য সংবিধানের আর্টিকেল ১১৬ আমরা পরিবর্তন বা সংশোধনের সুপারিশ করেছিলাম। যাতে করে বর্তমানে সংবিধানের বিদ্যমান প্রভিশন তাতে বলা আছে যে, প্রেসিডেন্ট করবে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে। এখানে প্রধান বিচারপতিকে প্রধান করে আমরা পূর্ণাঙ্গভাবে অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের হাতে রাখতে চাই সেটা আমাদের প্রস্তাব। যাতে করে সুপ্রিম কোর্টের আলাদা একটি সেক্রেটারিয়েট হবে সেই প্রস্তাবের সঙ্গে আমরা একমত। আর্থিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে পরবর্তিতে বাজেটে কি হবে না হবে সেটা বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে সেটা আমরা মন্তব্যে দিয়েছি।
সালাহউদ্দিন বলেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আপনারা জানেন সেটা অলরেডি পঞ্চদশ সংশোধনী মামলায় হাইকোর্টের রায়ে এটা বহাল হয়েছে এবং সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে আদলে লোয়ার জুডিশিয়ারির জন্য লোয়ার জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব করেছি। যাতে একটা জবাবদিহিতা থাকে নিম্ন আদালতের জন্য। এখানে সেক্রেটারিয়েট প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে লোয়ার জুডিশিয়ারির জবাবদিহিতা কতোটুক নিশ্চিত কীভাবে করা যাবে সেটা সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির সঙ্গেও আলোচনা করার প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি। বিচার বিভাগের যেসব প্রস্তাবনা তারা দিয়ে তার সবগুলোর সঙ্গে আমরা একমত এবং আমাদের নিজস্ব অভিমতও আছে। বিচার বিভাগের ৪/৫টি বিষয়ে একটু মন্তব্য সহকারে মতামত দিয়েছি।
নির্বাচন সংক্রান্ত সংস্কার কমিশন: সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ক রিপোর্টে দেখা যায় উনারা ২৭টার মতো প্রস্তাব দিয়েছেন। তাতে অধিকাংশ প্রস্তাব সংবিধান সংশোধনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আমরা ঠিক বুঝতে পারেনি যে, নির্বাচন কমিশন কিংবা নির্বাচন ব্যবস্থা সংক্রান্ত রিপোর্টে কিছু কিছু বিষয়ে সংবিধানের সংশ্লিষ্টতা আছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, নির্বাচনী সংস্কার নির্বাচন কমিশনের কাজ নয়। আমরা সেই বিষয়ে সংবিধান সংস্কার বিষয়ক রিপোর্টে মতামত দিয়েছি।
তিনি বলেন, একটি বিষয়ে আমাদের মতামত পজেটিভলি দিয়েছি। কিন্তু নির্বাচন অনুষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কমিশন, এই ইসি’র ক্ষমতাকে খর্ব করার জন্য সংস্কার কমিশন কিছু প্রস্তাব দিয়েছে। যেগুলো আমরা মনে করি, নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতার ওপরে হস্তক্ষেপ। যেগুলো আমরা মনে করি নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারের মধ্যে থাকা দরকার। যেমন এনআইডি, এটা যদি আলাদা কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে দেয়া হয় তাহলে ইসিকে বারবার এনআইডি বিষয়ে সহযোগিতার জন্য অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে যেতে হবে। তার চাইতে বর্তমানে যে বহাল আছে, অবশ্য একটা আইন আছে যেটা আওয়ামী লীগের আমলে করেছে যে, এনআইডি’র কার্যক্রম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, আইনটি এখনো বাতিল করা হয়নি, বাতিলের জন্য বিবেচনাধীন ছিল। আমরা মনে করি, এই আইনটি বাতিল করে এনআইডি’র কার্যক্রম পুরোটাই নির্বাচন কমিশনের হাতে রাখা উচিত।
