রাঙ্গামাটি:- ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আত্মগোপনে রয়েছেন তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও বেশির ভাগ সদস্য। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর দেশের ৬১ জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে। তবে দুই মাসের বেশি সময় পার হলেও রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যান সুপ্রদীপ চাকমাকে অন্তর্বর্তী সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এরপর থেকে উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানের পদটিও শূন্য রয়েছে। এতে কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে পাহাড়ের উন্নয়ন কার্যক্রম। বরাদ্দও দেয়া হচ্ছে না প্রকল্পগুলোতে।
তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন চেয়ারম্যানসহ পরিষদ পুনর্গঠন না হওয়ায় ফাইল অনুমোদন বা প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যাচ্ছে না। নতুন অর্থবছরের সাড়ে তিন মাস পার হলেও কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। উন্নয়নকাজ বাস্তবায়নে বরাদ্দও দেয়নি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
জানতে চাইলে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা খোন্দকার মোহাম্মদ রিজাউল করিম বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে আমার একক স্বাক্ষরে কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেয়া হচ্ছে। বাকি সব পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। কবে নাগাদ নতুন পরিষদ পুনর্গঠন হতে পারে এ ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পাহাড়ের শাসন পদ্ধতিতে স্বচ্ছতা, গতিশীলতা ও উন্নয়ন নিশ্চিতে উদ্যোগ নেন সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তার শাসনামলে ১৯৮৯ সালে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী থেকে একজনকে চেয়ারম্যান করে ৩৪ সদস্যের একটি পরিষদ গঠন করা হয়। ১৯৮৯ সালের ২৫ জুন পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য এসব পরিষদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর প্রায় তিন যুগেও কোনো নির্বাচন হয়নি। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর স্থানীয় সরকার পরিষদের পরিবর্তে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান নামে পার্বত্য জেলা পরিষদ নামকরণ করা হয়। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর একজনকে চেয়ারম্যান ও চারজনকে সদস্য করে অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ গঠিত হয়। এরপর থেকে যে সরকারই ক্ষমতায় আসে তাদের মনোনীত দলীয় লোকজন দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদের কার্যক্রম চলে আসছে। সর্বশেষ ২০১৪ সালে আইন সংশোধন করে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদকে পুনর্গঠন করে একজন চেয়ারম্যানসহ ১৫ সদস্যের আন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ গঠন করে সরকার। এরপর থেকে আওয়ামী লীগ মনোনীত ব্যক্তিদের নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদের কার্যক্রম চলে আসছিল।
এদিকে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের বেশির ভাগ সদস্য ও চেয়ারম্যানরা ছিলেন আত্মগোপনে। ৩ সেপ্টেম্বর এক অফিস আদেশে শারীরিক অসুস্থতা ও ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন অংসুই প্রু চৌধুরী। ওই অফিস আদেশে পরিষদের সদস্য রেমলিয়ানা পাংখোয়াকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। রাঙ্গামাটিতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব একজন সদস্যকে দেয়া হলেও খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের দুই চেয়ারম্যান মংসুই প্রু চৌধুরী ও ক্যশৈহ্লা রয়েছেন আত্মগোপনে। এরপর তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে অর্থ ছাড়, ফাইল অনুমোদনসহ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের সুযোগ না থাকায় বেতন-ভাতা বন্ধ হয়ে যায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের। তবে ৭ অক্টোবর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এক অফিস আদেশে সংশ্লিষ্ট জেলায় নতুনভাবে জেলা পরিষদ পুনর্গঠন না হওয়া পর্যন্ত পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী প্রকৌশলীর যৌথ স্বাক্ষরে ইউএনডিপির অর্থায়নে প্রকল্পগুলো পরিচালনার জন্য আর্থিক ক্ষমতা দেয়া হয়। একই প্রক্রিয়ায় বেতন-ভাতা পাচ্ছেন পরিষদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও।
অন্যদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর তিন পার্বত্য জেলা সফরে আসেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা। সে সময় তিনি জানান, পার্বত্য জেলা পরিষদ পুনর্গঠন হচ্ছে। তবে দুই মাসেও নতুন পর্ষদ গঠন হয়নি। এ প্রসঙ্গে জানতে উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমার সেলফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব একেএম শামিমুল হক ছিদ্দিকী বলেন, ‘তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে চেয়ারম্যান ও সদস্য নিয়োগের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। আশা করছি শিগগিরই নতুন পরিষদ পুনর্গঠন হবে। তবে উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিয়োগ নিয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে চেয়ারম্যান ও সদস্য নিয়োগের পর বরাদ্দসহ সবকিছুই হবে।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, চেয়ারম্যানের পদ শূন্য হলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান পদে তার যোগদান না করা পর্যন্ত কিংবা চেয়ারম্যান পুনরায় স্বীয় দায়িত্ব পালনে সমর্থ না হওয়া পর্যন্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন ভাইস চেয়ারম্যান। এ আইনের আলোকে বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন ভাইস চেয়ারম্যান রিপন চাকমা।
তিনি বলেন, ‘আইন অনুযায়ী আমি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছি। নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগের বিষয়টি সরকার দেখবে। এখানে আমাদের কোনো এখতিয়ার নেই। আমরা রুটিন কাজ করছি।’
বোর্ডের বরাদ্দ আটকে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে রিপন চাকমা বলেন, ‘অর্থ বরাদ্দ তো মন্ত্রণালয় দেবে, বরাদ্দ না পেলে নতুন প্রকল্পের কাজ শুরু করা যাবে না।’ তবে তিনি উন্নয়ন বোর্ডে যোগদানের পর কোনো বোর্ড সভাও অনুষ্ঠিত হয়নি বলে জানিয়েছেন।বণিক বার্তা