ড. মইনুল ইসলাম:- গত জুলাইয়ের গণ-আন্দোলনের সময় ১৭ জুলাই ব্যাপক ভাঙচুরের শিকার মেট্রোরেলের মিরপুর-১০ স্টেশনটি মেরামতের পর ১৫ অক্টোবর আবার খুলে দেওয়া হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই বিধ্বস্ত স্টেশনটি সরেজমিনে পরিদর্শন করেছিলেন। তাঁর সামনেই মেট্রোরেলের তখনকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিডিয়াকে জানিয়েছিলেন, ব্যাপক ভাঙচুরকৃত স্টেশনটি বিশেষজ্ঞরা সরেজমিনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানিয়েছেন, স্টেশনটি আবার চালু করতে কমপক্ষে এক বছর সময় লাগবে, আর মেরামতে খরচ হবে আনুমানিক ৩০০ কোটি টাকা। অথচ বন্ধ হওয়ার দুই মাস ২৭ দিনের মধ্যে স্টেশনটির মেরামত সম্পন্ন করে সেটা চালু করতে খরচ হয়েছে মাত্র ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। অন্যান্য স্টেশন থেকে ‘স্পেয়ার ইকুইপমেন্ট’ নিয়ে আসায় খরচ অনেকটা কম হয়েছে, যেগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করে রিপ্লেস করার পর মোট খরচ দাঁড়াবে ১৮ কোটি টাকা। কোথায় ৩০০ কোটি, আর কোথায় ১৮ কোটি টাকা!
সাড়ে ১৫ বছর ধরে গেড়ে বসা স্বৈরশাসক হাসিনার দুর্নীতির খাই বাড়তে বাড়তে কতখানি সর্বনাশা পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল, তার অকাট্য প্রমাণ মিলছে এই দুটো টাকার অঙ্কের তারতম্য তুলনা করলে। (এর আগে অপেক্ষাকৃত কম ভাঙচুরের শিকার কাজীপাড়া স্টেশনটি মাত্র ২০ লাখ টাকায় মেরামত করে আগস্ট মাসেই খুলে দেওয়া হয়েছিল)। সব প্রকল্পেই প্রকৃত খরচের কয়েক গুণ বেশি খরচ দেখিয়ে হাসিনা, তাঁর পরিবার, আত্মীয়-স্বজন এবং ঠিকাদার-ব্যবসায়ীরা অর্থ লুটপাটের মহাযজ্ঞ চালিয়ে গেছে এই সাড়ে ১৫ বছর ধরে। মিরপুর-১০ মেট্রোরেল স্টেশন মেরামত থেকেও অর্থ আত্মসাতের পাঁয়তারা ছিল হয়তো!
হাসিনা তাঁর স্বৈরাচারী শাসনামলে তাঁর পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, দলীয় নেতা-কর্মী, কতিপয় অলিগার্ক-ব্যবসায়ী এবং পুঁজি-লুটেরাদের সঙ্গে নিয়ে সরকারি খাতের প্রকল্প থেকে যে লাখ লাখ কোটি টাকা লুণ্ঠনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন, তার ভয়াবহ কাহিনি তাঁর পতনের পর উদ্ঘাটিত হতে শুরু করেছে। ঋণ করে ঘি খাওয়ার ক্লাসিক উদাহরণ হাসিনা আমলের অধিকাংশ প্রকল্প। গত ৭ আগস্ট দৈনিক বণিক বার্তার হেডলাইনের খবরে প্রকাশিত তথ্য-উপাত্তের দাবি অনুযায়ী ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের মোট স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। অথচ, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার দিনে বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল মাত্র ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। এর মানে, এই দুই ঋণের স্থিতির অঙ্কের পার্থক্য দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ২০৬ কোটি টাকা।
গত ৫ আগস্ট ভারতে চলে যাওয়ার আগে হাসিনা এই সুবিশাল ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার ঋণের সাগরে দেশের জনগণকে নিমজ্জিত করে প্রতিবছর মাথাপিছু জিডিপির উচ্চ-প্রবৃদ্ধি দেখিয়ে চলেছিলেন, যাকে এক কথায় বলা চলে ‘নিকৃষ্টতম শুভংকরের ফাঁকি’ ও জনগণের সঙ্গে ভয়ানক প্রতারণা। ফলে, ২০২৪ সালের অক্টোবরে প্রতিজন বাংলাদেশির মাথার ওপর এক লাখ টাকার বেশি ঋণ নিজেদের অজান্তেই চেপে বসে গেছে। কমপক্ষে এক দশক ধরে দেশের অর্থনীতি বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে ডুবে থাকবে এই বিশাল অঙ্কের ঋণের সুদাসলে কিস্তি পরিশোধের দায় মেটানোর কারণে। হাসিনার শাসনামলে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার অজুহাতে একের পর এক মেগা-প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পাশাপাশি সারা দেশে বেলাগামভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে শত শত উন্নয়ন প্রকল্প। প্রতিটি মেগা প্রকল্পে প্রকৃত ব্যয়ের তিন-চার গুণ বেশি ব্যয় দেখানোর মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে লাখ লাখ কোটি টাকা, যে জন্য এসব প্রকল্পের ব্যয় ‘বিশ্বের সর্বোচ্চ’ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। দেশের এমন একটি প্রকল্পের নাম করা যাবে না যেটার খরচ প্রতিবেশী দেশ ভারতের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি নয়। গত সাড়ে ১৫ বছর ছিল দেশে দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের মহোৎসব-কাল।
সারা দেশের গ্রাম ও শহরগুলোতে ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে সাড়ে ১৫ বছরে যে শত শত প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে, তার মধ্যে কয়েকটি নিকৃষ্ট প্রকল্পের উদাহরণ দেখুন: পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-মাওয়া-যশোর-পায়রা রেলপথ, চট্টগ্রাম-দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ এবং ঢাকা-গাজীপুর বিআরটি প্রকল্প নিঃসন্দেহে নিকৃষ্ট প্রকল্প। এই প্রকল্পগুলোতে প্রকৃত ব্যয়ের তিন-চার গুণ বেশি অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে, আর এসব প্রকল্পের আয় থেকে প্রকল্প-ব্যয়ের অতি সামান্য অংশ মেটানো যাবে। কিন্তু, বাংলাদেশের নিকৃষ্টতম ‘সাপ্লায়ারস ক্রেডিট প্রকল্প’ ১২ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণে নির্মীয়মাণ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। এটি আক্ষরিকভাবেই ‘সাদা হাতি প্রকল্প’। ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য ১৩৫০ কোটি ডলার খরচ একেবারেই অবিশ্বাস্য ব্যাপার! দুর্নীতির খাই কতখানি সর্বনাশা হলে এ রকম একটি প্রকল্প গৃহীত ও বাস্তবায়িত হতে পারে! সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের পুত্র সোহেল তাজ অভিযোগ করেছেন, ২০০৯ সালেই শেখ হাসিনা বলেছিলেন ‘বিএনপি অনেক টাকা কামিয়েছে। এখন আমাদেরকে দুহাতে টাকা বানাতে হবে।’
অতিসম্প্রতি হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান রিমান্ডে স্বীকার করেছেন, এস আলম বিভিন্ন ব্যাংক থেকে যে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি লুট করেছেন তার অর্ধেকটাই দিতে হয়েছে জয় ও টিউলিপকে! সালমান রহমান নিজেও তাঁর মালিকানাধীন বেক্সিমকোর মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ৩৬ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত দেননি। গত ২৪ সেপ্টেম্বর সোশ্যাল মিডিয়ায় খবর বেরিয়েছে যে দেশের চলমান ৮২টি প্রকল্পে শেখ হাসিনার কোনো না কোনো আত্মীয়-স্বজন জড়িত রয়েছেন, যেগুলোর প্রকল্প ব্যয় ৫১ হাজার কোটি টাকার বেশি। ২০২৩ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। নিউইয়র্ক-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি জানিয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বিদেশে ১৪৯.২০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে গেছে।
হাসিনার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন এবং অলিগার্ক ব্যবসায়ীরাই শুধু নন, আওয়ামী লীগের প্রায় সব মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, উচ্চ-স্তরের নেতা-কর্মী এমনকি স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীরাও সাড়ে ১৫ বছরে কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। আমার দুঃখ হচ্ছে যে প্রয়াত মতিয়া চৌধুরী, এম এ মান্নান, আসাদুজ্জামান নূর, সিমিন হোসেন রিমি কিংবা সাবের হোসেন চৌধুরীর মতো অল্পসংখ্যক যেসব নেতা-নেত্রী দুর্নীতি করেননি, তাঁরাও শেখ হাসিনাকে এমন স্বৈরশাসন, গণতন্ত্রহীনতা, বেলাগাম দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের পথ থেকে ফেরানোর জন্য কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারলেন না। ১৬ অক্টোবর মতিয়া আপা মৃত্যুবরণ করেছেন দুর্নীতিবাজ আওয়ামী লীগের লেবাসটা গায়ে জড়িয়ে। তিনি তো সোহেল তাজের মতো আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করে নিজের বিবেকটা অমলিন রাখতে পারতেন!
পাঠকদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, ২০১২ সালের ২০ আগস্ট ঢাকার জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে প্রদত্ত একটি স্মারক বক্তৃতায় সরকারের বিভিন্ন দুর্নীতির উল্লেখ করে আমিই বাংলাদেশে প্রথম হাসিনাকে ‘নির্বাচিত একনায়ক’ আখ্যা দিয়েছিলাম। ওই অনুষ্ঠানে মতিয়া আপা দর্শকের সারিতে উপবিষ্ট ছিলেন। বক্তৃতা শেষ করার পর মঞ্চ থেকে নেমে আমি যখন তাঁকে সালাম দিয়েছিলাম, তখন মতিয়া আপা আমাকে বলেছিলেন, ‘আপনি এত শক্ত কথা বলে ফেললেন?’ আমি বলেছিলাম, ‘কঠিন হলেও সত্য কথাটা কাউকে না কাউকে বলতে হয়, আপা।’ আমি আমার কলামগুলোতে সব সময় হাসিনা সরকারের দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলাম। অপ্রয়োজনীয় মেগা-প্রকল্পগুলোতে এত বিশাল বিনিয়োগের ব্যাপারে বক্তব্য দেওয়ায় ২০২২ সালে হাসিনা ব্যঙ্গাত্মকভাবে আমাকে ‘অর্বাচীন অর্থনীতিবিদ’ আখ্যা দিয়েছিলেন। জার্মান টিভি ডয়চে ভেলে এ ব্যাপারে আমার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে আমি জবাব দিয়েছিলাম, ‘উনি তা বলতে পারেন, কিন্তু আমি আমার অবস্থান বদলাব না।’
হাসিনা কেন ভেবেছিলেন যে তাঁর সরকারের কখনোই পতন হবে না, আজীবন তিনি স্বৈরশাসন চালিয়ে যেতে পারবেন? ৫ আগস্ট শুধু হাসিনাই পালিয়ে যাননি, একই সঙ্গে তিনি বঙ্গবন্ধুকেও এ দেশের রাজনীতি থেকে নির্বাসনে নিক্ষিপ্ত করেছেন। আওয়ামী লীগের প্রায় সব নেতা-কর্মী-মন্ত্রী-সংসদ সদস্য এবং হাসিনার পরিবারের সব সদস্য ও তাঁর আত্মীয়-স্বজন হয় দেশ থেকে বিদেশে ভেগে গেছেন, কিংবা দেশের কোনো গোপন স্থানে পালিয়ে আছেন। আগামী ১০ বছরেও আওয়ামী লীগ এ দেশের রাজনীতিতে আর মাথা তুলতে পারবে না। এখন যখন বিএনপির দুর্নীতিবাজ নেতাদের টেলিভিশনে গলাবাজি করতে দেখি ও শুনি, তখন আফসোস হয় এরা আবার কীভাবে সাধু হয়ে গেল! জামায়াতের স্বাধীনতাবিরোধীরা এখন সরকারের ওপর চেপে বসেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অধিকাংশ সমন্বয়কও শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
ড. মইনুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়