ডেস্ক রির্পোট:- চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ২২৯টি। এর মধ্যে ৬১টি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নেই। সহকারী শিক্ষকের পদ খালি ১১০টি। এসব বিদ্যালয় তদারকির জন্য উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ে একজন শিক্ষা কর্মকর্তা, আটজন সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা থাকার কথা। কিন্তু বর্তমানে ৯টি পদের বিপরীতে আছেন কেবল একজন—সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা। তিনিই এখন ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা। উপজেলার সব প্রাথমিক বিদ্যালয় একাই তদারকি করতে হচ্ছে তাকে। এ ছাড়া উপজেলায় একজন উচ্চমান সহকারী, তিনজন অফিস সহকারী, একজন হিসাব সহকারী ও একজন পিয়নের পদ থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুজন।
একই চিত্র পটিয়া উপজেলায়ও। এই উপজেলায় ১৫২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে প্রধান শিক্ষক নেই ৫৭টি বিদ্যালয়ে। সহকারী শিক্ষক পদ খালি ৯৩টি। উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ে এক জন শিক্ষা কর্মকর্তা ও আট জন সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা থাকার কথা থাকলেও আছেন মাত্র একজন সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা। এখানেও তাকে একাই সামলাতে হচ্ছে সব কার্যক্রম।
কেবল এই দুই উপজেলায় নয়, কাছাকাছি চিত্র চট্টগ্রামের অন্য উপজেলাগুলোতেও। চট্টগ্রামে ২ হাজার ২৬৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৭৯২টি বিদ্যালয় চলছে প্রধান শিক্ষক ছাড়াই। এসব বিদ্যালয়ে ১৩ হাজার ৫৯৯টি সহকারী শিক্ষকের পদের মধ্যে বর্তমানে শূন্য আছে ১ হাজার ৩৬২টি। ফলে জোড়াতালি দিয়ে চালাতে হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। প্রধান শিক্ষক না থাকায় সহকারী শিক্ষকদের দাপ্তরিক কাজে সময় বেশি দিতে হচ্ছে। এতে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
শিক্ষাবিদদের মতে, দীর্ঘদিন ধরে প্রধান শিক্ষকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ খালি রেখে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এতে করে একাডেমিক কার্যক্রম যেমন ব্যাহত হবে, তেমনি প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলাও ভেঙে পড়বে। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার পদ খালি থাকলে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত হবে না। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের যোগ্য করে গড়ে তুলতে দ্রুত সময়ের মধ্যে শূন্যপদ পূরণ করা আবশ্যক।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. গোলাম মহিউদ্দিন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে প্রধান শিক্ষক বা সহকারী শিক্ষকের পদ খালি রেখে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান যদি না থাকেন, তাহলে ক্লাস ব্যবস্থাপনা, শিক্ষকদের উপস্থিতি, শিক্ষার্থীদের অগ্রগতি দেখভাল করার কেউ থাকে না। আমাদের গ্রামেগঞ্জে যেসব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে, সেগুলোর বেহাল অবস্থা। সেখানে প্রধান শিক্ষক অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেন। সেখানে বেশিরভাগ বিদ্যালয়ে যদি প্রধান শিক্ষক না থাকে, তাহলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। আর উপজেলায় বিদ্যালয়গুলো তদারকি করার জন্য পর্যাপ্ত লোকও যদি না থাকে, তাহলে তো পরিস্থিতি খুবই খারাপ হবে। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের যোগ্য করে গড়ে তুলতে দ্রুতই শূন্যপদগুলো পূরণ করা উচিত।’
চট্টগ্রাম জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তার পদ আছে ৯৭টি। এর মধ্যে পদ শূন্য আছে ৪৫টি। ২১টি উচ্চমান সহকারী পদের মধ্যে ১৫টিই খালি। ৩৯টি অফিস সহকারী পদের বিপরীতে শূন্য রয়েছে ২৩টি। আর অফিস সহায়ক পদ খালি পড়ে আছে ৮৪টি। এ ছাড়া জেলায় উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার ২১টি পদের মধ্যে তিনটিতে কর্মকর্তা নেই দীর্ঘদিন ধরে।
গ্রামে বিদ্যালয় বেশি, শিক্ষক কম: চট্টগ্রামে শহরের তুলনায় গ্রামে বিদ্যালয়ের সংখ্যা বেশি, শিক্ষক সংকটও বেশি। প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক—দুই পদেই শহরের তুলনায় গ্রামে বেশি সংখ্যক পদ শূন্য। ২ হাজার ২৬৯টি বিদ্যালয়ের মধ্যে উপজেলায় ৭১২টি ও নগরের ৮০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষকের পদ খালি রয়েছে।
উপজেলাগুলোর মধ্যে বাঁশখালীতে ৩০টি, রাউজানে ৭৪টি, সন্দ্বীপে ৩৫টি, ফটিকছড়িতে ৬১টি, পটিয়ায় ৫৭টি, আনোয়ারায় ৪৮টি, বোয়ালখালীতে ৫১টি, লোহাগাড়ায় ৩৫টি, চন্দনাইশে ২৫টি, হাটহাজারীতে ৪০টি, রাঙ্গুনিয়ায় ৩৬টি, মিরসরাইতে ১০৬টি, সীতাকুণ্ডে ৩০টি, সাতকানিয়ায় ৭৭টি ও কর্ণফুলীতে ৭টি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নেই। অন্যদিকে নগরীর মধ্যে ডবলমুরিংয়ে ১৬টি, পাহাড়তলীতে ১২টি, বন্দরে ১৫টি, পাঁচলাইশে ১৪টি, চাঁদগাঁওতে ১৭টি ও কোতোয়ালিতে ৬টি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নেই।
সহকারী শিক্ষক পদে বাঁশখালীতে ১৩২টি, রাউজানে ৯০টি, সন্দ্বীপে ৯৭টি, ফটিকছড়িতে ১১০টি, পটিয়ায় ৯৩টি, আনোয়ারায় ৪২টি, বোয়ালখালীতে ৬৯টি, লোহাগাড়ায় ৭২টি, চন্দনাইশে ৫৬টি, হাটহাজারীতে ১০৩টি, রাঙ্গুনিয়ায় ১৪৮টি, মিরসরাইয়ে ১২৬টি, সীতাকুণ্ডে ৪৩টি, সাতকানিয়ায় ৪৮টি ও কর্ণফুলীতে ৫টি পদ শূন্য। অন্যদিকে নগরীর মধ্যে ডবলমুরিংয়ে ২১টি, পাহাড়তলীতে ২৩টি, বন্দরে ২৮টি, পাঁচলাইশে ১৭টি, চাঁদগাঁওতে ২৮টি ও কোতোয়ালিতে ১১টি সহকারী শিক্ষক পদ শূন্য।
প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে থাকা একাধিক সহকারী শিক্ষক বলেন, প্রধান শিক্ষকের পদ খালি থাকায় বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। স্কুলের দাপ্তরিক কাজ সামলে ক্লাস নেওয়া, ক্লাস মনিটরিং করা, রিপোর্ট তৈরি করা, আবার স্কুলের কাজে শিক্ষা অফিসে দৌড়াদৌড়ি করা রুটিন কাজ হয়ে গেছে। একসঙ্গে সব সামলানো কষ্টকর। আর চলতি দায়িত্ব হওয়ায় অন্যান্য শিক্ষকরাও তেমন মানতে চায় না।
২৫ বছর ধরে বন্ধ কর্মচারী নিয়োগ: শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, প্রাথমিক শিক্ষায় বিগত ২৫ বছরে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে কোনো কর্মচারী নিয়োগ বা পদায়ন করা হয়নি। ফলে মাঠ পর্যায়ের অফিসসমূহ স্বাভাবিক কাজ পরিচালনা করতে প্রতিনিয়ত সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এ ছাড়া নিয়োগবিধি অনুযায়ী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার পদে বিগত ১০ বছরে কোনো কর্মকর্তা নিয়োগ হয়নি।
এত পদ শূন্য কেন: খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আগে প্রধান শিক্ষক পদে তিন ভাগের দুই ভাগ সহকারী শিক্ষক থেকে পদোন্নতির মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হতো। বাকি এক ভাগ সরাসরি নিয়োগ হতো। তবে মামলা জটিলতায় সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতির বিষয়টি প্রায় ১০ বছর ধরে ঝুলে আছে। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরে পদগুলো চলতি দায়িত্ব দিয়ে চালাতে হচ্ছে।
অন্যদিকে নিয়োগবিধিতে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা পদে ৫০ শতাংশ সরাসরি নিয়োগের বিধান থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে সরাসরি নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না।
যা বলছেন কর্মকর্তারা: পটিয়া উপজেলার সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা আলাউদ্দিন বলেন, ‘৯ জনের কাজ আমাকে একা সামলাতে হচ্ছে। এটা কষ্টকর এবং কঠিন একটি বিষয়। তার পরও আমি আমার জায়গা থেকে সর্বোচ্চ কাজ করার চেষ্টা করছি।’
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম আব্দুর রহমান বলেন, ‘এতগুলো শূন্য পদ নিয়ে কাজ করাটা কষ্টকর। পদ খালি থাকার বিষয়টি আমরা বারবার কর্তৃপক্ষের নজরে আনছি। আমাদের নিজেদেরও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) ড. আবু শাহীন মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘সহকারী থেকে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি নিয়ে একটা মামলা আছে। মামলাটি নিষ্পত্তির চেষ্টা করা হচ্ছে। নিষ্পত্তি হলে সহকারী থেকে যারা পদোন্নতি পাওয়ার যোগ্য তারা পদোন্নতি পাবেন। আর যেসব পদে সরাসরি নিয়োগ হয়, সেগুলোর চাহিদা অধিদপ্তর থেকে পাওয়া মাত্রই আমরা সরকারি কর্মকমিশনে পাঠিয়ে দিই।’কালবেলা