ডেস্ক রির্পোট:- প্রধানমন্ত্রীর সর্বময় ক্ষমতা থাকছে না। সংবিধান সংশোধনের আগেই উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন সরকারপ্রধান। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারক নিয়োগে ইতোমধ্যে অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়া সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের একচেটিয়া ক্ষমতাও হারাবেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে দলীয়প্রধান ও সংসদ নেতা হতে না পারলে ক্ষমতাসীন দল এবং সংসদে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ হারাবেন প্রধানমন্ত্রী।
স্বাধীনতার পর সংসদীয় গণতন্ত্র গ্রহণ করে বাংলাদেশ। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা চালু করেন শেখ মুজিবুর রহমান। একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতিকে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয়। রাষ্ট্রের তিন স্তম্ভ– আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগ রাষ্ট্রপতির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়।
১৯৯১ সালে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন হলে রাষ্ট্রপতির সব ক্ষমতা চলে যায় প্রধানমন্ত্রীর হাতে। সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া কিছুই রাষ্ট্রপতি স্বাধীনভাবে করতে পারেন না। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে চলতে হয়। ৫৬ (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদীয় দলের সমর্থিত নেতাকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগে রাষ্ট্রপতি বাধ্য।
শুধুমাত্র ৯৫(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করতে পারেন রাষ্ট্রপতি। এ অনুচ্ছেদে আরও বলা হয়েছে, ‘প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগ করবেন’। কিন্তু ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত’ রাষ্টপতি কিছুই প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া করতে না পারায় অন্যান্য বিচারক নিয়োগ হয় প্রধানমন্ত্রীর পছন্দে। এর মাধ্যমে বিচার বিভাগে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়েছে।
আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারককে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের রেওয়াজ থাকলেও তা না মানার নজির রয়েছে। বিচারাঙ্গনে প্রচলিত রয়েছে, রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি নিয়োগে স্বাধীন হলেও তা প্রধানমন্ত্রীর পছন্দেই নিয়োগ হয়।
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা যাচ্ছে বিচার বিভাগে
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতনের পর সংস্কারের দাবিতে রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানো। সংবিধান সংস্কার কমিশন সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে স্বাধীন বিচার বিভাগীয় নিয়োগ কমিশন (জেএসি) গঠনের সুপারিশ করেছে। এর সদস্যরা হবেন প্রধান বিচারপতি, আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম দুই বিচারপতি, হাইকোর্ট বিভাগের জ্যেষ্ঠতম দু’জন বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল এবং সংসদের উচ্চ কক্ষের মনোনীত একজন নাগরিক। জেএসি বিচারক নিয়োগে সুপারিশ করবে।
এ সুপারিশ বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। তা এড়াতে অন্তর্বর্তী ৯৪(৪) অনুচ্ছেদ কার্যকরে প্রধান বিচারপতির পরামর্শে বিচারক নিয়োগে ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ’ জারি করতে যাচ্ছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার।
এর খসড়ায় বলা হয়েছে, বিচারক নিয়োগে ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল’ গঠন করা হবে। প্রধান বিচারপতি হবেন এর চেয়ারম্যান। সদস্য হবেন আপিল বিভাগ, হাইকোর্ট এবং বিচার কর্ম-বিভাগের জ্যেষ্ঠ তিন বিচারক, অ্যাটর্নি জেনারেল, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি, চেয়ারম্যান মনোনীত আপিল বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের একজন অধ্যাপক। কাউন্সিল গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে যোগ্য প্রার্থীকে বিচারক নিয়োগে সুপারিশ করবে।
সরকারি সূত্র জানিয়েছে, শিগগির এ অধ্যাদেশ জারি হবে। এর পর বিচারক নিয়োগে সরকারপ্রধানের ক্ষমতা থাকবে না সংবিধান সংশোধন ছাড়াই।
সাংবিধানিক নিয়োগে ক্ষমতা খর্বের সুপারিশ
