প্রশাসনে ক্ষোভ, জটিলতার শঙ্কা

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০২৫
  • ১৩ দেখা হয়েছে

আরও বেশি রাজনীতিকরণের সুযোগ তৈরির আশঙ্কা করছেন কর্মকর্তারা
কমিটির পরামর্শের ক্ষেত্রে আইনগত বাধা না থাকলেও সংশ্লিষ্ট বিভাগের ক্ষমতা খর্ব হবে
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে নিয়োগ-বদলিতে প্রশাসনের কাজের গতি কমে যাবে

ডেস্ক রিপো:- অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের নেতৃত্বাধীন কমিটির পরামর্শে জনপ্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলির পদক্ষেপে কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। তাঁদের আশঙ্কা, এতে পদোন্নতি ও বদলিপ্রক্রিয়ায় আরও বেশি রাজনীতিকরণের সুযোগ তৈরি হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উপদেষ্টাদের নেতৃত্বাধীন কমিটির পরামর্শে নিয়োগ ও বদলিতে আইনত বাধা নেই। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট উইংয়ের ক্ষমতা খর্ব করে এভাবে নিয়োগ-বদলিতে জটিলতা বাড়বে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রশাসনের কাজের গতি আরও কমে যাবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কাজ কীভাবে পরিচালিত হবে, তা রুলস অব বিজনেসে স্পষ্ট বলা আছে। বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং যুগ্ম সচিব থেকে শুরু করে ওপরের পদে নিয়োগ, বদলি ও পদায়নের দায়িত্ব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের। উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত পদোন্নতি দেওয়ার এখতিয়ার সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি)। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার জনপ্রশাসন, পুলিশ এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মকর্তাদের নিয়োগ, বদলি ও শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ দিতে উপদেষ্টাদের নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের তিনটি কমিটি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।

শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে বিগত সরকারের আমলে চুক্তিতে নিয়োজিত ৯৯ শতাংশ কর্মকর্তার নিয়োগ বাতিল করে। বিগত সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া বেশির ভাগ সচিবকে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) এবং কয়েকজনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। অন্যদিকে অনেক আগে অবসরে যাওয়া ১৪ জন কর্মকর্তাকে চুক্তিতে সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়, যাঁরা এখন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের দায়িত্বে আছেন।

কর্মকর্তারা বলছেন, উপদেষ্টাদের কমিটির সুপারিশে কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও বদলির এই পদক্ষেপকে ভালোভাবে নিচ্ছেন না তাঁরা। এ নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভও তৈরি হয়েছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, এই মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ (এপিডি) অনুবিভাগ কর্মকর্তাদের বদলি ও পদায়ন করে। এখন এপিডি অনুবিভাগের আগের সেই ক্ষমতা আর থাকছে না। বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি এবং যুগ্ম সচিব থেকে ওপরের পদে নিয়োগ ও বদলি করতে হলে উপদেষ্টাদের কমিটির সুপারিশ নিতে হবে। এর ফলে দক্ষ অনেকেই বঞ্চিত হতে পারেন। তিনি বলেন, যুগ্ম সচিব পদে নিয়োগ দিতে হলে উপসচিব পদ থেকে পদোন্নতি দিতে হবে। কিন্তু এ পদোন্নতি দেওয়ার এখতিয়ার এসএসবির। উপদেষ্টাদের কমিটিকে নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হলেও এসএসবি বাতিল বা স্থগিত করা হয়নি। ফলে পদোন্নতিতে উপদেষ্টাদের কমিটির ভূমিকা কী হবে বা এসএসবি কীভাবে কাজ করবে, তা স্পষ্ট নয়।

এপিডির দায়িত্বে ছিলেন এবং পরে সচিব হিসেবে অবসরে যাওয়া তিনজন সাবেক কর্মকর্তা মনে করেন, উপদেষ্টাদের কমিটি, এপিডি অনুবিভাগ এবং এসএসবি কীভাবে কাজ করবে, প্রজ্ঞাপনে তা স্পষ্ট করে বলে দিলে কর্মকর্তাদের কাজ করতে সুবিধা হতো। এখন অনেক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে কর্মকর্তারা দ্বিধায় পড়বেন।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে এসএসসি বাদ দিয়ে মন্ত্রীদের নিয়ে কাউন্সিল গঠন করে। ওই কাউন্সিল উপসচিব ও যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দিয়ে বেশ বিপাকে পড়েছিল। পরে কাউন্সিল বাতিল করে এসএসবি বহাল করা হয়। তিন বছরের আগে কাউকে মাঠ প্রশাসন থেকে প্রত্যাহার করতে হলে ২০০১ সালে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে প্রধান করে একটি কমিটির মতামত নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। কারণ, ওই সময় মন্ত্রী-এমপিরা মাঠপ্রশাসন থেকে কর্মকর্তাদের সরিয়ে নিজেদের পছন্দের লোক নিয়োগ দিতে মন্ত্রণালয়ে চাপ সৃষ্টি করেছিলেন।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, উপদেষ্টাদের কমিটিতে সদস্যসচিব করা হয়েছে একজন উপদেষ্টাকে। কর্মকর্তাদের সম্পর্কে তাঁর ভালো জানাশোনা নেই। অথচ সদস্যসচিবকেই কমিটিতে প্রস্তাব পেশ করতে হবে।

জানতে চাইলে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া বলেন, পরামর্শ দিতে যেকোনো কমিটি প্রধান উপদেষ্টা করতেই পারেন। তাঁদের পরামর্শ অনুযায়ী সরকার কাজ করতে পারে, না-ও করতে পারে। শীর্ষ আমলারা তাঁদের কাজ ঠিকমতো করছেন না বলেই এটা করা হয়েছে। অনেক আদেশ জারির পর বাতিল করতে হয়েছে। সরকারের এই পদক্ষেপে আমলাতন্ত্রের উচ্চপর্যায়ের দুর্বলতা প্রকাশ পায়। তিনি বলেন, প্রজ্ঞাপনে উপদেষ্টাদের কমিটিকে নিয়োগ ও বদলির বিষয়ে সুপারিশ দিতে বলা হলেও যুগ্ম সচিব পদে নতুন নিয়োগ দিতে পদোন্নতি দিতে হবে। এটা এসএসবির কাজ। এসএসবি বাতিল করা হয়নি।

ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘সরকারের এই পদক্ষেপে প্রশাসনের কাজের গতি কমে যাবে। বদলি-পদায়নের প্রক্রিয়াও মন্থর হবে। তাৎক্ষণিক বদলি করার দরকার হলে পারবে না, সমস্যা সৃষ্টি করবে। এটা প্রশাসনের জন্য শুভ লক্ষণ নয়। কারণ, এখন প্রশাসন রুটিন কাজই করতে পারছে না।’

অবশ্য সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, তিনি মনে করেন, এই কমিটি যৌক্তিক। কারণ, পদ-পদবির জন্য যেভাবে আন্দোলন হয়েছে এবং হচ্ছে সেটি কর্মকর্তা পর্যায়ে সামাল দেওয়া বেশ কঠিন। তিনি বলেন, উপদেষ্টাদের কমিটির সুপারিশ নিয়ে নিয়োগ ও বদলি করলে কাজের গতি কমবে কি না, তা নির্ভর করবে সচিবের ওপর। সচিব চাইলে জরুরি বিষয়ে উপদেষ্টাদের নিয়ে সভা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। মন্ত্রী গাইড করবেন, কিন্তু কাজ দ্রুত না দেরিতে হবে; ঠিক না, বেঠিক হবে, তা সচিবের দায়। এখন ওই দায় নেওয়ার সচিব কয়জন আছেন?

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions