ডেস্ক রির্পোট:- ২০১৮ সালের ৩ এপ্রিল সড়ক দুর্ঘটনায় বিআরটিসির দুই বাসের মাঝে রাজীবের বিচ্ছিন্ন হাত আটকে থাকার ছবি দেশের মানুষকে কাঁদিয়েছিল। একই বছরের ২৯ জুলাই শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী জাবালে নূর পরিবহনের বাসচাপায় নিহত হওয়ায় আন্দোলনে নেমেছিল শিক্ষার্থীরা। রাজীবের ঝুলে থাকা হাত আর দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু স্পষ্ট করে হাসিনার আমলে সড়কে পরিবহনের অব্যবস্থাপনার চিত্র। সে সময় শিক্ষার্থী আন্দোলনের কারণে তৎকালীন সরকার সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ নামে একটি আইন পাস করে। তবে আইনটি আজও পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, পরিবহন শ্রমিক নেতা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী মন্ত্রী শাজাহান খানের কারণে এ আইনটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা যায় নি। হাসিনা সরকারের পতনের দুই মাস হতে চলেছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে পরিবহন সেক্টরে এখনও কেন ফিরছে না শৃঙ্খলা?
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে পরিবহন সেক্টর চাঁদামুক্ত, সন্ত্রাসমুক্ত, নিরাপদ যাত্রীবান্ধব ও সড়ক পরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে নানামূখী উদ্যোগ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। গত ৩ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় মালিক সমিতির নব গঠিত কমিটির আহ্বায়ক মো. সাইফুল আলম এই ঘোষণা দেন। কিন্তু তার সে ঘোষণা এক মাসেও বাস্তবায়ন শুরুই হয়নি। গত মঙ্গলবার তিনি ইনকিলাবকে বলেছেন, আমাদের কাজ শুরু হয়েছে মাত্র। এক সপ্তাহের মধ্যে আমরা অ্যাকশনে যাবো। এদিকে, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ মাঝেমধ্যে অভিযান চালাচ্ছে। জরিমানা করছে। কিন্তু অবৈধ যানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে বলা হলেও বাস্তবে তা খুবই নগন্য। ৬ লাখ অবৈধ ব্যাটারি রিকশা ও ইজিবাইকের মধ্যে থেকে ২/৩শ’ আটক করেই পুলিশ কঠোরতার বার্তা দিচ্ছে। যা অনেকটাই হাস্যকর!
পুরো রাজধানীই এখন যানজটের নগরী ভোর থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত এমন কোনো স্থান খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে যানজট নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার পর গাড়ি নড়লেও বাড়ছে না গতি। অফিস পাড়া থেকে শুরু করে বিমানবন্দর সড়ক, ভিআইপি সড়ক, ফ্লাইওভার থেকে শুরু করে এক্সপ্রেসওয়ে সবখানেই গাড়ির সারি। ঢাকার প্রবেশপথে উত্তরা, যাত্রাবাড়ী, গাবতলী, ডেমরা কিংবা বসুন্ধরার তিনশ’ ফিট রাস্তায় দিনভর যানজট। স্বৈরাচারি হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে এ অবস্থার সৃষ্টি। শুরুর দিকে ট্রাফিক পুলিশের অনুপস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের চেষ্টায় সড়কে শৃঙ্খলা ফেরার পাশাপাশি যানজট পরিস্থিতিরও উন্নতি হয়। শিক্ষার্থীরা রাস্তা থেকে উঠে যাওয়ার পর রাতারাতি যানজটের যন্ত্রণা বাড়তে থাকে। যা বাড়তে বাড়তে এখন অসহনীয় পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে।
সড়ক পরিবহন সংশ্লিষ্ট মালিক, নেতা, শ্রমিক এবং ভুক্তভোগিদের মতে, রাজধানীতে যানজটের প্রধার কারণ হলো মাত্রাতিরিক্ত যানবাহনের চাপ। এর মধ্যে রয়েছে ৪ লাখ বৈধ রিকশা, ৫ লাখ অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা, ১লাখ অবৈধ ইজিবাইক, ১ লাখ ৩৪ হাজার অ্যাপসভিত্তিক যানবাহন, ১ লাখ ঢাকার বাইরের সিএনজি অটোরিকশা, ১২ লাখ মোটরসাইকেল, সাথে রেজিস্ট্রেশনভুক্ত ২৫ লাখ বিভিন্ন যানবাহন। এসব যানবাহনের মধ্যে সবচেয়ে বেপরোয়া যাত্রীবাহী বাস ও মোটরসাইকেল। বাসগুলো কোনো নিয়মকানুন মানে না। যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা করায়। সিগনাল মানে না। একই সারিতে তিন চারটি বাস এক সাথে দাঁড়িয়ে রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। এসব বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য পরিবহন শ্রমিকরাই দায়ী, যাদের অধিকাংশই শাজাহান খানের অনুসারী। অনেকের মতে, এরা ইচ্ছে করে এসব বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। এদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো যাবে না।
সড়কে কেন ফিরছে না শৃঙ্খলা-জানতে চাইলে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ফিরবে কীভাবে? আমার তো মনে হয় আইন মান্যকারী কমেছে বরং অমান্যকারী বেড়েছে! আইন সবার জন্যই। দায় চালক কিংবা পরিবহন সেক্টরের মানুষদের বেশি, কিন্তু পথচারী বা যাত্রীদের কি কোনো দায় নেই? ফুটওভার ব্রিজ থাকা সত্ত্বেও ঝুঁকি নিয়ে পার হয়ে যাচ্ছি।
একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, হাসিনার আমলে ডিএমপি কমিশনারের উপরি আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস ছিল পরিবহন সেক্টর। প্রতি মাসে পরিবহনে চাঁদাবাজির কোটি টাকা যেতো ডিএমপি কমিশনারের পকেটে। এখন সেই উপরি আয় বন্ধ। ট্রাফিক পুলিশও উপরি আয় বন্ধের কারণে কাজে উৎসাহ পাচ্ছে না। যে কারণে তারা সক্রিয় হতে পারছে না। ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. হানিফ খোকন বলেন, ট্রাফিক পুলিশ ইচ্ছা করলেই একদিনে পরিবহন সেক্টর তথা রাজধানীর রাজপথে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারে। সেক্ষেত্রে অবৈধ রিকশা, ব্যাটারি রিকশা, ঢাকার বাইরের সিএনজি অটোরিকশাসহ কয়েক লাখ যান উচ্ছেদ করতে হবে। একই সাথে ফুটপাতও উচ্ছেদ করতে হবে। তাহলে শৃঙ্খলা ফিরতে বাধ্য।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবহন খাতের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার লোকজন, পুলিশ, পরিবহন মালিক, শ্রমিকদের নিয়ে দুর্নীতির দুষ্টু চক্র গড়ে উঠেছে এক যুগের বেশি সময় ধরে। এই চক্র চায় না পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসুক। এই প্রেক্ষাপটে সড়কে সুশাসন প্রতিষ্ঠা নতুন সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারের উচিত হবে এই দুষ্টচক্রকে ভেঙে দিতে আরও কঠোর হওয়া। এজন্য প্রয়োজনে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে নতুন কমিটি গঠন করতে হবে। তা না হলে শাজাহান খানের অনুসারী শ্রমিকরাই নগরবাসীকে অতিষ্ঠ করে সরকারের অর্জ কে ম্লান করে দিতে পারে।