সীমানা নির্ধারণও নির্বাচন কমিশনের কাছে রাখা উচিত বলে বিএনপি মনে করে বলে জানিয়ে সালাহউদ্দিন বলেন, সীমানা নির্ধারণ ইসি’র আইন আছে এবং সাংবিধানিক এখতিয়ার। নির্বাচন কমিশনের সেই আইনে সামান্য একটা প্রিন্টিং মিসটেক ছিল সেটা আমরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে দিয়েছিলাম, আইন মন্ত্রণালয় সেটা গিয়েছে কিন্তু এখনো সংশোধন হয়নি। না হওয়ার কারণ ইসি এখনো ডিলিমিটেশন সংক্রান্ত কোনো শুনানি করতে পারছে না। তার ফলে নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে কিছুটা জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। আমরা সরকারকে আহ্বান জানাবো যে, অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংশোধনীটা দিয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে সীমানা নির্ধারণের ক্ষমতা রাখা হোক। আলাদা কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে রাখার বিষয়টা আমরা নাকচ করছি।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, নির্বাচন কমিশনের দায়বদ্ধতার জন্য সংসদীয় কমিটির কাছে জবাবদিহিতা করতে হবে বলে কমিশনের একটা সুপারিশ আছে। তাতে আমরা মনে করি নির্বাচন কমিশনে বর্তমানে যারা আছেন এবং ভবিষ্যতে যারা আসবেন তারা তাদের দায়বদ্ধতার জায়গাটা পার্লামেন্টের স্ট্যান্ডিং কমিটির কাছে না রেখে বিদ্যমান যে ব্যবস্থা আছে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের আওতাধীন আছে, যে একজন সুপ্রিম কোর্টের বিচারক যে প্রক্রিয়ায় অপসারিত হয় সেই একই প্রক্রিয়ায়টা নির্বাচন কমিশন এবং দুই-একটা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যেটা সংবিধানের আর্টিক্যাল ৯৬-এ বলা আছে সেই হিসেবে এবং আরও বড় অথোরিটির কাছে দায়বদ্ধতা আছে সেখানে সংসদীয় কমিটির কাছে নেয়াটা অনেকটা রাজনৈতিক বলে আমরা মনে করি। সেখানে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা রাখাটা উচিত বলে মনে করছি না আমরা।
সংবিধান সংস্কার কমিশন: সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন. স্প্রেড শিটে উনারা সংবিধানের প্রস্তাবনা উল্লেখ করে নাই। সংবিধানের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্রস্তাবনা যেটা প্রিয়াম্বল নামে আমরা চিনি সেটা পুরোপুরি সংশোধনের বা পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। অনেকটা রিরাইটিংয়ের মতো। সেখানে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানকে এক কাতারে নিয়ে আসা হয়েছে যেটা সমুচিত বলে আমরা মনে করি না। এটাকে অন্য জায়গায় রাখার বা তফসিল অংশে রাখার বা স্বীকৃতি দেয়ার বিভিন্ন রকমের সুযোগ আছে সেটা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আমরা পরে প্রকাশ করবো। কিন্তু সেই প্রিয়াম্বলটা আমরা চাই। যেটা অষ্টাদশ সংশোধনীর পূর্বাবস্থা যেটা পঞ্চম সংশোধনীর পরে গৃহীত হয়েছিল বাংলাদেশের জনগণের সকল অভিপ্রায় হিসেবে সেইটা বহাল থাকা উচিত।
তিনি বলেন, সুপারিশে উনারা শুরু করেছেন রিপাবলিক দিয়ে, রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তন দিয়ে যেটাকে প্রজাতন্ত্র না বলে জনগণতন্ত্র বা নাগরিকতন্ত্র বা পিপলস রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ এর ক্ষেত্রে বাংলায় বলছেন যে, জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ, বাংলায় উনারা নাগরিকতন্ত্র এবং জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ লিখতে চান। সেটা কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না। দীর্ঘদিনের প্র্যাকটিসের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের নাম মেনে নিয়েছে। এখন বিষয়টা নিয়ে যে আসলে কতোটুকু কি অর্জন হবে সেটা প্রশ্নের দাবি রাখে। আমরা এ বিষয়ে একমত নই। তাছাড়া মৌলিক অধিকার এবং মূলনীতির ক্ষেত্রে উনার ব্যাপক পরিবর্তনের একটা প্রস্তাব ওখানে রেখেছেন। আমরা প্রস্তাব করেছি যে, বর্তমানে সংবিধানিক ধারাগুলো আছে, অনুচ্ছেদগুলো আছে তার মধ্যে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের প্রস্তাব অনুসারে মূলনীতির মধ্যে যেসব প্রস্তাব আছে তার হয়তো সংশোধনী আনা যায় কিন্তু আমরা দলের পক্ষ থেকে পঞ্চদশ সংশোধনীর পূর্বাবস্থায় বহাল রাখার জন্য প্রস্তাব করেছি।
