জয়নুল আবেদীন:- আমাদের ভূখণ্ডের উত্তর-দক্ষিণ দুই প্রান্তের দু’টি স্থানের নাম তেঁতুলিয়া ও টেকনাফ। দুই প্রান্তের দূরত্ব ৯২০ কিলোমিটার। ঢাকা থেকে তেঁতুলিয়ার যা দূরত্ব এর প্রায় দ্বিগুণ দূরত্ব টেকনাফ। একবার গিয়েছি তেঁতুলিয়া, তাও বিশেষ প্রয়োজনে। সত্তরের দশক থেকে অপ্রয়োজনে টেকনাফ এলাকায় কতবার গিয়েছি লেখাজোখা নেই। সত্তরোতীর্ণ বয়সেও মন ছুটে যায় দক্ষিণের সাগর, পাহাড় ও জঙ্গলে। সর্বশেষ নভেম্বর ২০১৯ গিয়েছিলাম খাগড়াছড়ি। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়াসহ শারীরিক অসুস্থতায় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে হাজার ফুট উচ্চতায় নির্মিত গ্রাউন্ড অলিম্পিক যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এখন প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললে দেখি পাহাড়ি-বাঙালির দ্বন্দ্ব। খাগড়াছড়ির দীঘিনালা থেকে এ দ্ব›দ্ব শুরু হয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে তিন পার্বত্য জেলায়।
ব্রিটিশ আমল ১৮৬০ সালে গঠিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা’ ১৯৮৪ সালে তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান- এই তিন নাম ধারণ করে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার মোট আয়তন ৫,১৩৩ বর্গমাইল। যা বাংলাদেশের মোট আয়তনের এক-দশমাংশ। তিন জেলার মধ্যে আয়তনে বড় রাঙ্গামাটি। রাঙ্গামাটির আয়তন ৬১১৬.১১ বর্গকিলোমিটার। এ জেলার বৃহত্তর ইউনিয়ন সাজেক, আয়তন ১৭৭১.৫৫ বর্গকিলোমিটার। কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত আমাদের মেঘনা উপজেলার আয়তন প্রায় ১০০ কিলোমিটার। আমাদের উপজেলা থেকে একটি ইউনিয়নের আয়তন ১৮ গুণ বড়।
প্রথম যখন কক্সবাজার যাই তখন কুমিল্লা অতিক্রম করে কিছু দূর যেতে চোখ পড়ে পূর্বদিকে। মনে হয়েছিল পূর্ব দিগন্তজুড়ে মেঘ জমে রয়েছে। খণ্ড খণ্ড জমাট বাঁধা এসব মেঘ নয়, পাহাড়। পাহাড়গুলো হিমালয় রেঞ্জের অংশ। গাড়িতে বসে যে পাহাড়গুলো দেখা যায় সেগুলোর অধিকাংশ ভারতে ও মিয়ানমারে। ভারতের পরে আবার বাংলাদেশ, তারপর আবার ভারতের মিজোরাম। অর্থাৎ পার্বত্য তিন জেলার উত্তরে ত্রিপুরা, পূর্বে মিজোরাম দক্ষিণে নাফ নদী, নাফ নদীর পূর্বে মিয়ানমার। ফেনী থেকে শুরু করে টেকনাফ ৩০০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরত্ব রাস্তার পূর্বদিকের প্রায় পুরো অংশ পার্বত্য এলাকার তিনটি জেলা, সাতটি পৌরসভা, ২৬টি উপজেলা, ১২১টি ইউনিয়ন, ৪৬১০টি গ্রাম যেখানে রয়েছে প্রায় সাড়ে ১৮ লাখ লোকের বাস।
মানব প্রবৃত্তি বড় বিচিত্র। খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান- মানুষের এ তিন মৌলিক চাহিদা পূরণ হওয়ার পর অভাব শুরু হয় বিনোদনের। এখন বিনোদনের শীর্ষে ভ্রমণ। ভ্রমণে চাই মনের মতো অবকাশ যাপনের উপযুক্ত স্থান, যেখানে চাহিদা মোতাবেক ক্ষুধা নিবারণে মনের মতো খাদ্য, নয়ন জুড়াতে অপরূপ দৃশ্য, হৃদয় জুড়াতে বিনোদন, কেনাকাটায় নতুন নতুন স্যুভেনিয়র ছাড়াও চুম্বকের মতো সবচেয়ে যা বেশি টানে তা হলো রহস্য। রহস্যের সন্ধানে চলে যেতে চায় অজানার পথে। এককালে মনুষ্য বাসের অযোগ্য দুর্গম এলাকাগুলো সুগম হয়েছে রহস্যের সন্ধানে। শুধু সুগম নয়, বাসের অযোগ্য স্ক্যান্ডিনেভিয়াভুক্ত দেশগুলো বিশে^র সুখী রাষ্ট্রের তালিকায় বারবার সামনে চলে আসছে। একই আকর্ষণে আমরা ক’জন গিয়েছিলাম বিশে^র সর্বোচ্চ প্যাট্রোনাস টুইন টাওয়ার দেখতে। তৎসঙ্গে মালয়েশিয়ার দুর্গম স্থানের নাম ছিল উলুকালি পাহাড়। মালয়েশিয়ার মধ্যভাগে পাহাং রাজ্যের দুর্গম এই পাহাড়ি সেক্টরটি পর্যটকদের কাছে ‘বিস্ময়কর, রহস্যপুরী, আলো-আঁধারির দেশ, রোদবৃষ্টির মেলা, মেঘকুমারীর দেশ’ ইত্যাদি নানা অভিধায় পরিচিত।
সেখানে প্রকৃতি আর মানুষের সৃষ্ট জগতের মধ্যে আলিঙ্গনের অপূর্ব লীলাবৈচিত্র্য স্বচক্ষে দেখতে পর্যটকরা পঙ্গপালের মতো হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। গাইড আগের দিন জানিয়ে দিলো, স্থানটি খুব ঝুঁকিপূর্ণ। শক্তিশালী ইঞ্জিনযুক্ত গাড়ি ও দক্ষ চালক ছাড়া গেনটিং এলাকায় যাওয়াটা বিপজ্জনক। হাড় কাঁপানো শীতসহ সর্বক্ষণ রোদ-বৃষ্টি ও মেঘের আনাগোনা লেগে আছে। একই দেশের একই এলাকায় অল্প বিস্তর ব্যবধানে কোথাও শীত, কোথাও উষ্ণ, ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
কুয়ালালামপুর থেকে গেনটিং হাইল্যান্ড দুই ঘণ্টার পথ। যার মধ্যে দেড় ঘণ্টাই পাহাড়ি এলাকা। পাহাড়ের ওপর দিয়ে, কখনো কখনো পাশ ঘেঁষে কঠিন পাথর কেটে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। রাস্তার পাশের কোনো কোনো পাহাড় এত উঁচু ছিল যে, গাড়ির ভেতর থেকে চূড়া দেখা যায় না। পাহাড় ও গিরিকন্দবের পাশ ঘেঁষে আমরা এঁকেবেঁকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে শুধু উপরের দিকে উঠছি তো উঠছিই। উপরে উঠতে উঠতে একসময় মেঘরাজ্য হাতের কাছে চলে আসে। আমাদের গাড়ির সামনে উপরে, ডানে-বামে, নিকটে-দূরে পাহাড়ের ঢালে, গর্তে, চূড়ায় সর্বত্র খণ্ড খণ্ড পেঁজা তুলোর মতো মেঘপরীরা দল বেঁধে গল্প করছে, গিরি খোঁড়লে কেউ চুপচাপ ঘুমিয়ে আছে, কেউবা এদিক-ওদিক হাঁটাহাঁটি ছুটাছুটি করছে। গাড়ির কাচ সামান্য ফাঁক করতে দুরন্ত মেঘ-শিশুরা সাঁ করে ভেতরে ঢুকে যায়। মুহূর্তে নরম হাতের কোমল পরশে ভিজিয়ে দেয় শরীরের উপরের অংশ। মাঝে মধ্যে পাহাড় ও বৃক্ষের ফাঁকফোকর গলিয়ে এক ঝলক সোনালি রোদ ষোড়শী কুমারীর মতো ভীতু চোখে উঁকি মেরে মুচকি হেসে বিজলির মতো মিলিয়ে যায়।
আমাদের গাড়ি আরো উপরে উঠছে। তুলার সাগর সাঁতার কেটে কেটে আমরা যেন আরব্য রজনীর পরীর রাজ্যে চলেছি। কোথাও কোথাও পাহাড় থেকে নেমে এসেছে ছোট-বড় ঝরনা। পাহাড়ের পার্শ্বদেশে কৃত্রিমভাবে রচিত খাঁজকাটা ভাঁজ ভাঁজ সোপান, ওপর থেকে নানা রকম শব্দে নাচানাচি করে সোপানের খাঁজকাটা ভাঁজ বেয়ে নিচে নেমে আসছে বৃষ্টি ও ঝরনার পানি। স্যুয়ারেজ ও ড্রেন দিয়ে নেমে আসা পানি চলে যাচ্ছে কৃত্রিম জলাশয়ে।
পাহাড়ের ওপর থেকে যাতে কোনো পাথর গড়িয়ে রাস্তায় চলে আসতে না পারে কিংবা অসাবধানতায় কোনো যানবাহন যাতে গভীর গিরিখাদে পড়ে যেতে না পারে সেদিক লক্ষ্য রেখে লোহার জাল ও শক্ত খুঁটি দিয়ে নিরাপত্তার বিষয়টি লক্ষ করার মতো।
ছয় হাজার ফুট উপরে উঠতে আরো অনেক বাকি। রাস্তার মাঝখানে বড় একখণ্ড মেঘ জমাট বেঁধে আছে। তাই সামনে মেঘ ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। আমাদের গাড়ি আস্তে করে মেঘখণ্ডের ভেতর ঢুকতে মনে হলো আমরা ভ‚মিতে নেই, আকাশে মেঘরাজ্যে বিমানের যাত্রী, কিংবা আরব্য উপন্যাসের ম্যাজিক কার্পেটে চড়ে পরীর রাজ্য পার হচ্ছি। ঠিক এ সময় আমাদের পেছনের সিটে বসা এক নারীকণ্ঠ চিৎকার করে উঠল- ‘দুলাভাই, পয়সা উসুল’।
আরো আছে, বিস্ময়কর এ আনন্দ নগরীতে আরো আছে কয়েকটি বিশাল আকারের হলরুম। হলরুমে রাত-দিন চলে কনসার্ট, বিশ্বমানের টপ শো, উঁচু মানের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানাদি।
এই স্বপ্নে ঘেরা মায়াপুরী বিশ্বে বিখ্যাত হাইর্যাঙ্গস জুয়ার জন্য। হোটেলের ক্যাসিনোতে প্রতি রাতে বসে জুয়ার আসর, কোটি কোটি টাকা হাতবদল হয়। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জুয়াড়িদের প্রধান আকর্ষণ এককালের জনমানবহীন অন্ধকার পাহাং রাজ্যের উলুকালি পাহাড়ের নির্জন চূড়া। রহস্যময় উলুকালি পাহাড় আরোহণের দরজা মালয়েশিয়ান মুসলিম স¤প্রদায় ছাড়া বিশ্ববাসীর জন্য সর্বদা উন্মুক্ত বলে জানা যায়।
সন্ধ্যা শুরু হতে না হতে ঘন কুয়াশা নামতে শুরু হয়। এতক্ষণে আমাদের মাইক্রো দুটো ঘুরে ঘুরে গেনটিং হাইল্যান্ডের কাছে চলে আসে। পাহাড় ও গিরিখাদের পাশ ঘেঁষে উপরে ওঠা বিপজ্জনক। ওপর থেকে নেমে আসা আরো বেশি বিপজ্জনক।
দুর্গম কুয়াশাচ্ছন্ন পথ দিয়ে নানা বয়সের ২০ পর্যটক সে পথে অ্যাডভেঞ্চারে বের হয়েছি সে পথে ফিরতে হবে। একটু অসাবধান হলে জীবনপ্রদীপ এক ফুৎকারে নিভে যেতে পারে। সব জেনেশুনেও মানুষ দুঃসাহসী অভিযানে বের হয়। সূচনাপর্ব থেকে ভয়ঙ্কর সুন্দরের প্রতি চিরন্তন আকর্ষণে নতুন পথের সন্ধান পেতে গৃহসুখ বিসর্জন দিয়ে শ্বাপদসঙ্কুুল পথে বের হয়ে আসছে মানুষ। তাছাড়া যে মানুষের নিষ্কৃতি নেই। আর সে কারণে হয়তো মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়েছে প্রকৃতির বিশ্ব নির্বাচনে শ্রেষ্ঠত্বের আসন লাভসহ পিরিনিজ পর্বতগুহা থেকে বের হয়ে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে যাতায়াত করা।
হোটেলে ফেরার পথে প্রকৌশলী হাশেম সাহেব আক্ষেপ করে বললেন, ‘আমি ১০ বছর রাঙ্গামাটি ছিলাম, যার একদিকে পৃথিবীর বৃহত্তর বেলাভ‚মি, আর অপরদিকে মায়াময় সবুজ পাহাড়। সেখানেও দেখা যায় পাহাড়ের গিরিকন্দর, খন্দখোঁড়লে একইরকম জমাট বাঁধা মেঘ। উদ্যোগ নিলে রাঙ্গামাটি এলাকায় এর চেয়েও সুন্দর পৃথিবীর বৃহত্তম স্বপ্নপুরী নির্মাণ করা সম্ভব। বিশ্বের পর্যটকরা হুমড়ি খেয়ে পড়ত রাঙ্গামাটির গেনটিং এলাকায়। কিন্তু তা আমরা পারছি না। সেখানকার পাহাড়িরা স্বায়ত্তশাসনের নামে ইচ্ছাকৃতভাবে অশান্ত করে রাখছে এলাকাটি।
লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
adv.zainulabedin@gmail.com