ডেস্ক রির্পোট:- প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া বলেছেন, গত ১৫ বছরের প্রশাসন জনসেবার সার্ভিস ছিল না। এটা ছিল সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের সহযোগী সার্ভিস। প্রশাসনের বেশির ভাগ কর্মকর্তার আচরণ ছিল রাজনৈতিক কর্মীর মতো। প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনী একটি বড় ভাবমূর্তির সংকটে আছে।
সামনে এটিই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
গতকাল শনিবার রাজধানীর বিয়াম ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে ‘প্রশাসনিক সংস্কার ও উন্নয়ন : বর্তমান প্রেক্ষিত ও ভবিষ্যৎ ভাবনা’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া বলেন, গত সাড়ে ১৫ বছরে প্রশাসনসহ সিভিল সার্ভিসকে কোন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল? এটাকে কি কোনো সার্ভিস বলা যেত? সাড়ে ১৫ বছরে যা হয়েছিল সেটি ছিল একটা দলীয়করণকৃত, লুটেরাদের সহযোগী, দেশের সমাজ-অর্থনীতি দুর্বৃত্তায়নকরণে সহযোগীদের একটি সার্ভিস। এটা জনপ্রশাসন ছিল না।
এ রকম একটি সার্ভিস সাড়ে ১৫ বছর রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের সঙ্গে মিলে দেশটি লুণ্ঠন করে, দেশের সুশাসনকে পুরোটা বিনষ্ট করে দিয়ে যা করেছিল, যে অবস্থায় নিপতিত করেছিল, সেই সার্ভিসটি একটি ভঙ্গুর সিভিল সার্ভিস।
প্রশাসন নিয়ে বড় ভাবমূর্তি সংকটে থাকার কথা উল্লেখ করে মুখ্য সচিব বলেন, সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ভাবমূর্তির। সাড়ে ১৫ বছরে যে গর্তে পড়েছিল তার থেকে কিভাবে এই সার্ভিসকে ওপরে তুলে আনা হবে এবং ভাবমূর্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে, সেই পরিকল্পনাটি প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের থাকতে হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব ড. এম এ মোমেন বলেন, ‘প্রশাসন নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।
আমার ভাবনা হলো, এইচএসসি পাসের পরই প্রশাসনের জন্য কর্মকর্তা নিতে হবে। এরপর তারা চার-পাঁচ বছর বিসিএস প্রশাসন একাডেমিতে অনার্স ও মাস্টার্স পড়ে পরীক্ষা দেবে। তাদের রেজাল্টের ওপর ভিত্তি করে কে কোন ক্যাডার পাবে, সেটা কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করবে।’
বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন এই সেমিনারের আয়োজন করে। সংগঠনের সভাপতি ও সংসদ সচিবালয়ের সচিব ড. মো. আনোয়ার উল্যাহর সভাপতিত্বে সেমিনারটি পরিচালনা করেন মহাসচিব মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের অধীন পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সচিব) মো. হাফিজুর রহমান।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমান বলেন, প্রশাসনে কোনো সাহসী কর্মকর্তা নেই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের একজন অধ্যাপক নিজের দপ্তর থেকে ছবি নামিয়ে ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। প্রশাসনে এ ধরনের নজির নেই।
বিসিএস ১৯৮২ ব্যাচের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ বি এম আবদুস সাত্তার বলেন, শেখ হাসিনা গত ১৫ বছরে প্রশাসনকে নিজের তাঁবেদার বানিয়ে রেখেছিলেন। এই সময় অন্তত আড়াই লাখ কর্মকর্তা নিয়োগ হয়েছে প্রশাসনে। হাসিনা সরকারে সুবিধাভোগী এসব কর্মকর্তাকে প্রশাসনের শীর্ষ বা গুরুত্বপূর্ণ পদে রেখে কিভাবে সংস্কার হবে? প্রশাসনের সংস্কার করতে হলে তাঁদের সেখান থেকে সরাতে হবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমান বলেন, ‘যতবারই সংস্কার হয়েছে ততবারই প্রশাসন দুর্বল হয়েছে। আমরা বঞ্চিত হয়েছি। সংস্কারে এ পর্যত ২৩টি কমিটি হয়েছে, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত বাস্তবায়ন নেই। আমরা সুপারিশ করতে পারি, কিন্তু বাস্তবায়নের জন্য দরকার নির্বাচিত সরকার। বঞ্চিতদের বিষয়ে কমিটি কাজ করছে। তাঁদের সুপারিশের আলোকেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে সরকার।’
১৯৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা ও অফিসার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এ বি এম আব্দুস সাত্তার বলেন, অবিলম্বে প্রশাসনে শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে। নতুন সরকার গঠিত হওয়ার ১৮ দিনের মধ্যে প্রশাসনের তিন স্তরের বঞ্চিত ৬৬৭ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হলেও এখনো বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে পদায়ন করা হয়নি। আড়াই মাস ধরে তাঁরা পদায়ন চেয়ে বারান্দায় বারান্দায় ঘুরছেন।
সাখাওয়াত হোসেন নামের একজন যুগ্ম সচিব বলেন, প্রভাবমুক্তভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ করে দিতে হবে। একেবারে সচিব থেকে শুরু করে নিচের পর্যায় পর্যন্ত প্রত্যেককে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধে মো. হাফিজুর রহমান বলেন, বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদন (এসিআর) যে প্রক্রিয়ায় দেওয়া হয়, এতে কর্মকর্তাদের প্রকৃত মূল্যায়ন হয় না। এই বিষয়টি সংস্কারের আওতায় আনতে পারে। মেধা, সততা, জ্যেষ্ঠতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে পদোন্নতি ও পদায়ন হলে প্রশাসনের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব অনেকাংশে কমে আসবে।