ডেস্ক রির্পোট:- বিগত স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের আমলে পদবঞ্চিত হওয়া, দীর্ঘদিন ওএসডি থাকা, বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো ও নানাভাবে বঞ্চিত ১ হাজার ৬৪৫ সরকারি কর্মকর্তার কপাল খুলতে চলেছে। এসব কর্মকর্তার পদোন্নতিসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা ভাবছে তাদের নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। তবে যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, তারা এ সুযোগ পাবেন না। এরই মধ্যে দুর্নীতির অভিযোগ যাচাই-বাছাই করতে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ ৯টি মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর থেকে ৯৯ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিতে ছাড়পত্র চাওয়া হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে। এ ছাড়া জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে চাওয়া হয়েছে আরও ১ হাজার ৫৪৬ জন কর্মকর্তার দুর্নীতি-সংক্রান্ত তথ্য। এরপর দুদক থেকে সংস্থাটির বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক ও জেলা কার্যালয়ে উপপরিচালক বরাবর চিঠি দেওয়া হয়েছে। একাধিক মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে এসব চিঠির কপি এসেছে কালবেলার হাতে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এসব কর্মকর্তার ভাগ্যের শিকে খুলতে পারে দ্রুতই। ফিরতে পারেন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নানা দায়িত্বে। পাশাপাশি মিলবে এ সময়ের আটকে থাকা পদোন্নতিও।
জানা গেছে, এর আগে স্বৈরাচারের আমলে চাকরিতে নানাভাবে বঞ্চনার শিকার কর্মকর্তাদের প্রতিকারের উদ্যোগ নেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এ লক্ষ্যে কমিটি গঠনের পর বঞ্চিত কর্মকর্তাদের কাছ থেকে আবেদন আহ্বান করা হয়। যারা নিজেদের বঞ্চিত মনে করে প্রতিকার আশা করেন, তাদের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আবেদন করতে বলা হয়। গত সেপ্টেম্বরে এ লক্ষ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আওতায় ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছরের ৪ আগস্ট পর্যন্ত চাকরিতে বঞ্চনার শিকার কর্মকর্তাদের আবেদন করতে বলা হয়। এ ছাড়া আবেদন পর্যালোচনা করে সুপারিশ দেওয়ার জন্য আরও একটি কমিটি গঠন করে দেয় সরকার। এরই মধ্যে সেখানে প্রায় ৪ হাজার কর্মকর্তা নিজেদের বঞ্চিত দাবি করে আবেদন করেছেন।
নথিপত্র বলছে, গত ৩ নভেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ড. মো. মনিরুজ্জামন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে ১ হাজার ৫৪৬ জন কর্মকর্তার পাঁচ ধরনের তথ্য চাওয়া হয় দুদকের কাছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘উপর্যুক্ত বিষয় ও সূত্রের পরিপ্রেক্ষিতে জানানো যাচ্ছে যে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আওতায় ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট পর্যন্ত সময়কালে চাকরিতে নানাভাবে বঞ্চনার শিকার এবং উল্লিখিত সময়কালের মধ্যে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি-সংক্রান্ত অভিযোগ বা মামলা চলমান রয়েছে, সে বিষয়ে দুদকের হালনাগাদ তথ্য প্রয়োজন।’ চিঠিতে সুনির্দিষ্ট কর্মকর্তার নাম ও পরিচিতি নম্বর, মামলার নম্বর, আদালতের নাম, মামলার বিষয় বা ধরন ও সর্বশেষ হালনাগাদ অবস্থা জানতে চাওয়া হয়। চিঠির সঙ্গে সংযুক্তি দেওয়া হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চিহ্নিত করা ১ হাজার ৫৪৬ জন কর্মকর্তার নাম, তাদের পরিচিতিসহ অন্যান্য তথ্য।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে গত ১১ নভেম্বর সংস্থাটির বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক ও সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১, ঢাকা-২, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুর কার্যালয়ের উপপরিচালক বরাবর তথ্য চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে ছয় ধরনের তথ্য গত ১৪ নভেম্বরের মধ্যে সফট কপি ইমেইলে এবং হার্ডকপি ডাকযোগে প্রেরণের নির্দেশনা দেওয়া হয়। কয়েকটি জেলা কার্যালয় থেকে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো চিঠি এসেছে কালবেলার হাতে। সেখানে দেখা গেছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তর ও মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো ১ হাজার ৬৪৫ কর্মকর্তার কারও বিরুদ্ধেই দুর্নীতির কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে সব কার্যালয়ের তথ্য যাচাই করে দেখা সম্ভব হয়নি।
নথিপত্রে দেখা যায়, ১ হাজার ৬৪৫ কর্মকর্তার মধ্যে রয়েছেন অর্থ বিভাগের একজন, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ১৬ জন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ২৫ জন, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের ৮ জন, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের তিনজন, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের একজন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাতজন, পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের আটজন, স্থানীয় সরকার বিভাগের ৩০ জন এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ১ হাজার ৫৪৬ জন।
নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে দুদকে পাঠানো একটি চিঠিতে বলা হয়েছে, হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের (সিজিএ) কার্যালয়ের সিস্টেম অ্যানালিস্ট প্রকৌশলী মো. আতিয়ার রহমানকে সিনিয়র সিস্টেম অ্যানালিস্ট পদে পদোন্নতি প্রদানের লক্ষ্যে তার বিরুদ্ধে দুদকে কোনো মামলা চলমান রয়েছে কি না, সেটি জানতে ছাড়পত্র চাওয়া হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ থেকে পাঠানো চিঠিতে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে ওয়ার্ল্ড কাস্টমস অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউসিও) বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি এবং মিনিস্টার (কাস্টমস) পদে নিয়োগের জন্য প্রাথমিকভাবে বাছাইকৃত তিনজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-সংক্রান্ত কোনো তথ্য আছে কি না, তা জানতে চাওয়া হয়। ওই তিন কর্মকর্তা হলেন ঢাকা দক্ষিণের কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনার মোহাম্মদ ফাইজুর রহমান, শুল্ক রেয়াত ও প্রত্যর্পণ পরিদপ্তরের কমিশনার মোহাম্মদ আকবর হোসেন এবং কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট ঢাকা দক্ষিণের কমিশনার খালেদ মোহাম্মদ আবু হোসেন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে গত ২৪ অক্টোবর চিঠি দিয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরের আটজন উপপরিচালক ও আটজন সহকারী পরিচালকের দুর্নীতির মামলা-সংক্রান্ত তথ্য চাওয়া হয়েছে। তারা হলেন উপপরিচালক মোহা. সাদিকুল হক, শিলা রানী দাস, রতন কুমার হালদার, আদিল মোত্তাকীন, আল-মামুন তালুকদার, এস এম আনোয়ারুল করিম, মো. সাফায়েত হোসেন তালুকদার, মো. তৌহিদুল ইসলাম, সহকারী পরিচালক ড. আবদুল্লাহ আল ফিরোজ, মোহাম্মদ আলী, এসএম ফজলুল করিম, শেখ খলিল আল রশিদ, শহীদুল ইসলাম. মো. আবু তাহের, মো. মাছুম আলী ও মো. জসীম উদ্দিন। চিঠির বিষয়টি কালবেলাকে নিশ্চিত করেছেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে উপসচিব এ বি এম সাদিকুর রহমান।
গত ২৯ অক্টোবর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে দুদকে একটি চিঠি দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, ফিডার পদধারী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (প্রথম শ্রেণি) থেকে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা পদে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের নিয়োগবিধিতে পদোন্নতির বিধান রয়েছে। তাই জেলা পুনর্বাসন কর্মকর্তা পদে পদোন্নতির জন্য ফিডার পদধারী ২৫ কর্মকর্তার বিষয়ে দুর্নীতির অভিযোগ সংক্রান্ত তথ্য চাওয়া হয়। ওই ২৫ কর্মকর্তা হলেন মো. সাইফুল ইসলাম, মো. বদরুজ্জামান, মো. আলাউদ্দিন, মুহাম্মদ আবু এহসান, শেখ আ. কাদের, মো. মনোয়ারুল ইসলাম, একেএম শাহা আলম, মো. জিয়াউর রহমান, মুহম্মদ মুবিনুর রহমান, মোহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম, মো. আব্দুল মতিন, মো. মানসুরুল হক, কাজী ইমতিয়াজ আসফাক, মো. রিয়াজুল ইসলাম, মো. জিন্দার আলী, মো. আমিরুল ইসলাম, মো. সুলতান হোসেন, মো. ছানাউল্লাহ, মহিদুল আলম ও এসএম শামীম এহসান।
বিষয়টি নিশ্চিত করে সচিবের একান্ত সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘পদোন্নতির জন্য ২৫ জন কর্মকর্তার দুর্নীতি-সংক্রান্ত তথ্যাদি চাওয়া হয়েছে। আমরা এখনো রিপোর্ট পাইনি। রিপোর্ট পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
গত ২৪ অক্টোবর যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়ে আটজন কর্মকর্তাকে ডেপুটি কো-অর্ডিনেটর থেকে কো-অর্ডিনেটর এবং কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অফিসার, সিনিয়র প্রশিক্ষক/ইনস্ট্রাক্টর (পশু পালন/মৎস্য) থেকে ডেপুটি কো-অর্ডিনেটর পদে পদোন্নতি দিতে তাদের তথ্য চাওয়া হয়। এসব কর্মকর্তা হলেন ঝিনাইদহ যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ডেপুটি কো-অর্ডিনেটর মো. ইস্রাফীল হক, জামালপুর যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ডেপুটি কো-অর্ডিনেটর মাহবুবুর রহমান, খাগড়াছড়ি যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ডেপুটি কো-অর্ডিনেটর মো. ইকবাল কাওসার, শরীয়তপুর যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সিনিয়র ইনস্ট্রাক্টর (মৎস্য) ও সংযুক্ত গাজীপুর যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রাজিয়া খাতুন, লালমনিরহাট যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অফিসার মো. আইয়ুব আলী, বগুড়ার সিনিয়র প্রশিক্ষক (মৎস্য) মিজানুর রহমান, ভোলার সিনিয়র প্রশিক্ষক (সংযুক্ত কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন কেন্দ্র, সাভার) মো. আরিফুর রহমান ও সাভার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সিনিয়র ইনস্ট্রাক্টর আনজুমান আরা বেগম।
জানতে চাইলে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শাহানা সুলতানা বলেন, ‘দুদকে আমাদের আটজন কর্মকর্তার দুর্নীতি-সংক্রান্ত অভিযোগ আছে কি না, সেটি জানতে চেয়ে চিঠি দিয়েছিলাম। দুদক থেকেও আমাদের উত্তর দেওয়া হয়েছে। আমাদের কর্মকর্তাদের বিষয়ে কোনো অভিযোগ নেই।’
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন শাখা-১ থেকে গত ৩১ অক্টোবর পাঠানো চিঠিতে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিটিএ) পরিচালক ড. মো. জিয়াউল ইসলামের তথ্যাদি চাওয়া হয়েছে। একইভাবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি দিতে সাত কর্মকর্তার তথ্য চাওয়া হয়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু বিভাগে বিআরটিসির জেনারেল ম্যানেজার ও ম্যানেজার (অপারেশন) পদে পদোন্নতি দিতে আট কর্মকর্তার তথ্য চাওয়া হয়েছে। এর মধ্যে জেনারেল ম্যানেজার পদে পদোন্নতি দিতে মো. মনিরুজ্জামান বাবুর তথ্য চাওয়া হয়েছে। বাকি সাত কর্মকর্তা হলেন পরিযান কর্মকর্তা আশীষ কুমার দাস, শাহীনুল ইসলাম, উপব্যবস্থাপক (অপারেশন) মো. রাজু মোল্লা, ঝুমুর ইশরাত, প্রশাসনিক কর্মকর্তা দেবাশীষ মজুমদার ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আব্দুল বারেক। স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের সাংগঠনিক কাঠামোভুক্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (গ্রেড-৪)-এর শূন্য পদে পদোন্নতির জন্য ৩০ জনের তথ্য চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে চাওয়া হয়েছে ১ হাজার ৫৪৬ জন কর্মকর্তার দুর্নীতির হালনাগাদ তথ্য। তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চাওয়া সব কর্মকর্তাই অবসরপ্রাপ্ত। তাদের মধ্যে রয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত ১৭ জন সচিব। অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, উপসচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব ও গ্রেড-১ এর একাধিক কর্মকর্তা এই তালিকায় রয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) মো. আকতারুল ইসলাম বলেন, ‘এ-সংক্রান্ত বিষয়ে আমি অবগত নই।’কালবেলা