‘মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতা’ নামে আলাদা চাপ্টার সংযুক্ত করার জন্য সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে তিনি বলেন, যেটা আসলে অনেকটা আমরা মনে করি যে, অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে হয়তো যাদের পার্লামেন্টের এক্সপেরিয়েন্স বা রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে অভিমত আসতে পারে বা দিয়ে থাকতে পারেন। মৌলিক অধিকার রাষ্ট্রকে নিশ্চিয়তা বিধান করতে হবে.. সেজন্য মৌলিক অধিকারের সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটগুলো সীমিত। এ ছাড়া সোশ্যাল কালচারাল ইকোনমিক রাইটগুলো সেগুলো রাষ্ট্রের সক্ষমতার ওপরে ভিত্তি করে গুড গভার্নেন্সের ওপরে ছেড়ে দিতে হয়, সেই জায়গায় উনার জিনিসটা একটু মিলিয়ে ফেলেছেন, এমালগেমেট করে ফেলেছে.. সেটা আমরা আশা করি আলোচনার সময়ে বুঝাতে সক্ষম হবো।
সালাহউদ্দিন বলেন, নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ- এখানে উনার যেসমস্ত প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন এবং যেগুলো কমিশনের কথা বলেছেন, বিশেষ করে ন্যাশনাল কন্টিটিউশনাল কাউন্সিল গঠন করে কিছু অনির্বাচিত ব্যক্তিদের, এবং প্রাতিষ্ঠানিক প্রধানদের এখানে মেম্বার করে যেসমস্ত এখতিয়ার, গঠন এবং ধরন কার্যাবলীর প্রস্তাব করা হয়েছে তাতে করে দেখা যাবে যে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের আর কোনো গুরুত্ব থাকে না। রাষ্ট্র নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হবে এটা সংবিধানের মূল চেতনা সেই জায়গায় এটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আমরা মনে করি।
দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের বিষয়ে উচ্চ কক্ষের আসন ও মনোনয়ন প্রক্রিয়া নিয়ে কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গেও ভিন্নমত পোষণ করেছেন বলে জানান সালাহউদ্দিন। মহিলাদের সংসদীয় আসন সংখ্যা ৫০ থেকে ১০০ করার প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হলেও মনোনয়ন প্রক্রিয়ার বিষয়ে কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে ভিন্নমতের কথাও বলেন তিনি। সালাহউদ্দিন বলেন, সংবিধানের প্রায় শতাধিক প্রস্তাবের মধ্যে এখানে স্প্রেড শিটে ৫৭টা এসেছে। সেই জায়গায় বিস্তারিত প্রতিবেদন আমরা যুক্ত করেছি। পুরো পুস্তকটাতে তাদের সুপারিশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সেগুলো এক জায়গায় এসে বিস্তারিত প্রতিবেদন দেবো- অন্যান্য কয়েকটি কমিশনের প্রস্তাবের প্রতিবেদন আমরা কয়েকদিন পরে দেব বলে উনাদের জানিয়েছি।
১১৩টিতে সম্পূর্ণ, ২৯টিতে আংশিক একমত এনসিপি
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের স্প্রেডশিটে সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ যে ১৬৬টি সুপারিশ রয়েছে তার মধ্যে ১১৩টিতে পুরোপুরি একমত বলে জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি। এ ছাড়া ২৯টি প্রস্তাবে আংশিক একমত এবং ২২টি প্রস্তাবের ব্যাপারে একমত হতে পারিনি দলটি। সবমিলিয়ে ১৪২টি প্রস্তাবে সম্পূর্ণ ও আংশিক একমত হয়েছে ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন এনসিপি। গতকাল দুপুরে জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে সংস্কার নিয়ে নিজেদের লিখিত মতামত জমা দিয়ে দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সংস্কার সমন্বয় কমিটির কো-অর্ডিনেটর সারোয়ার তুষার বলেছেন, অনেকগুলোর ক্ষেত্রে আমরা একমত হয়েছি আবার পাশের ঘরে মন্তব্য করেছি।
তিনি বলেন, আংশিক মন্তব্যের ক্ষেত্রেও আমরা আংশিকে টিক দিয়ে পাশে মন্তব্য লিখেছি। যেগুলোতে একমত নই- কেন নই, পাশে যে অল্প জায়গাটুকু রয়েছে তার মধ্যে লিখেছি। সামনে যখন আমরা বসবো, তখন বিষয়গুলো আরও বিস্তারিত বলবো। জরুরি বিষয়গুলো হলো, রাষ্ট্রভাষা বাংলা এ ব্যাপারে আমাদের আপত্তি নেই। কথাটা দাপ্তরিক ভাষা হওয়া উচিত। দাপ্তরিক ভাষা এক বা একাধিক হবে কিনা সেটা অন্য আলোচনার বিষয়। বিদ্যমান সংবিধানে দুই রকম করে আছে জনগণ বাঙালি, আর নাগরিকরা বাংলাদেশি। এটাকে তারা বলেছেন বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাংলাদেশি বলিয়া বিবেচিত হবে। এটার সঙ্গে আমরা একমত হয়েছি। পাশাপাশি মন্তব্য করেছি বাংলাদেশে বিভিন্ন যে জাতিসত্তা রয়েছে তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি থাকতে হবে। মৌলিক অধিকারের বিষয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগ মিলে মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা নামকরণ করেছেন এটাতে আরও থাকা উচিত প্রাণ প্রকৃতি সুরক্ষা। এটা মৌলিক অধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।
সারোয়ার তুষার বলেন, প্রত্যেকটি অধিকারের সীমা রয়েছে। তারা একটি সাধারণ সীমা দেয়ার কথা ভেবেছেন। আমরা বলেছি সাধারণ সীমা নির্ধারণে সর্বোচ্চ আদালতে এখতিয়ার সুনির্দিষ্ট করতে হবে। নির্বাচনে প্রত্যেক দলকে ১০ শতাংশ তরুণ-তরুণী মনোনয়ন দিতে হবে। এক্ষেত্রে আমরা তরুণ-তরুণীর সর্বোচ্চ বয়স ৩৫ বছরের প্রস্তাব করেছি। ন্যূনতম প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে বয়স ২৩ করা উচিত। ডেপুটি স্পিকার বিরোধী দল থেকে হওয়া উচিত। অর্থবিল ও দলীয় অনাস্থা ভোট ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে স্বাধীন মতামত দিতে পারবেন সংসদ সদস্যরা। ডেপুটি স্পিকার তারা দুইজন প্রস্তাব করেছে, আমার বলেছি একজন হওয়াই যথেষ্ট এবং তা বিরোধী দল থেকেই হওয়া উচিত।
প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান যেন একই ব্যক্তি না হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা বলেছি প্রধানমন্ত্রী হবেন মন্ত্রিসভার জ্যেষ্ঠ প্রথম ব্যক্তি। এর বাইরে তার আলাদা প্রধানের স্ট্যাটাস না থাকুক। তারা বলেছেন অর্থবিল ছাড়া দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে মন্তব্য দেয়া যাবে। আমরা বলেছি দলের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটে এটাও অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। অর্থাৎ অর্থবিল ও দলীয় অনাস্থা ভোট ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে স্বাধীন মতামত দিতে পারবেন সংসদ সদস্যরা। উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষের দুই কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের যে প্রস্তাবটা এসেছে। এক্ষেত্রে আমরা বলেছি উচ্চকক্ষের প্রার্থী নির্বাচনের আগেই ঘোষণা করতে হবে। যেটা অন্যান্য দলগুলো চাচ্ছে না। একজন ভোটার একটাই ভোট দিবেন। ওই ভোটের একটা পার্সেন্টটেন্স