অপু বড়ুয়া:-বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠান প্রবারণা পূর্ণিমা মানে ফানুস উৎসব। উপ–জাতি অ–উপজাতি সকলে মহাসমারোহে এই প্রবারণা পূর্ণিমা পালন করে থাকেন। প্রতিবছর একবার এই পূর্ণিমা তিথিতে আকাশবাতি ফানুস উড়ানো হয়। এই উৎসব উদযাপনের তিন মাস পূর্বে আষাঢ়ী পূর্ণিমা হতে আর্শ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত গেরুয়া বসন পরিহিত ভিক্ষু–শ্রামণেরা,গৃহি–গৃহিনী,আবালবৃদ্ধ বনিতা তথা উপাসক উপাসিকারা সংকল্পবদ্ধ হয়ে বর্ষাব্রত পালন করেন। বিশ্বের সকল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা গভীর শ্রদ্ধা ভরে প্রবারনা পূর্ণিমা পালন করেন। ভোর সকালে–ফুল,উত্তম ফলাদি,ধুপ–বাতি ইত্যাদি নিয়ে সকলে নিজ নিজ বৌদ্ধ বিহারে গমন করেন। উপস্থিত সকলে সমস্বরে মন্ত্রের মাধ্যমে পূজনীয় ভিক্ষুর সান্নিধ্যে পূজা উৎসর্গ করেন। দায়ক–দায়িকরা অষ্টশীল,পঞ্চশীল গ্রহন করেন। বেলা এগারটায় শেষ হয় প্রথম পর্বের অনুষ্ঠান। সন্ধ্যায় সমবেত প্রার্থনায় মিলিত হন ছোট বড় সকলে। প্রার্থনা শেষে বুদ্ধের সম্মুখে মোম বাতি–সুগন্ধিযুক্ত ধুপ প্রজ্বলন করা হয়।
রাত নামতে নামতে শুরু হয় আকাশে রং বেরঙের কাগজের তৈরী ছোট বড় বিভিন্ন সাইজের ফানুস উড়ানো। তরুন যুবকেরা ঢোল,কাসর,মন্দিরা ইত্যাদি বাজিয়ে বুদ্ধকীর্তন গাইতে থাকে আর এদিকে জাদু মন্ত্রের মতো একের পর এক আকাশে উড়তে থাকে ফানুস। পূর্ণিমা রাতে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে ফানুস যখন আকাশে উড়ে যায় তখন সবার মনে প্রাণে ধর্মীয় সন্তুষ্টিতে আত্ম–তৃপ্তি লাভ করে। বুদ্ধের প্রবর্তিত মন্ত্র ছাড়া ফানুস কখনো উড়ানো উচিত নয়। কেননা–উড়ন্ত ফানুসের আগুনে ঘরে–বাড়িতে দোকানে ইত্যাদি স্থানে আগুন ধরে যেত পারে। তবে মন্ত্রের উচ্চারণে উড়ানো ফানুস কখনো কোথাও আগুনে ক্ষতি হয়েছে এমন কোন নজির শোনা যায়নি। বৌদ্ধদের মাঝে ফানুস উড়ানো নচেৎ আনন্দের জন্য নয়। এখানে একটি বৈশিষ্ট জড়িত আছে বৈকি!
মহামানব গৌতম বুদ্ধের জীবনে দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন–কুমার সিদ্ধার্থের সন্ন্যাসব্রত গ্রহণের লগ্নে রাজপ্রাসাদ থেকে তিনি তার চুল কেটে ফেলেন এবং আকাশ মার্গে উড়িয়ে দিতে দিতে বলেন-‘যদি আমার উদ্দেশ্য ও গৃহ ত্যাগের মিশন সফল হয় তাহলে আমার চুলগুলো উপরের দিকে চলে যাবে, আর যদি মনস্কাম বিফল হয় তাহলে চুলগুলো মাটিতে পড়ে যাবে।’ কিন্তু কুমার সিদ্ধার্থের চুলগুলো আকাশ মার্গে উড়ে গিয়েছিলো। অন্যটি হচ্ছে–বুদ্ধ তাঁর মায়ের উদ্দেশ্যে ধর্ম প্রচারের জন্য তাবতিংস নামক স্থানে যাওয়ার সময় আকাশে উড়ানো বাতি তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো। সে কারনে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা ধর্মের অংশ হিসাবে প্রবারণা পূর্ণিমার দিনে অধিক উৎসাহ উদ্দিপনা নিয়ে আকাশে আলোক প্রজ্বলন ফানুস উড়িয়ে থাকেন।
ফানুস তৈরীর কোন আলাদা কারিগর নেই। বংশ পরাষ্পরা তরুণ যুবক সমাজই স্থানীয় ভাবে ফানুস তৈরী করে থাকেন। প্রতিটি ফানুস তৈরী করতে প্রয়োজন ছোট বড় অনুযায়ী বাজারে পাওয়া যায় এমন ৩০ থেকে ৫০টি সাইজের কাগজ। শুকনা বাঁশের ফালির রিং,গুনার তার, গাম, মোম মাখা সুতার ফিতা যেখানে আগুন লাগিয়ে আকাশে উড়ানো হয়। এই উৎসবে বৌদ্ধ মন্দির গুলো ঝাকজমক ভাবে তোরণ, রঙিন বিজলী বাতি দিয়ে সাজানো হয়। বোধি বৃক্ষে ধ্বজা পতাকা উড্ডিন করা হয়। লোকে লোকারণ্য থাকে প্রতিটি বৌদ্ধ বিহার প্রাঙ্গণ। ছোট বড় সবার গায়ে থাকে নতুন নতুন পোশাক আবার বুড়োরা সাদা কাপড় পড়তে অধিক আগ্রহী। প্রবারণা উৎসবে ভান্তেদের চাইতে গৃহি–গৃহিনীরা ছেলে–মেয়েরা বেশী আনন্দ উপভোগ করেন। সে–কি এক অপরুপ দৃশ্য! পুরো বৌদ্ধ পল্লীতে আনন্দের ঢেউ। শুধু আমাদের দেশে নয়–সুদূর সিংহল, বার্মা, বুদ্ধগয়া, জাপান, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাউস, চীনসহ ইত্যাদি বৌদ্ধ প্রধান দেশে যথারীতি ধর্মীয় মর্যাদায় প্রবারণা পূর্ণিমা/ফানুস উৎসব পালিত হয়ে থাকে।
বৌদ্ধ ধর্মের মূল মন্ত্র হচ্ছে–অহিংসা পরম ধর্ম। বিশ্বের সকল প্রাণির প্রতি মৈত্রী ও করুণা বুদ্ধ প্রচারিত ধর্মের এক অনন্য দিক। তথাগত বুদ্ধ বলেন– মা যেমন পুত্রকে ভালোবাসেন,ঠিক তেমনি জগতের সকল প্রাণির প্রতি অপ্রমেয় মৈত্রী ভাব পোষণ করতে হবে এবং সকল প্রাণিকে বুকে স্থান দিতে হবে। আমি যেমন আঘাতকে ভয় করি,তেমনি জগতের সকল প্রাণি আঘাতকে ভয় করে। আমি যেমন মৃত্যু ভয়ে ভীত হই,ঠিক তেমনি সকল প্রাণিই মৃত্যুকে ভয় করে, সুতরাং সকল প্রাণিকে আত্মবৎ মনে করে কাহাকেও আঘাত করা যাবে না। কোন প্রাণিকে বধ করা যাবে না। বুদ্ধ দর্শন হচ্ছে অনাত্মবাদী দর্শন। মমত্ববোধ,অহিংসা ও মৈত্রীর এই বাণী বিশ্বের সকল প্রাণির সর্বকালের সর্বযুগের মানুষের নিকট আবেদন সৃষ্টি করে আসছে। লোভ হিংসাত্মক মনোভাব বর্জন করতে হবে। চিত্তকে পরিশুদ্ধ করে মানব সেবায় এগিয়ে আসার আহ্বান এই প্রবারণা পূর্ণিমা দিনে। এই আনন্দঘন দিনটি শুধু বৌদ্ধ সম্প্রদায় নয়, বাংলাদেশের সকল সম্প্রদায়ের মানুষ সমান তালে উপভোগ করেন আনন্দে উদ্বেলিত হন ফানুস উৎসবে। জগতে সকল প্রাণি সুখি হোক। বিশ্বে শান্তি বিরাজ করুক। শুভ সুন্দর হোক আজকের শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা তিথি তথা ফানুস বাতি উৎসব।
লেখক : ইঞ্জিনিয়ার,গীতিকার–বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন।