ড. ফাতেমা সুলতানা শুভ্রা:- বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হিসেবে আমার ১৫ বছরের শিক্ষক জীবনে দেখেছি, যখন কোনও নারী শিক্ষার্থী কোনও রকম যৌন হয়রানির অভিযোগ নিয়ে আসেন, তখন প্রশাসনের প্রথম ধাপে যারা থাকেন তাদের থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ধাপে সক্রিয় সদস্যদের মূল কাজ থাকে- যৌন হয়রানি কিংবা ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ না করা এবং বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যে না এনে একে একটি ‘বুঝ’ দেওয়া চেহারা দেওয়া। মনে করা হয়, এতে বিভাগ-বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষক সমাজ সবার বদনাম হয়ে যাবে।
এরকম একটি উদাহরণ ২০১১ সালের ভিকি আন্দোলনের সময়ও দেখা গিয়েছে। ভিকারুননিসা নূন স্কুলের অধ্যক্ষের কাছে বিচার চাইতে চাইতে হয়রানির শিকার পরিবারটি ঘটনার ৪৫ দিন পর মেডিক্যাল পরীক্ষা করতে সক্ষম হয়। একটি বড় পক্ষ শিক্ষার্থীর ধর্ষক পরিমলের পক্ষে কাজ করছিল এবং অধ্যক্ষের লোকজন হুমকি ধামকি দিচ্ছিল এই বলে যে এই মেয়ের তো কোনোদিন বিয়েশাদি কিছু হবে না। আরও মেয়ে আছে, বিষয়টি চেপে যান। আর মামলা করলে কী ক্ষতি হতে পারে, সেটির জন্য কেউ দায়ী থাকবে না। ধর্ষণকে ধর্ষণ বলে জোর কদমে হেঁটে যাওয়া ওই মামলার সাজা হয়েছে।
আমি যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সেসময় আমার শিক্ষক রেহনুমা আহমেদের Of Roses and Sexual Harassment শিরোনামে একটি লেখা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তিনি জাবি প্রশাসনকে বলেছিলেন, যৌন হয়রানি একগুচ্ছ গোলাপ ফুল নয় যে একে গুরুতরভাবে গ্রহণ করা হবে না।
ধর্ষণ নিয়ে গবেষণা কাজ করি বলে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক অধ্যাপক আমাকে বলছিলেন, তুমি যা লিখেছো সেটি তো “চটি বইয়ের” লেখা। একটা ভালো বিষয় নিয়ে কাজ করতে পারলা না! মানুষ কি বলবে তোমাকে… ধর্ষণ এই শব্দ তো উচ্চারণ করতেই কেমন লাগে!
আমার ধর্ষণের বিচার চেয়ে কোথাও দাঁড়ানো হয়নি; কিন্তু ধর্ষণ নিয়ে কাজ করি বলে আমাকে ক্রমাগত সামাজিক বিচারে “বাজে মেয়ের” তকমায় নিজেকে দেখতে হয়েছে। শিক্ষার্থী, গবেষক ও শিক্ষক- এই তিন রকমের অভিজ্ঞতায় একটি বিষয় সাধারণ- সেটি হলো নারী হিসেবে কোনও অন্যায়, মূলত পুরুষালি সমাজ যেগুলো ধর্ষণ, যৌন হয়রানি হিসেবে চিহ্নিত করে সেসব নিয়ে কথা না বলা ও প্রকাশ না করা। এটি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত, আর বললেও এমন নামে ডাকতে হবে, যেখানে নারী হিসেবে কিংবা সার্ভাইভার হিসেবে মান-ইজ্জত-সম্ভ্রম এই বিষয়গুলোও বড় হয়ে যাবে, নিপীড়ন নয়। অনেকটা ফুলের নামে ধর্ষণ-নিপীড়নকে ডাকার মতো।
‘সহিংসতা” ধারণায়নে নারীবাদী কাজের একটি কেন্দ্রীয় ভাবনা হলো ‘পার্সোনাল অ্যাজ পলিটিক্যাল’। নারীবাদী লড়াই বিশ্বজুড়ে এমন কিছু বিষয়কে রাজনৈতিক প্রশ্নে সামনে নিয়ে আসে যেগুলোকে ‘ব্যক্তিগত বিষয়’/ লুকানো ঘটনা ও সামাজিক সম্পর্ক হিসেবে মেনে নেওয়া হতো। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের বীরাঙ্গনা থেকে শুরু করে সমকালীন সময়কার নারীবাদী লড়াই রোজকার কথা, কাজে ও ভাবনায় যেসব বিষয়কে সাধারণ নির্যাতন হিসেবে চেনা হতো- যেমন শিশু যৌন উৎপীড়ন, যৌন হয়রানি, পারিবারিক নির্যাতন- সন্দেহাতীতভাবে সমাজে থাকলেও ‘ইজ্জত’, সাংঘাতিক ক্ষতি এসব নামে এক ধরনের চিনির প্রলেপ দেওয়া শব্দ ব্যবহার করে প্রকাশ করার একটি কাঠামোগত তাড়না আছে এবং নারীবাদী লড়াইয়ের বিরুদ্ধে কাজ করে গিয়েছে। এই কারণেই বাংলাদেশে বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পেয়ে আবার যুদ্ধে যে অংশ নিয়েছেন সেটি “মরিয়া” হয়ে প্রমাণ করতে হয়।