বিদ্যমান আইনে সার্চ কমিটির সুপারিশে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্য কমিশনার নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি। একই প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান এবং কমিশনার নিয়োগ হয়। তবে ৪৮(৩) অনুচ্ছেদের কারণে, সার্চ কমিটির প্রস্তাবিত নাম প্রথমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যায়। শেষ পর্যন্ত তাঁর পছন্দে নিয়োগ করা হয়।
৬৪(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি। এ পদের মেয়াদ রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টির ওপর নির্ভর করে। ১৩৮ (১) অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি সরকারি কর্ম-কমিশনের (পিএসসি) সভাপতি ও অন্যান্য সদস্যদের, ১২৭ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি। স্পিকারের নেতৃত্বাধীন বাছাই কমিটির মাধ্যমে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি। বাছাই কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আইনমন্ত্রী এবং সরকারের বিভিন্ন কমিশন এবং সংস্থার কর্মকর্তারা। ফলে এসব নিয়োগও হয় প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায়।
তা রোধে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের মাধ্যমে নিয়োগের সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। এতে বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত ৯ সদস্যের কাউন্সিলের সদস্য হবেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, নিম্ন ও উচ্চকক্ষের স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, বিরোধী দল মনোনীত দুই কক্ষের ডেপুটি স্পিকার, সংসদের অন্যান্য দল থেকে একজন সদস্য।
এনসিসির পাঠানো নাম থেকে নির্বাচন কমিশনার, দুদক চেয়ারম্যান ও কমিশনার, অ্যাটর্নি জেনারেল, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য, পিএসসির চেয়ারম্যান ও সদস্য নিয়োগ করবেন রাষ্ট্রপতি।
সশস্ত্র বাহিনীতে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানোর সুপারিশ
২০১৮ সালে প্রণীত ‘প্রতিরক্ষা বাহিনীসমূহের প্রধানদের নিয়োগ’ আইনানুযায়ী সেনা, নৌ এবং বিমান বাহিনীর প্রধান নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি। ৪৮(৩) অনুচ্ছেদের কারণে এসব নিয়োগও আসলে হয় প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায়। সশস্ত্র বাহিনীতে প্রধানমন্ত্রী প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর প্রধান প্রস্তাবিত এনসিসির মাধ্যমে নিয়োগের সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন।
অন্যান্য নিয়োগেও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমাতে এনসিসির সুপারিশে নিয়োগের কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবে। প্রতিরক্ষা এবং অন্যান্য বিভাগ নির্বাহীর অধীনে। প্রধানমন্ত্রী নির্বাহী প্রধান। তাঁর হাতে নির্বাহী বিভাগের নিয়োগের ক্ষমতা না থাকলে কীভাবে সরকার পরিচালনা করবেন– এ প্রশ্নে কমিশনের একজন সদস্য জানিয়েছেন, এগুলো শুধু সুপারিশ। সাংবিধানিক পদে নিয়োগে প্রধানমন্ত্রী একচ্ছত্র না থাকলেও নির্বাহী বিভাগে থাকবে।
বিএনপির ৩১ দফায় ক্ষমতার ভারসাম্য তথা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানোর প্রতিশ্রুতি রয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতাহীন করাকে সমর্থন করছে না দলটি। তবে জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতা কমানোর পক্ষে। দল দুটির নেতারা এ বিষয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তারা আগের মতোই জানিয়েছে, সুপারিশ পর্যালোচনা চলছে।
কমিশনের মেয়াদ বাড়ল
ছয় সংস্কার কমিশনের মেয়াদ আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাড়িয়ে গতকাল সোমবার এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। কমিশনগুলো হলো– জনপ্রশাসন, পুলিশ, নির্বাচন ব্যবস্থা, দুদক, সংবিধান এবং বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। গত ৩ এবং ৬ অক্টোবর গঠিত কমিশনগুলোর মেয়াদ ছিল ৯০ দিন।
গত ১৫ জানুয়ারি সংবিধান, পুলিশ, দুদক এবং নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন সুপারিশ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কাছে। গতকাল সংসদ ভবনে সংবিধান সংস্কার কমিশনের কার্যালয়ে কমিশন প্রধানরা মতবিনিময় সভা করেছেন। এতে সুপারিশ পর্যালোচনা করা হয়। এক কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে আরেক কমিশনের সুপারিশে ভিন্নতা, বৈপরিত্য আছে কিনা, তা চিহ্নিতের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সভায় ছিলেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. আলী রীয়াজ, নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান এবং বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান বিচারপতি এমদাদুল হক।