জমা হবে। সেক্ষেত্রে আমার জানার অধিকার আছে উচ্চকক্ষে কে যাচ্ছে। আমি যদি না জানি, ভোট দিয়ে দিলাম। একটা দল ৩৫টা ভোট পেলো এবং ৩৫ জন উচ্চকক্ষে গেল। এবং তারা তাদের মত করে ৩৫ জনকে দিয়ে দিলো। আমার কাছে যদি তালিকা থাকে যে নিম্নকক্ষ ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে চিন্তা করবো কারা উচ্চকক্ষে রয়েছে। নিম্নকক্ষে যেমন আগেই ঘোষণা করতে হবে প্রার্থী তেমনি উচ্চকক্ষেও করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রী পরামর্শ দিতে পারবেন। তবে সেটা সবক্ষেত্রে আইনি বাধ্যবাধকতা থাকবে না। এখন যেমন থাকে তেমন না। এটা হতে হবে নন বাইন্ডিং। জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের প্রস্তাব এসেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের একটা বিধান রয়েছে। এটা হতে হবে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার। সেক্ষেত্রে আমরা বুঝতে পারবো তাদের কাজ শুধু নির্বাচন আয়োজন করা। সামনে বা এই নির্বাচন আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে করতে পারি।
সারোয়ার তুষার আরও বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার নির্বাচন কমিশন বলেছে চার মাস হতে হবে। সংস্কার কমিশন বলেছে তিন মাস আমরা বলেছি ৭০ থেকে ৭৫ দিনই যথেষ্ট। নির্বাচনকালীন সময় একটা সরকার থেকে আরেকটা সরকার আসার সময় পর্যন্ত মাঝখানের সময়টা এনসিসি’র বিরুদ্ধে তদন্ত করতে পারবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। বিচার বিভাগের স্বতন্ত্র আলাদা সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সংসদ চলাকালীন যদি জরুরি অবস্থা জারি করার মতো পরিস্থিতি আসে। তাহলে উভয়কক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে জরুরি অবস্থা জারি করতে হবে। নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের সময় কোনো অবস্থাতেই জরুরি অবস্থা জারি করা যাবে না। নির্বাচন কমিশন ও সংবিধান সংস্কার কমিশন উচ্চকক্ষের সিটের ক্ষেত্রে বলেছেন ৩ শতাংশ ভোট পেলে তার ভিত্তিতে আপনাকে আসন দেয়া হবে। সংবিধান সংস্কার কমিশন এ বিষয়ে বলেছে ১ শতাংশ। আমরা ১ শতাংশই মনে করি যথাযথ। দুদক কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে তারা বলেছে কিছু প্রতিষ্ঠানে ১৫ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। আমরা বলেছি এটা ১০ বছর থাকলেই চলবে। বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট ও অধস্তন আদালতে বিচারক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের সম্পদের বিবরণী প্রতি তিন বছর অন্তর দেয়ার কথা তারা বলেছেন। আমরা বলেছি এটা প্রত্যেক বছর করতে হবে।
জনপ্রশাসনের ক্ষেত্রে সংস্কার কমিশনের কথা উল্লেখ করে এনসিপির এই নেতা বলেন, তারা প্রস্তাব করেছে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মামলা গ্রহণের ক্ষমতা থাকা দরকার। আমরা বলেছি বিচার বিভাগের ক্ষমতা বিচার বিভাগের পেশাজীবী ছাড়া বাইরে কারও হাতে থাকা ঠিক হবে না। সংসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য নিয়োগ জনপ্রশাসনের পক্ষ থেকে এসেছে। আমরা নীতিগতভাবে একমত। কিন্তু এটা জনপ্রশাসনের মধ্যে পড়ে না। আমরা জনপ্রশাসনে বেশি বিরোধিতা করেছি। সেটা হলো প্রাদেশিক শাসনের দেশের জন্য বিপজ্জনক। এটা বাতিল করে দেয়া উচিত। বিভাগীয় ভূমি আদালতের বিষয়টা পরিষ্কার না থাকায় আমরা এটার সঙ্গে একমত হতে পারি নাই।
এ সময় দলটির সংস্কার সমন্বয় কমিটির সদস্য মুনিরা শারমিন, জাবেদ রাশিম, আরমান হোসাইন ও সালেউদ্দিন সিফাত উপস্থিত ছিলেন।মানবজমিন