ধর্ষণের ভিকটিমের নাম গোপন করা এবং ধর্ষককে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করার ভিকটিম অনুকূল পরিপ্রেক্ষিতে জাবির ৯৮-এর ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনই প্রথমবারের মতো নারীর প্রতি শ্লীলতাহানি, সম্ভ্রমহানি কিংবা ইজ্জতহানি শব্দগুলো ব্যবহার না করে মিছিলে ধর্ষণ শব্দটি ব্যবহার করতে শুরু করে।
তার মানে দাঁড়ায় ধর্ষণকে ধর্ষণ বলতে পারাতে এক ধরনের দীর্ঘ নারীবাদী ও নিপীড়নবিরোধী লড়াইয়ের ইতিহাস রয়েছে।
নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা কিংবা ধর্ষণের মতো সহিংসতাগুলো যখন নৃশংসতার কথা কেবল উন্মোচন করে এবং নারীর সম্ভ্রমহানি হয়ে যাওয়াকে স্পষ্ট করে না তখন পুরুষালি সমাজের এক ধরনের অস্বস্তি হয়। নামকরণ নিপীড়নকে চেনা এবং নিপীড়নকে প্রতিরোধ করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।
এই কারণেই দেখা যায় আন্দোলনকারীদের প্রতি একজন শিক্ষক পরামর্শ দেন “ধর্ষণ শব্দটা না বলে শ্লীলতাহানি ব্যবহার কর, শুনতে ভালো লাগবে” (অশুচি ১৯৯৮)।
১৯৯৮-এর সময়কালেও পত্রপত্রিকায় লেখকদের কেউ কেউ “সতীত্ব হারানো বিশ্ববিদ্যালয়” এই শিরোনামে জাবির ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন নিয়ে লেখা লিখেছে।
ফলে আজকে ডিএমপি কমিশনারের ধর্ষণকে ধর্ষণ বলতে অস্বস্তি হওয়া নতুন কোনও প্রবণতা নয়- এটি বাংলাদেশের পুরুষালি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোর পুনরাবৃত্তি- যে কাঠামো নারীর ধর্ষণকে নারীর জীবনের শেষ হিসেবে দেখতে শুরু করে।
১৯৯০-এর দশক থেকে জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাস সমেত বৃহত্তর বিশ্ববিদ্যালয় পরিসরে ছাত্র রাজনীতির একটা রাজনৈতিক সচেতনতার প্রস্তুতি পর্বের সূচনা দেখা যায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে জাবি ক্যাম্পাসের সীমান্তবিরোধী আন্দোলন এবং ১৯৯৮-এর ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন দেখাতে সক্ষম হয়েছিল যে ধর্ষণ, সূর্যাস্ত আইন কিংবা বিভিন্ন মাত্রার যৌন নিপীড়ন ইত্যাদি কখনও এর আগে রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর এজেন্ডায় বিদ্যমান না থাকলেও এই নিপীড়নগুলোও বৈষম্য নিপীড়নবিরোধী লড়াইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। সারা দেশব্যাপী ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যা নিয়ে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল সেটাকে জাতীয় পর্যায়ে এই একই রকম রাজনৈতিক সংগঠনের একক নিয়ন্ত্রণের বাইরে বিকশিত হওয়া আন্দোলনের উদাহরণ হিসেবে দেখতে পাই।
এই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ফ্যাসিস্টের বিরুদ্ধে ২০২৪-এর জুলাই আন্দোলনেও দেখতে পাই।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে “অপরাধ’, ট্রাইব্যুনাল, ধর্ষণ, অপহরণ, যৌতুক- এমন বহু উপশিরোনামে কোন ধারায় কাকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা আছে তার সুস্পষ্ট বক্তব্য আছে (http://bdlaws.minlaw.gov.bd/act-835.html)।
বাংলাদেশের আইনেও ধর্ষণ আছে- নারী ও শিশু নির্যাতন আইন কোনও সমরূপী আইন নয়।
নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও প্রতিরোধ জারি রাখতে হলে ধর্ষণ ও বহুমাত্রিক নারীর প্রতি সহিংসতাকে “ফুলের নামে না ডেকে’ সুস্পষ্টভাবে ওই নামেই নামকরণ ও জোরে জোরে চিৎকার করে ডাকা যথার্থ- যে নাম শুনলে পুরুষালি কাঠামো ও পুরুষালি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের অস্বস্তি হয়। সমাজে নারী, ভিকটিম ও সার্ভাইভার অনুকূল পরিস্থিতি নির্মাণে ধর্ষণকে সুস্পষ্টভাবে ধর্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করা প্রয়োজন।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।